Advt

Advt

khelar-sathi-story-galpo-first-part-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-খেলার-সাথী-নলিনাক্ষ-ভট্টাচার্য

ধারাবাহিক  বড়  গল্প

khelar-sathi-story-galpo-first-part-nalinaksha-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-খেলার-সাথী-নলিনাক্ষ-ভট্টাচার্য

১ম পর্ব

        দুই হাত জোড় করে সামনে ঝুঁকে গনপতলাল মিশ্র যেভাবে নন্দিতাকে প্রণাম জানাল তাতে ওর মনে হল এই বিহারি ছেলেটি হয়ত কোন মন্দিরে পুজোটুজো দিয়ে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে ওর অফিসে কেননা ওর মাথায় ছিল লম্বা লাল টিকা।

        নন্দিতা হেসে বলল, “ অত সম্মান জানাতে হবেনা আমাকে। চেয়ারে বোস।”

        গনপত এসে চেয়ারে বসলে নন্দিতা একবার ভালভাবে দেখে নিল ছেলেটিকে। নন্দিতার পিএ রূপা মিত্র মোট বারোটি ছেলেকে ডেকেছিল নৌকরি ডট কম থেকে। গত দু’দিন ধরে ওদের ইন্টারভিউ নিয়ে রূপা যে তিনটি ছেলেকে শর্ট লিস্ট করে রেখেছিল তাদেরই ইন্টারভিউ নিচ্ছে এখন নন্দিতা। মার্কেট রিসার্চ ব্যুরোর ডাইরেক্টর নন্দিতা বোস এই ইন্টারভিউটা নিচ্ছে ওর অফিসের কোন খালি পদ ভর্তি করতে নয়,ওর ছেলের জন্য এক মাসের একজন সঙ্গী খুঁজতে। আগামি সপ্তাহে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হলে নন্দিতার তের বছরের ছেলে অর্ণব,যার ডাক নাম বান্টি, দেরাদুন থেকে এসে উঠবে ওর গ্রেটার কৈলাশের ফ্ল্যাটে। নামজাদা আর্কিটেক্ট রণেন বোসের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাবার পর কোর্ট থেকে বান্টির কাস্টডি আদায় করে চার বছর ছেলেকে নিজের কাছেই রেখেছিল নন্দিতা। কিন্তু ডাইরেক্টর পদে প্রমোশনের পর কাজের চাপে ক্রমশই এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও যে ছেলের জন্য একদম সময় দিতে পারতনা নন্দিতা। আয়া আর হোম টিউটরের তত্ত্বাবধানে সঙ্গীহীন বান্টি ক্রমশ জেদি হয়ে উঠছিল। তাই গত বছর নন্দিতা ওকে দেরাদুনের   রক্‌উড বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।

    সত্তর একর বিস্তৃত বিশাল ক্যাম্পাস যুক্ত আশি বছরের পুরনো এই স্কুলে উচ্চমানের পড়াশুনার বাইরেও খেলাধূলা, গানবাজনা, নাটক এ সবের সুব্যবস্থা থাকায় বান্টি খুব ভালভাবেই মানিয়ে নিয়েছে ওর নতুন পরিবেশে। ইতিমধ্যেই পিয়ানো বাজানো, সাঁতার কাটা আর গলফ খেলায় বান্টি ওর নিজের ফর্মের ছেলেদের অনেককেই টেক্কা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তের বছরের ছেলে গরমের ছুটিতে বাড়ি এসে কাজের মেয়ে সন্ধ্যা আর ড্রাইভার শিউশরণের সঙ্গে কথা বলেতো একটা মাস কাটিয়ে দিতে পারবেনা। তাই বান্টির জন্য একমাসের এক তরুণ সঙ্গী খোঁজার প্রয়োজন বোধ করেছে নন্দিতা।

        শর্ট লিস্টের অন্য দুটি ছেলেকে যে প্রশ্নগুলো করেছিল গনপতকে এখন সেগুলোই জিজ্ঞেস করল নন্দিতা। “ দিল্লিতে কতদিন এসেছ?”

        “ ম্যাডামজি তিন মাস।”

        “ ম্যাডামের সঙ্গে ‘জি’ যোগ করতে হয়না গনপত, মনে থাকবে?”

        গনপত মাথা দোলাল।

        “ বিহারের দ্বারভাঙ্গা থেকে এসেছ তুমি। ওখানে কি করতে?”

        গনপতকে একটু অপ্রস্তুত দেখাল, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল ও। ওর একপাতা বায়োডাটার মার্জিনে রূপা লিখে রেখেছে ‘ গনপত নাচ জানে’। “ তুমি নাচতে পার?”

        গনপত আস্তে আস্তে মাথা দোলাল।

        “ কি নাচতে পার তুমি?”

        “ হিন্দি, ভোজপুরি ছবির গানের সঙ্গে নাচি আমি। একটা নাচের দলের সঙ্গে মেলায় আর বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে-শাদিতে, জন্মদিনের উৎসবে আমি নাচতাম। তা ছাড়া আমাদের গাঁয়ের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে রাসলীলায়ও নেচেছি আমি।”

        “ আমার ছেলের বয়স তের বছর,তোমার থেকে ছয় বছরের ছোট। শুধু নাচ দেখিয়ে তো একমাস ওর মনোরঞ্জন করতে পারবেনা তুমি। খেলাধূলো জান কিছু?”

        “ স্কুলে কাবাডি, ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি আমি, ম্যাডাম।”

        “ তোমার বাবা কি করেন?”

        “ দেশে কয়েক বিঘা জমি আছে আমাদের, বাবা চাষবাসের কাজ দেখেন। তা ছাড়া আশপাশের মন্দিরে রামায়ণ আর ভাগবত পাঠ করেও কিছু আয় করেন।”

        সাদাসিধা একটু সরল প্রকৃতির সদ্য গাঁ থেকে আসা এই ছেলেটিকে পছন্দ হয়ে গেল নন্দিতার। একমাস এর সঙ্গে থাকলে দেশের মাটির সঙ্গে অপ্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ হলেও সেটা বান্টির পক্ষে ভালই হবে। তা ছাড়া টিভির নাচগানের রিয়ালিটি শো’র সৌজন্যে সিনেমা ভিত্তিক নাচ গানতো এখন আশি বছরের বুড়োবুড়ি থেকে পাঁচ বছরের নাতি নাতনি একসঙ্গে বসেই দেখে। এ ব্যাপারে কোন উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছেলেকে বাধা নিষেধ করতে যাওয়ার কোন মানে হয়না। কিন্তু ওকে কাজে বহাল করার আগে ওর দায়দায়িত্ব এবং ‘ডু’জ এ্যান্ড ডোন্ট’স’ ওকে ভালভাবে বোঝাতে চায় নন্দিতা।

        “ শোন গনপত, একমাসের জন্য তোমাকে রাখবো আমি। সকাল নটা থেকে রাত নটা, বারো ঘন্টা তোমাকে থাকতে হবে আমার ছেলের সঙ্গে। এর জন্য বিশ হাজার টাকা পাবে তুমি। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ আর সন্ধ্যার চা আমার বাড়িতেই খাবে তুমি। আমার ছেলে যদি মলে, সিনেমায় বা কোন পার্কে যেতে চায় আমার পিএ রূপা মিত্র-র সঙ্গে কথা বললে ও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু এই কাজে কয়েকটা শর্ত মেনে চলতে হবে তোমাকে। সেগুলো ভালভাবে শুনে নাও। প্রথম শর্ত, তোমার লম্বা চুল আর বড় নখ কেটে ফেলতে হবে।”

        গনপত একটু চমকে গেল নন্দিতার কথা শুনে। “ কিন্তু ম্যাডাম, আমিতো চুলে তেল দিয়ে ভালভাবে আচড়ে নিই আর নখও পরিষ্কার রাখি। আমার মাথায় কোন উকুন নেই।”

        নন্দিতা একটু কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল ছেলেটির দিকে। বহুদিনের অভ্যাস ছেড়ে দিতে ওর আপত্তি আছে, কিন্তু নন্দিতা এ ব্যপারে কোন সমঝোতা করতে রাজি নয়। “ আমার পছন্দ নয় যে তুমি এগুলো নিয়ে মেয়েলি চেহারায় আমার ছেলের সঙ্গে ঘোরাফেরা কর।”

        গনপত দীর্ঘ নিঃশ্বাস চেপে বলল, “ আপনি যেমনটা চাইছেন তেমনটাই করব আমি।”

        “ গুড। আমার ছেলের সঙ্গে সব সময় ভদ্রভাবে কথা বলবে তুমি, কক্ষণো গালি-গলাজ মুখে আনবেনা, ঠিক আছে?“

        গনপত হেসে বলল, “ আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ম্যাডাম, আমি ওকে আমার ছোট ভাইয়ের মতই দেখব, আর ওর সঙ্গে সেই রকম ব্যবহার করব সব সময়।”

        “  খুব ভাল। একসঙ্গে চলাফেরার সময় ওর হাত ধরতে পার কিংবা কাঁধেও হাত রাখতে পার কিন্তু তার বেশি ঘণিষ্ঠ হবার চেষ্টা করবেনা তুমি – এমনকি ও চাইলেও নয়। আমার কথার অর্থ তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ? ”

        গনপত একটু অবাক হলেও আবার মাথা দোলাল।

        “  আমার শেষ শর্ত – আমার ছেলের বা কাজের লোকদের কাছ থেকে তুমি কক্ষনো টাকা ধার চাইবেনা। প্রয়োজন হলে আমার কাছে টাকা চাইবে তুমি। মনে থাকবে কথাটা?”

         গনপত একটু ইতস্তত করে বলল, “ ম্যাডাম আমাকে যদি কিছু টাকা অগ্রিম দেন তবে নতুন জামা কাপড় কিনে একটু ফিটফাট হয়ে কাজে আসতে পারব।”

        “ ঠিক আছে, আমি রূপাকে বলে দিচ্ছি তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা এ্যাডভান্স দেওয়ার জন্য।”

        “ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ম্যাডাম।”

ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই গনপত, আমার অফিসের অনেক কর্মচারীকেই এ্যাডভান্স দিয়ে থাকি আমি। আরেকটা কথা, তোমার নামটা বড্ড সেকেলে। তোমার আপত্তি না থাকলে যতদিন আমার ছেলের সঙ্গে থাকবে ততদিন তোমাকে অন্য একটা নামে ডাকব আমরা। চিন্টু নামটা পছন্দ হয় তোমার?” বান্টির সঙ্গে চিন্টু নামটার মিল আছে বলেই নন্দিতা ঐ নামটা পছন্দ করে বসল।

        গনপত আবার মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

        নন্দিতা সামনে রাখা গনপতের বায়োডাটাতে আরেকবার চোখ বোলাল। “ মুনিরকা গাঁয়ের একটা ঠিকানা দেখছি তোমার বায়োডাটাতে। তুমি কি ওখানে একা থাক?”

        “ না ম্যাডাম, ওখানে আমার এক দেশওয়ালি চাচার সঙ্গে থাকি আমি।”

        নন্দিতা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। বয়স্ক একজন মানুষের সঙ্গে থাকলে ছেলে ছোকড়ারা চট করে বখে যেতে পারেনা। তা ছাড়া মুনিরকা থেকে গ্রেটার কৈলাশের দূরত্ব পাঁচ ছ কিলোমিটার হওয়ায় বাসে আসতে চিন্টুর আধঘন্টার বেশি সময় লাগবেনা।

        “ চুল আর নখ কাটতে ভুলে যেওনা যেন চিন্টু নইলে আমার দরজা থেকেই ফিরে যেতে হবে তোমাকে।”

        “ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাডাম,” বলল চিন্টু একটু জোড় দিয়েই। বিহারের এক অজ পাড়াগাঁ থেকে বেরিয়ে এক মাসের জন্য হলেও বিশ হাজার টাকা রোজগারের আশায় ক্লাস এইট পাশ করা গনপতলাল মিশ্র ওরফে চিন্টু হাসি মুখে ঊঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নত মস্তকে প্রণাম জানাল ওর ভাবী অন্নদাত্রীকে। 

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন । 

২য় পর্ব পড়ুন আগামী বুধবার।

লেখক পরিচিতি

জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘ Hem And Football’ ফরাসি, জার্মান এবং নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। ইংরেজিতে দেশে ও বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাংলায় এ যাবৎ চারটি উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, নব কল্লোল, সাপ্তাহিক বর্তমান, পরিচয়, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষবাবু ।