Advt

Advt

thale-badal-story-galpo-by-ananta-krishna-dey-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-থলে-বদল-গল্প-অনন্ত-কৃষ্ণ-দে

thale-badal-story-galpo-by-ananta-krishna-dey-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-থলে-বদল-গল্প-অনন্ত-কৃষ্ণ-দে

 

শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে নেতাজির ঘোড়ার ঠিক ল্যাজের দিকে ঘুরে  বাসটা  খানিকটা যেন ঢেঁকুর তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল পিছনে লাঠি উঁচিয়ে একজন সিভিক ভলান্টিয়ারআগে বাড়ো, আগে বাড়োকরতে করতে বাসের গায়ে তার হাতের অস্ত্র খেটো লাঠি দিয়ে দু-চার ঘা কষিয়ে দিল কন্ডাক্টটার আর ড্রাইভার এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না চেনা দৃশ্য জো হোগা দেখা যায়েগা! আজ শ্রম দিবস গাড়ির সংখ্যা কম বাস স্ট্যান্ডে অনেকক্ষণ ধরে লোকে অপেক্ষা করছে বেশ ভিড় জমে গেছে হইহই করে প্রায় অনেকেই বাসে উঠে পড়লেন সবারই একটা নিশ্চিত বসার জায়গা চাই 

নিরাপদ বাবু সাধারণত ভিড় ভাট্টা এড়িয়ে চলেন কিন্তু আজকে ব্যাপার ভিন্ন বাস কম আবার কখন আসবে কে জানে! তিনিও হাতের থলে  সামলে বাসে উঠতে গেলেন পা দানিতে একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে এক ভদ্রলোক তাকে পেছন থেকে ডজ করার চেষ্টা করছে নিরাপদ বাবু পরিস্কার দেখতে পেলেন ড্রাইভারের পিছন দিকের সিটটা ফাঁকা ঠেলে ঠেলে হয়ে যাবে পেছনের লোকটাও ধাক্কা মারছে নিরাপদ বাবু পারছেননা ডানদিকের হাঁটুটা বেশ কয়েকদিন ধরে ভোগাচ্ছে পেছনের দুজন তাড়া লাগাচ্ছে মহিলা হাতের ব্যাগ দিয়ে খোঁচা মারছেন আর ভদ্রলোকটি পিঠে হাত দিয়ে ঠেলা মারছেন পা-দানির তিনজনের জন্যই পরের ঘটনাটা সুখপ্রদ হল না সিভিক ভলান্টিয়ারের তাড়া খেয়ে  কন্ডাক্টটার  ব্যাটা উঠুন, উঠুনকরে প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে বাসের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল ড্রাইভার গিয়ারে হাত চালিয়ে গাড়ি বাড়িয়ে দিল নিরাপদ বাবু একজন বাস যাত্রীর পা মাড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা”- মত একটা সিটে বসে হাঁপাতে লাগলেন হাত থেকে বাজারের থলেটা পড়ে গেছে সামনে তাকিয়ে দেখলেন নিরাপদ বাবু না, তার ব্যাগ নিরাপদেই আছে থলেটা শ্যামবাজারের একটা নামজাদা শাড়ির দোকানের পুরনো হলেও বাজারের ব্যাগ হিসাবে ভাল নতুন অবস্থায় এটাকে ব্যাগ বলতেন এখন এর দর কমে গেছে কমার্স এর ভাষায় মূল্যহ্রাস বা অবচয় হয়ে এটি এখন ব্যাগ থেকে থলে তিনি কোনমতে উপরের হাতল ধরে উঠলেন ভিড় কাটিয়ে লেডিস সিটের সামনে থেকে তার থলেটা নিতে হবে মাথায় দুগাছা চুল নিয়ে একটা লোক কট্কট্‌ করে তার দিকে দেখছে নিরাপদবাবুর মনে হল, এ নির্ঘাত তার পিঠে ঠেলা মারা লোকটা বসতে না পেরে রেগে আগুন তিনি দুপা এগিয়ে নিচু হয়ে তার থলেটা নিতে গেলেন অমনি একটা মেয়েলি হাত তার হাত চেপে ধরেছেন একটূ আগে এই মহিলাই তার পেছনে ব্যাগ দিয়ে গোত্তা দিয়েছেঅসভ্য কোথাকার!””কে কাকে অসভ্য বলছে মশাই, আপনি আমার ব্যাগে হাত দিচ্ছেনভদ্রমহিলা একেবারে রনংদেহী এতক্ষণে একগাছা চুলের অধিকারীটি ঘোঁত ঘোঁত করে এগিয়ে এসেছেকি হল,মনিকা“ “আরে, ইনি আমাদের ব্যাগে হাত দিচ্ছেন“ “কি ব্যাপার মশাই,মাথা খারাপ নাকি? এই কন্ডাক্টটারসে পেছনের দিকে টিকিট কাটতে ব্যস্তআসছি, আসছিবলে সে চেপে গেল এবার মুখ খুলেছেন অন্য লোক, “নিজের ব্যাগ ছেড়ে অন্যের ব্যাগে  হাত কেন দাদু!” নিরাপদ বাবু দেখলেন এরই পা মাড়িয়েছেন খানিক আগে উনি তার ঝাল ঝাড়ছেন তা বলে দাদু! তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলেন কিন্তু আমার থলেটা একই রকম দেখতে

দূর মশাই, একইরকম থলে তো কতই থাকেখ্যাক করে উঠেছেন একগাছা চুলের মানুষটি কন্ডাক্টটারটি এবার এদিকে এসেছে,

কি মশাই এত গোল কিসের“ “দেখুন না, আমার থলে………নিরাপদ বাবু সংক্ষেপে তার থলে মিসিং এর ডায়েরি করলেন সব শুনে এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই ভদ্রমহিলার সিটের তলায় একইরকম একটা থলে  হাত দিয়ে টেনে বার করল কন্ডাক্টটারএটা কার এটানিরাপদ বাবু প্রায় ঝাপিয়ে পড়েছেন, “এটা আমারকন্ডাক্টটার লোকটি ভাল থলেটা নিরাপদ বাবুর সিটের তলায় রেখে একটা ছোট্টো করে বানী ছেড়ে দিল,“নিজের মাল নিজের কাছে রাখতে শিখুন শুধু শুধু বাসে খিচাইন করবেন না টিকিট! টিকিট!” নিরাপদ বাবু টিকিট কেটে জানলার দিকে তাকালেন শুধু শুধু হেনস্তা বয়স হয়েছে এইসব এখন আর মানতে পারেন না তার নিজের যদি একটা সন্তান থাকত তাহলে সেই সংসারের অনেক কাজের দায়িত্ব নিত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন নিরাপদ বাবু মনটা খুব ভারী হয়ে গেল তার  

দমদম বিমানবন্দরের এক নং গেটের কাছে একটা আড়াই কামরার এক তলা বাড়িতে থাকেন নিরাপদ বাবু জীবনের অনেকটা বসন্ত পার করে এই চল্লিশ বছর বয়সেও তিনি অকৃতদার মা-বাবার শিবরাত্রির সলতে ছিলেন তিনি কিন্তু তারা দুজনেই অকালে সলতে জ্বালিয়ে কেটে পড়েছে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলে নিজের চেষ্টায় একটা অফিসে হিসাব নিকাশের চাকরি করেন কিন্তু নিজের জীবনের হিসেব ঠিক কষতে পারেননি একদিন আকস্মিক ভাবে বসন্তের দখিনা হাওয়ায় সেই খাতা খুলে গেল অফিসের বন্ধুর বাড়িতে এসে তার বোন জপমালা কে দেখে প্রেমে পড়লেন নিরাপদ বন্ধুও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল তার অভাবের সংসারে গলার কাঁটা এই জপমালা বেশি দেরী করল না নিরাপদ একদিন বিনা আড়ম্বরে এই জপমালা কে গলায় ধারন করল সে দাম্পত্য জীবন ভালই কাটছিল কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সমাননুপাতে মেজাজ বাড়তে থাকে জপমালার ইয়ার বন্ধুদের মধ্যে প্রদীপ শখের জ্যোতিষী সে নিদান দিল, “ও মেয়ের নির্ঘাত কৃমি আছে তুই বগলা মাতার যজ্ঞ করএই যজ্ঞের আনুমানিক খরচের একটা হিসাবও দিয়েছিল প্রদীপ বাড়িতে জপমালাকে বলেছিল নিরাপদ সে তৎক্ষণাৎ দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে বগলা যজ্ঞ প্যাকে পাঠিয়েছিল সেই থেকে জপমালা কে সমঝে চলে নিরাপদ অনেক কসরতের পরও যখন সন্তান সম্ভবা হল না জপমালা তখন সে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিল কিন্তু নিরাপদ সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে তার মতে এর ফলে একে অপরের দিকে আঙ্গুল তুলবে সংসারে অশান্তি দানা বাঁধতে থাকবে মা ষষ্টি যখন কৃপা করেননি তখন কি দরকার! বন্ধুরা সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা বলেছে কিন্তু বাধ সেধেছে জপমালাকার না কার পাপ মাথায় তুলব!” অতএব সে গুড়েও বালি তাই আজ জীবনের শেষলগ্নে এসে প্রায়শই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন একে অপরের কথা ভেবে চিন্তিত হন

জপমালা দেবী কোনোদিনই সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠার বাঁদি নন বিয়ের আগে যখন দাদার বাড়িতে থাকতেন তখনও বৌদির অনেক মুখঝামটা খেতে হয়েছে তাকে শুনিয়ে তার নামে অনেক বিশেষন প্রয়োগ করেছে সে দাদার কাছে কিন্তু দাদা কোনোদিন কিছু বলে নি সেইজন্য তার উপর রাগ আরো বেশি ছিল বৌদির এখানে অবশ্য তা নয় এই মানুষটা তাকে বিছানায় চা দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডেকে তোলে একতলা বাড়ি জানলা খুললে সেরকম আকাশ দেখা যায় না তবুও বিছানায় বসে এই সময়টা খুব উপভোগ করেন জপমালা রাস্তা দিয়ে কত লোক নানারকম স্ব স্ব ভঙ্গিমায় হেঁটে চলে আর আছে ফেরিওয়ালাদের ডাক করোনার পর থেকে মাছ, সবজি সব ঘরে বসেই পাওয়া যায় বাজারে যেতে হয় না বাজারের কথা মনে আসতে টনক নড়ল জপমালার কাল রাতে নিরাপদ শ্যামবাজার থেকে ফল এনেছেন থলেতেই রয়েছে স্নান করে ঠাকুরের জন্য রেখে ফলগুলি ফ্রিজে তুলে রাখতে হবে যা গরম পড়েছে! বিছানা ছাড়লেন জপমালা

বাজারের থলেটা ভাঁড়ার ঘরের এক কোনায় রাখা আছে স্নান করে মাটিতে বসলেন জপমালা দেবী আজকাল হাঁটুর জোর কমে আসছে মাটিতে বসতে অসুবিধা হয় বেশিক্ষন বসতেও পারেন না থলেটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কিরকম যেন বোধ হল হাতে ধুলো লাগছে একটা ফল বার করে দেখলেন জপমালা কিন্তু একি! কিউয়ি ফল এ তো বেশ দামী কি দরকার ছিল দামী ফল আনার কর্তার উপর বেজায় চটেছেন জপমালা দেবী এই মাগ্যি গন্ডার বাজারে কতবার বলেছেন টাকা পয়সা সঞ্চয় করতে বয়সকালে চিকিৎসা কে করবে! এসব ভাবলেই মনটা হু হু করে ওঠে চোখে জল চলে আসে একটা পুষ্যি নেওয়ার কথা কতবার বলেছেন কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেন নি ওই অবাধ্য লোকটাকে যাই হোক, সময় যাচ্ছে, এখন এসব কথা ভাবলে চলবে না বাজারের থলেটা উপুড়  করলেন তিনি কিন্তু একি! পরম বিস্ময়ে জপমালা দেবী দেখলেন, আলু, পেয়াজ, টমেটো সব মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল দুটো  টমেটো আবার আলমারির ভিতর গিয়ে লুকিয়ে পড়ল একটূ আগে দেখা কিউয়ি ফলটা দেখলেন ওমা এতো আলু! প্রেসার বেড়ে গেছে জপমালা দেবীর সাতসকালে একি অনাসৃস্টি এ তো রীতিমতো মাংসের বাজার আলু, পেয়াজ, টমেটো তিনি দিল্লী চলো-র কায়দায় হুঙ্কার দিলেন,“ওগো শুনছো

শোনার লোক ঘরেই মজুত ছিল এই প্রচন্ড গরমে তিনি লুঙ্গি পড়ে পাখার তলায় বসে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাঙ তুলে আজকের খবরের কাগজ পড়ছিলেন জপমালার গর্জনে কাগজ রেখে ভাঁড়ার ঘরে এসে আলু, পেঁয়াজ দেখে গিন্নি কে জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব কি!” ওপাশ থেকে আরো গলা চড়িয়ে উত্তর এল, “ আমিও তো তাই জিজ্ঞাসা করছিনিরাপদ বাবু জপমালা দেবীর দিকে তাকালেন বেশ রেগে গেছেন তিনি চোখের ভাষা বদলে গেছে কেমন যেন ভাটার মত তার দিকে তাকাচ্ছে তিনি বুঝতে পারলেন না শুধু নিম্নস্বরে বললেন, “এগুলো কে আনল

-“আমার বাবা!” কট্কট্‌ করে তাকিয়ে উত্তর করলেন জপমালা ঘরের গরম হাওয়াকে একটু লঘু করার চেষ্টা করলেন নিরাপদ হালদার, “ধ্যাৎ, সে তো কবে উপরে চলে গেছে

আর দেখতে হল না, একটা আলু তার ঠিক পেছন দিকে এসে ধাক্কা মারল গতকাল এখানেই ভদ্রমহিলার ব্যাগের খোঁচা খেয়েছেন নিরাপদ স্নায়বিক আঘাত খেয়ে  তিনি আলু পেঁয়াজের রহস্য উদ্ঘাটন করলেন থলে বদল তার মানে বাসের সীটের নীচে রাখা থলেটা ছিল ওই মহিলার সে তো আসল থলেতেই হাত দিয়েছিল চোয়াল শক্ত হল নিরাপদ বাবুর কিন্তু এখন উপায়! উপায় বাৎলালেন জপমালা দেবী, “যাও এক্ষনি ফলের বাজারে গিয়ে ফল নিয়ে এস আমার পুজো আছেঅগত্য নীরবে ঘর ছাড়লেন নিরাপদ বাবু কিন্তু অতগুলো টাকার ফলের শোক ভুলতে পারছেন না আম, আপেল, তরমুজ তিনি বাজি রেখে বলতে পারেন এই আলু পেঁয়াজের দাম অনেক কম না, না আর নেওয়া যাচ্ছে না ওই এক গাছা চুলের টেকো লোকটার মুখ কল্পনা করেছুঁচোবলে গায়ের ঝাল মেটালেন তিনি

নিরাপদ হালদার এখন দমদম ফলের বাজারে কেনাকাটা করছেন বেছে বেছে সেরা ফল কিনছেন তিনি এছাড়া আজকে জপমালা দেবীর কাছে যাওয়া যাবে না আর হ্যাঁ, তিনিও থলে  বদল  করেছেন ওই ভদ্রমহিলারথলে টা আর সঙ্গে নেন নি নতুন থলেটাকেও হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছেন, বদল হওয়ার ভয়ে মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন যদি গতকালের দেখা ভদ্রমহিলার হাতে তার পুরোনো থলেটা দেখতে পান!  

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

-----------------------------------------------------------------------------------------

লেখক পরিচিতি  - 

জন্মঃ কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুলকলেজঅণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা   নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত। বর্তমানে দিল্লী ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। কলমের সাত রঙ পত্রিকার একজন সক্রিয় সদস্য।