দয়াল বাবুর মনটা হঠাৎ খুব ভালো
হয়ে গেল। মনের গভীর থেকে এত আনন্দ অনেকদিন উপভোগ করেন নি। অটো করে মেয়ের বাড়ি থেকে
ফিরছেন। হুগলির আলীনগরে মেয়ের বাড়ি। তিনি থাকেন চুঁচুড়ার খাদিনামোড়ে। অটোতে উঠতে
গিয়ে দেখলেন,অটোওয়ালা ছেলেটি এক থুড়থুড়ে বুড়িকে একশো টাকা ভিক্ষে দিল।
দয়াল বাবু বললেন,"সেকী?
তুমি একশো টাকা দিয়ে দিলে?"
"দেখছেন না বাবু, বুড়িটা
বয়সের ভারে হাঁটতেও পারছে না। হয়তো গিয়ে দেখুন, ছেলে বৌমা থাকতেও দু'মুঠো খেতে দেয়
না। বাধ্য হয়ে পথে নেমেছে। এমন কতজনকে দেখলাম।মানুষতো নয়। এক একটা রত্ন।"
এইসব ছেলেদের এমন আদিখ্যেতা
দেখলে গা কিড়মিড় করে। পয়সার মূল্য কোনোদিনই বুঝবে না এরা। যাক গে। টাকা আছে,
দিয়েছে। দয়ালবাবুর বলার কি আছে। এমন একটা ভালো দিনে মন খারাপ করার কোনও মানে হয়
না। ভাদ্র মাস। আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টির কোনও লক্ষণ নেই। তেমনি সূর্যদেবও উধাও। উল্টে ফুরফুরে হাওয়া বইছে
চারিদিকে। বঙ্গোপসাগরে নাকি নিন্মচাপ। দু'তিন দিনের মধ্যে তুমুল বৃষ্টিপাতের
পূর্বাভাস। হোক বৃষ্টি। ভাদ্র মাসে প্যাচপ্যাচে গরমের পরিবর্তে এমন মনোরম আবহাওয়া
কদাচিৎ দেখা যায়।অবশ্য মনের উৎফুল্ল ভাব শুধু সে কারণে নয়। মেয়ের বাড়ির পরিবেশ
দেখেই তিনি বিগলিত। জামাই বাবাজি যে এত দ্রুত ব্যবসার ভোল পাল্টে দেবে নিজে চোখে
না দেখলে বিশ্বাস করতেও পারতেন না। একটা লোহা লক্করের দোকান আর বিঘে দশেক ধান জমি
মেয়ে-জামাইয়ের নামে লিখে দিয়েছিলেন তিনি। তা যে পাঁচ বছরে দশ গুণ বাড়াতে পারে তার
ক্যারামতির তারিফ না করে কী পারা যায়? এতো দেখছে তার থেকেও বড় ওস্তাদ।না না, শুধু
শুধু আন্ডার এস্টিমেট করেছিল এতদিন। উপযুক্ত জামাই হয়েছে।
দয়াল সামন্ত। বয়স
পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন। হাইট পাঁচ ফুটেরও কম।হলে কি হবে, বেটে-খাটো মানুষটা বিশাল
অর্থের মালিক। একাধিক চাল কল, তেল কল, বড় অ্যালুমিনিয়ামের কারখানা, লোহা লক্করের
দোকান, চালের আড়ৎ ছাড়াও বহু জমির মালিক। পৈত্রিক সূত্রে কিছু প্রাপ্তি ঘটলেও নিজের
তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও পরিশ্রমের ফলেই কয়েক গুণ সম্পত্তি বাড়াতে পেরেছেন তিনি। কারবারে
তাকে টেক্কা দিতে পারে এমন কেউ পৃথিবীতে
আছে কিনা সন্দেহ ছিল তার। ফলে মনে মনে গর্ব বোধ করতেন। আজ জামাইয়ের কৃতিত্ব
দেখে হার মেনেও মনের ভিতর খুশির জোয়ার। তাঁর এই বিশাল সম্পত্তি যে অক্ষুন্ন রাখবে
সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। দয়াল সামন্তর একটি মাত্র মেয়ে। তার স্থাবর-অস্থাবর,
বিষয়-সম্পত্তি যা আছে সবই তো ওই মেয়েই পাবে। কিন্তু মেয়ে এক কান্ড করে বসল। তাতেই
দয়াল সামন্তর মন গেল বিগড়ে। একমাত্র আদরের মেয়ে
নিজের পছন্দের ছেলেকে তার অমতে বিয়ে করে ফেলল। তার কোনও কথাই শুনল না
মেয়েটি। এটাই তার বড় দুঃখ।ছেলেটি এম.কম পাশ হলে কি হবে, কাঠ বেকার। কোনও বাবা কি
বেকার ছেলেকে মেনে নিতে পারে? কিছুদিন মেয়ের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেন নি। শুনেছে
রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে বিয়েটা সেরেছে। সেই থেকে বলতেন,
আমার কোনও মেয়ে নেই। ছিল না কোনওদিন। মুখে বললে কী হবে? ভেতরে ভেতরে যে গুমড়ে
মরছেন সে খবর একমাত্র অন্তর্যামীই জানে। ওদিকে আবার স্ত্রী দিপালির দিনরাত
কান্নাকাটি। দু'মাসও কাটেনি।সস্ত্রীক মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি হাজির। মুখে বলেন স্ত্রীর
তাগদায় আসতে হল। এদিকে যে নিজেরও ঘুম উবে গেছে সে কথা বলে কে?
বেকার জামাই, দু'তিনটে টিউশনি
করে নাকি টিম টিম করে চালাচ্ছে। এসব কি সহ্য হয়? শেষকালে স্ত্রীর ঘ্যানঘেনাতিতে দশ
বিঘে জমি ও লোহা-লক্করের দোকানটা ওদের নামে লিখে দিল। জানে লেখাপড়া জানা বাবু
দু'দিনেই ফুঁটিয়ে দেবে। ব্যবসা কি সহজ কথা? শুধু বিদ্যে থাকলেই হয় না,এলেম লাগে।
একমাত্র স্ত্রী দিপালির কথা ফেলতে পারে নি। বউটাকে যে বড় ভালোবাসে দয়াল। তবু গা
কড়কড় করছিল। কম টাকার সম্পত্তি নয়। ক'রাত্রি ঘুমোতেও পারে নি। মেয়েটির উজ্জ্বল মুখ
দেখে কিছুটা স্বান্তনা।
দয়াল বাবু অটো ছেলেটাকে আবার
জিজ্ঞেস করলেন," আচ্ছা ভাই, তুমি সারাদিনে কত রোজগার করো? নির্দ্বিধায় একশো
টাকা দিয়ে দিলে, তাই জানতে ইচ্ছে করে।"
"ও,এই কথা? শুনুন,
বৃদ্ধাকে দেখে আমার স্বর্গত মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। এই বয়সেও পেটের সংস্থান
নিজেকে করতে হচ্ছে? তাছাড়া জানবেন গরিব দুঃখীদের সাহায্য করলে কখনও কম পড়ে না।
দরকার হলে সংসারের বাজার কিছুটা কম করবো, তবু তো একজনের পাশে দাঁড়াতে পারলাম। এটাই
আমার আনন্দ।"
"ও, তাহলে পূণ্যির কথা
ভেবে দুম করে একশো টাকা দিয়ে দিলে, নাকি?"
"পাপ পুণ্যির কথা ভাবি না
বাবু। নিজের বিবেকে লাগল, তাই দিলাম, ব্যাস।"
কথা শুনে দয়াল বাবু কিন্তু সন্তুষ্ট হলেন
না। বড় বড় বাত। এই জীবনে তো কম দেখলেন না !
লোকে বলে দয়াল সামন্তর পয়সা
থাকলে কি হবে, হাড় কিপ্টে। পাড়ার কোনও অনুষ্ঠানে চাঁদা দেবেন, পাঁচ টাকা, বড়জোর দশ
টাকা। কিছু না দিতে হলেই মনে শান্তি পান। এই যেমন দু'মাস পরে মেয়ে-জামাইকে
নেমন্ত্রন করে আনলেন। জাঁকজমক করে একটা অনুষ্ঠান করা উচিত ছিল না কি? বিয়ে দিতে
গেলে কি কম খরচ হতো? তার অন্তত সিকি ভাগ করলেও মান থাকে। কিছুতেই রাজি হলেন না।
এদিকে তিনি আবার নিজেকে কৃপণ মনে করেন না। অযথা অর্থব্যয় অন্যায়। অপব্যয় কেন
করবেন? এই তো বেশ আছি।
বেশ ছিলেন। মাস ছয়েক আগে বউটা
মরে গিয়ে সব উলটপালট হয়ে গেল। নিত্য দিনের রুটিনের দফা রফা। ক্ষণে ক্ষণে স্ত্রীর
কথা মনে পড়ে। সকাল হলেই চা জল নিয়ে বিছানা থেকে ডেকে তুলতেন তাকে। খাওয়া-দাওয়াটা
রুটিন মত করাতেন। আরও কত কথা ভেবে ভেবে মন বিষন্ন। লোকে বলে ভেলোর বা ব্যাঙ্গালোর
নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালে ভালো হয়ে যেত। নিদেন পক্ষে কলকাতায় নিয়ে স্পেশালিস্ট
দেখানো উচিত ছিল। আসলে দয়াল সামন্ত বুঝতে পারেন নি, দীপালি তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে
যাবে। না হলে কী নিয়ে যেতেন না? একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে তার যে কি হাল হয়েছে
হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
আজ মেয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে এসে মন
খুব উৎফুল্ল। চুঁচুড়া স্টেশন পেরিয়ে এসেছেন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে
যাবেন। অটোর ছেলেটি খুব ভালো। বাম্পার খানা-খন্দ বাঁচিয়ে সুন্দর নিয়ে এসেছে। নেমেই
অটোওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন," কত ভাড়া দেব?"
অটোওয়ালা বলল," একশো
টাকা।"
দয়াল খুশি মনে তাকে দুশো টাকা
দিল, " এই নে, তোকে দুশো টাকা দিলাম।"
"না বাবু। যা ভাড়া তার
বেশি নিতে পারবো না। আপনি একশো টাকা দিন।"
"আরে তোকে একশো টাকা বকশিশ
দিলাম। খুশি হয়ে দিলাম। রাখ টাকাটা।"
"না বাবু, লোভ বাড়াবেন না।
যা প্রাপ্য তাই নেব। কমও নেবনা বেশিও নেব না। খেটে কাজ করি। দিব্যি ভালো আছি, বউ
বাচ্চা নিয়ে সুখে আছি।"
দয়াল স্তম্ভিত ! সামান্য একটা
অটোওয়ালার এত বড় বড় কথা ! জীবনে এই প্রথম খুশি হয়ে একজনকে বকশিশ দিতে গেল, মুখের
উপর প্রত্যাখ্যান করল ! রীতিমত অপমানিত বোধ করলেন তিনি। আবার বলে কিনা, দিব্যি
ভালো আছি ! দয়ালের মাথা কাজ করছে না। এটা কোথায়? কোন দেশে বাস করছেন তিনি? যেখানে
চারিদিকে এত লোভী মানুষের ভিড়, সেখানে এমন মানুষও আছে? তাও সামান্য এক অটোওয়ালা!
তিনি কিছুটা বিভ্রান্ত । বাড়ি ফিরেও কাজের তদারকি করতে গেলেন না। বিছানায় শুয়ে
এপাস-ওপাশ করতে লাগলেন। খিদে অবশ্য নেই। মেয়ের বাড়ি থেকে পেট পুরে খেয়ে এসেছেন।
কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। অটোওয়ালাটা মুখের উপর এত বড় কথা বলতে পারল?
রাতেও ঘুম এল না। ভাবনাটা
কিছুতেই যাচ্ছে না। রাত তখন তিনটে।বিছানা থেকে নেমে এলেন। ডাইনিংয়ে বসে একটা বিড়ি
ধরালেন। বিড়িতেই অভ্যস্ত। সিগারেটে নাকি ঠিক নেশা হয় না। নিন্দুকেরা বলে, পয়সা
বাঁচানোর জন্য সিগারেট থেকে দূরে থাকেন। একটা শেষ করে আরেকটা বিড়ি ধরালেন। ভাবছেন,
এই যে এত বিষয় সম্পত্তি বাড়ানোর নেশায় যেভাবে মেতে উঠেছেন, এতে লাভ কি? কী হবে এত
সম্পত্তি দিয়ে? সামান্য রোজগার করে ছেলেটা যদি সুখে থাকতে পারে তিনি কেন পারবেন
না? বহু অর্থের মালিক হলেও তিনিও সাধারণ জীবন যাপনেই অভ্যস্ত। আমোদপ্রমোদ,
বিলাসবাসনার পক্ষপাতী তিনি নন। থম মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপরেই সিদ্ধান্তটা
নিয়ে ফেললেন। তিনি অনায়েসেই কিছু অর্থ ভালো কাজে ব্যয় করতে পারেন। অনাথ আশ্রমে
সাহায্য করতে পারেন। গরিব মেধাবী দুস্থ ছাত্র-ছাত্রীদেরও ....আরও আরও জনকল্যাণমূলক
কিছু করবেন। কি কি করা যায় ম্যানেজারের সঙ্গে পরামর্শ করে দায়িত্ব দিতে হবে।.....
মনটা যেন থিতু হল। মনের গভীরে আনন্দের ঝিলিক। শরীর হালকা। অস্বস্তি ভাব উধাও। এবার
বোধহয় ঘুমটা হবে।
লেখক পরিচিতি -
নিত্যরঞ্জন দেবনাথ পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ার পানুহাটে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।কাটোয়া কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক। বর্তমানে থাকেন হুগলির চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল-এর অধীন ডিভিশনাল অ্যাকাউন্টস অফিসার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম গল্প " চেতনা " ছোটদের পত্রিকা শুকতারায় ১৯৯৬ - এর এপ্রিলে প্রকাশিত হয়। এরপর দেশ, শিলাদিত্য, কালি ও কলম,মাতৃশক্তি, তথ্যকেন্দ্র, কলেজস্ট্রিট, কথাসাহিত্য, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,,সুখবর ইত্যাদি এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত তাঁর সাহিত্যকীর্তি অব্যাহত। ইতিমধ্যে পাঁচটি গল্প সংকলন ও চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক "শতানীক " পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন।