Advt

Advt

duti-jiban-story-galpo-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-দু'টি-জীবন-গল্প-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

duti-jiban-story-galpo-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-দু'টি-জীবন-গল্প-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

মার  পিসি সকাল নটা বারো মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করলেন। বয়স হয়েছিল বাহাত্তর বছর কয়েক মাস। ডাক্তার বললেন,হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। শুনেই বাবা হাউমাউ করে কাঁদছেন। পিসির যে হার্টের সমস্যা ছিল আমরা কেউ জানতেই পারিনি। কেন পারিনি সেই আক্ষেপ সকলের। কারণ পিসি শুধু গুরুজন নয় আরও অনেক বেশি অন্তরের । আমরা তিন ভাই এক বোন পিসির কোলেপিঠেই বড় হয়েছি। জন্ম থেকেই পিসিই আমাদের সব। আমাদের মা সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতেন বেশি। পিসির জিম্মায় আমাদের ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। বায়না, আবদার, সবই পিসির কাছে। বাবার থেকে দু'বছরের বড় ছিলেন পিসিবাবাও পিসিকে খুব মান্য করতেন।

আমরা তখন বড় হয়ে কলেজ পাশ করে গেছি। বড়দা মেজদা বিয়ে করে ফেলেছেন। আমাদের সবাইকে একান্তে ডেকে বাবা একদিন বললেন," তোরা পিসিকে কখনো অশ্রদ্ধা করিস না। তোদেরকে জানপ্রাণ নিঃশেষ করে মানুষ করেছেন। তোদের মাও এতটা পারত কিনা সন্দেহ। সন্তানের থেকেও অধিক। বলতে গেলে তোরাই পিসির প্রাণ। সেই পিসিকে ভুলেও কখনো কষ্ট দিবি না। পিসির মনে একটা গভীর বেদনা লুকিয়ে আছে। তোদের কে পেয়ে অনেকটাই উপশম হয়েছে।

এসব আমরা জানি। বাবার বলে দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না। কারণ পিসিকে ছাড়া আমরাও থাকতে পারতাম না। বিয়ের পর পরই বউকে বলে দিয়েছিলাম, পিসিকে কিন্তু কখনো অমান্য করো না। উত্তরে বউ বলেছিল, কি বলছ তুমি? পিসির মতো এমন আন্তরিক ব্যবহার, দু'দিন মিশেই বুঝেছি,তিনি যেন কত কালের আপন। তাঁকে অমান্য করার প্রশ্ন আসছে কেন? আমার বৌদিদের কাছেও পিসি খুব প্রিয় মানুষ। আসলে পিসির মানিয়ে চলার ক্ষমতা অসীম।কখনও রাগ করতে দেখিনি। উচ্চস্বরে কথা বলতেও শুনিনি কোনওদিন। ঠান্ডা, শান্ত মানুষ। ছোটখাটো ত্রুটি সন্তান ভেবে এড়িয়ে যেতেন।

বাবা বলতেন, যারা শান্ত, সহন ক্ষমতা বেশি তাদের কষ্টটাও বেশি। বুকের ভেতর জমে পাহাড় সম হয়ে ওঠে। তাঁকে  আঘাত দিলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে প্রলয়ঙ্কর কান্ড ঘটে যেতে পারে। তখন বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়বে। পিসি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হতেন। ইংলিশে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছিলেন। ইচ্ছে ছিল চাকরি করার। একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে ফার্স্ট হয়েছিলেন। স্কুল কমিটির গড়িমসিতে নিয়োগ পত্র পেতে ছ'মাস দেরি হয়ে যায়। এর মধ্যেই দাদু এক পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেই বিয়েতে দাদু বহু অর্থ পণ দিয়েছিলেন। দাদু ভেবেছিলেন, মেয়ে চাকরি করা শুরু করলে হয়তো বিয়ে করতেই চাইবে না। সারাজীবন আইবুড়ো থাকাটা কি কোনও বাবা  মেনে নিতে পারে? আসলে পিসির গায়ের রং ছিল কালো।  দেখাশোনা করে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে এক পরিচিত ভদ্র ছেলেকে অনেক টাকা পণ দিয়ে রাজি করান। সেই পণের টাকা নিয়ে ছেলে ব্যবসা শুরু করল, দোতলা বাড়িও করল।

মানুষের বাইরেটা দেখে ভেতরের খবর অনুমান করা শক্ত। যদি না নিজে থেকে ব্যক্ত করে। পিসি যে অসুখী ছিলেন জানা যায় দাদু গত হওয়ার পর। বৃদ্ধ মানুষটা কষ্ট পাবেন বলেই পিসির এমন নীরবতা। এমনিতে শশুর বাড়ির কেউ কটু কথা বলা বা অত্যাচার করা তেমন কোনও ঘটনা নয়। এর চেয়েও গভীর কোনও ঘটনা আছে যা আমরা কেন, মাও ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি। একমাত্র বাবার সঙ্গেই পিসি আলোচনা করে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন।

বাবা পিসিকে বলেছিলেন," তোমার নীরবে মেনে নেওয়া ঠিক হয়নি দিদি। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। ।সে হক তোমার আছে। তোমার অর্থে দোতলা বাড়ি, ব্যবসা সব ফোকটে করল,তারপরেও এমন প্রতারণা।  বোঝাই যাচ্ছে শুধু টাকার লোভেই বিয়েটা করেছে।এসব মানুষকে প্রতারক ছাড়া কিছু বলা যায় না।  তুমি রাজি থাকো তো পণের টাকা আদায় করে আনতে পারি। প্রয়োজনে তার নামে মামলা করতে পারি। বেইমান নিমকহারামদের এইভাবে প্রশ্রয় দিও না।

একদিন সন্ধ্যে নাগাদ পিসেমসাই পিসিকে নিয়ে এলেন আমাদের বাড়িতে। সবই শোনা কথা। আমার তখন জন্মই হয় নি।  পিসি মাকে বললেন, বাড়িতে জামাই এসেছে, একটু জলমিষ্টি দাও। উনি এক্ষুনি চলে যাবেন। বাবা বলেছিলেন,অত কিছুর দরকার নেই। চা বিস্কিট দিয়ে বিদায় দিয়ে দাও।
পিসি বললেন," এটা কি বলছিস ভাই? শত হলেও উনি এই বাড়ির জামাই। অভদ্রতা কেন করবে?"

আসলে এর মধ্যেও এক গভীর সংবেদনশীল ব্যাপার আছে। পিসি পিশেমশাইকে নাকি খুব ভালবাসতেন।  এর পরে আর কোনও কথা চলে না।ভালবাসার কাছে কোনও ব্যাখ্যাই চলে না। তবু বাবা মানতে পারেন নি। সবটাই কেন এক পক্ষ? মানা যায়? সাত পাকে বাধা হয়ে সিঁদুর দানের পরেও  স্ত্রী কেন বাপের বাড়িতে জীবন কাটাবে? একটু বড় হয়ে পিসিকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। প্রতিবারই এড়িয়ে গেছেন। বেশি বললে দুঃখ পাবেন বলে বিরত থেকেছি।

দাদু গত হওয়ার তিন মাস পর এক রাতে পিসি  পিসেমসাইয়ের ঘরে গিয়ে বললেন," আপনার সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। "

" কি কথা বলো?"

"আমি এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসেছি, তা প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝেছি, আপনি আমাকে একমাত্র অর্থের জন্য বিয়ে করেছেন। আমাকে স্ত্রী বলে মেনে নিতে সম্মানে বাঁধছে।ফলে প্রথম থেকেই দুজনে আলাদা ঘরে থাকি। বিবাহিত জীবন বলেও কিছু নেই। লোক সমাজে আমাকে নিয়ে বের হতেও চান না। দু'বার বন্ধুদের নিয়ে ফ্যামিলি পিকনিক করলেন। সকলের স্ত্রীরা উপিস্থিত ছিল একমাত্র আপনার স্ত্রী বাদে। এরপর কি মনে হয়? আমার কি এই বাড়িতে আর থাকা উচিত?"
" তুমি কি বলছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে তোমার? মা কি কিছু বলেছে?"

" মা কি বলবে? উনি তো আমাকে যথেষ্ট ভালবাসেন। শুধু কি মায়ের আদর খেতে এ বাড়ি এসেছি? আপনাকে অনুরোধ করছি, কাল সকালে আমাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবেন। আমি আর কোনওদিন ফিরব না। আপনাকেও  আমি মুক্তি দিয়ে গেলাম।"

"একী বলছ তুমি? আমরা অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করেছি। এমনটা করতে পার না।আমাকে ভুল বুঝো না। তুমি যা ভাবছ তা নয়। "

" আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। কাল সকালে আমাকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দেবেন। যদি না পারেন আমি একাই চলে যাব।"

সেই যে বাড়ি থেকে চলে এসেছেন। আর ফিরে যান নি। পিসেমসাইও আসেন নি। আশ্চর্য ! পিসেমসাই পুনরায় বিয়েও করেন নি। কেমন রহস্যময় জীবন। পিসিমাও এয়োস্ত্রীর মত সারাজীবন শাখা সিঁদুর পরে থাকলেন। দু'টি জীবন কেন এমন হল?

বাবা বললেন," তোর পিসেমশাইকে ফোনে মৃত্যুর খবরটা জানিয়ে দে। আসে ভাল। না এলেও কোনও অনুযোগ করতে পারবে না।"

প্রথমটা অবাক হয়েছিলাম। পিসেমশাইকে জানানোর কী দরকার? যে লোকটা পিসিকে বাপের বাড়ি রেখে যাওয়ার পর একবার খবর নিতেও আসেনি তার প্রতি এত দরদ কেন?  পরে খেয়াল হল, কয়েক বছর আগে মায়ের কাছে শুনেছিলাম, পিসেমশাই নাকি পিসিকে খুবই ভাল বাসেন। কিন্তু কতগুলো দরজার কপাট খোলার ক্ষমতা হয় নি বলে প্রবেশ করতে পারেন নি। পণ নিয়ে বিয়ে করার জন্য কেউ কেউ কাপুরুষ বলে অপমান করেছিলেন। তখনই নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, "যতদিন পর্যন্ত পণের টাকা ফিরিয়ে দিতে না পারি ততদিন স্ত্রীকে স্পর্শ করব না।"  এমন ছেলেমানুষির কি মানে জানি না। জীবন কী এতই সহজ! চাইলেই কী ছেলে খেলা করা যায়?

বেলা বারোটার নাগাদ পিসেমশাই হন্তদন্ত হয়ে এলেন। বয়সের ভারে একটু কাবু হয়ে গেছেন। বয়স তো কম হল না, বোধহয় আটাত্তর চলছে। শুনেছিলাম, পিসির থেকে পাঁচ বছরের বড়। এসেই পণ ভঙ্গ করলেন। পিসির ওপর হামলে পড়ে পিসিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। আমরা নির্বাক ! অপলক দেখছি মানুষটাকে।

লেখক পরিচিতি -

নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশশিলাদিত্যকালি ও কলম,মাতৃশক্তিতথ্যকেন্দ্রকলেজস্ট্রিটকথাসাহিত্যদৈনিক স্টেটসম্যানযুগশঙ্খএকদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।