রামমোহন রায় সকল ধর্মের মৌলিক ঐক্য হৃদয়ে উপলব্ধি
করেছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মের জটিল আচার-অনুষ্ঠান এবং পৌত্তলিক প্রতীকের বিরুদ্ধে
ছিলেন কারণ তিনি বেদ পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ভালোভাবেই
অবগত ছিলেন যে এই প্রতীকী আচার-অনুষ্ঠানগুলো মানুষকে জাতিভেদ ও দ্বন্দ্বের শিকার
করে তোলে। তাই তিনি নিরাকার একেশ্বরবাদ,সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের দীর্ঘ কর্মসূচি নিয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে
যান। এ কারণে রাজা রামমোহনকে 'নবযুগের প্রবর্তক' বলা হতো। তিনি ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামকান্ত রায় এবং মাতার নাম তারিণী দেবী। পিতা
রমাকান্ত ছিলেন সেই যুগের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এবং মাতা ছিলেন বুদ্ধমতি ধর্মশীলা
ও তেজস্বিনী মহিলা। রামমোহনের চরিত্রে মাতার চরিত্রের প্রভাব দেখা যায়।
গ্রাম্য পাঠশালায় শিক্ষার পর রামমোহন রায় আরবি ও ফারসি
শেখার জন্য পাটনায় যান। এ সময় তিনি ফারসি ভাষায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ
রচনা করেন। ফলস্বরূপ,তিনি তার বাবার সাথে মতবিরোধে জড়িয়ে
পড়েন এবং তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এই সময় তিনি কাশীতে
সংস্কৃত শিখেছিলেন। ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন।
তিনি ১৮০০ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় সেরেস্তাদারী হিসেবে কাজ করেন এবং ১৮১৪ সাল থেকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
কলকাতায় আসার পরই তার ভেতরের জমে থাকে আগুন জ্বলতে
শুরু হয়। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে তিনি বেদান্ত দর্শন অনুবাদ করেন এবং বেদান্তসার,সতীদাহ
নিবারণের উদ্দেশ্যে প্রবর্তক,নিবর্তকের সংবাদ প্রভৃতি বাংলা ও ইংরেজিতে ৮০টি গ্রন্থ রচনা
করেন। তাঁর রচনা ছিল প্রচারধর্মী। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসন্মত বাংলা ব্যাকরণ ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ রচনা করেন। ১৮২১ সালে
তিনি 'সংবাদ কৌমুদী' এবং 'ব্রাহ্মণিকাল ম্যাগাজিন'নামে
দুটি সংবাদপত্র সম্পাদনা শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি বাংলা গদ্য সাহিত্যের জনক। এসব
ম্যাগাজিনে ধর্মীয় সংস্কার,সমাজ সংস্কার
ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। সব
সময়ই বিভিন্ন ধর্ম জাজকদের মুখোশগুলো খুলে
দিতে চেষ্টা করেছেন। ১৮২৩ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড
আমহার্স্টকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করার জন্য চিঠি দেন। ১৮২৯ সালে দিল্লির রাজা দ্বিতীয় আকবর তাকে রাজা উপাধি দেন। তাঁর প্রচেষ্টাতেই
ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে দিল্লির রাজার বার্ষিক ভাতা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা সম্ভব হয়েছিল।
১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট অনুসারে শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অর্থ ইংরেজি শিক্ষায় ব্যয় করা হয়নি। ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টায় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এটি প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং হিন্দু স্কুল নামে দুটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ডেভিড হেয়ার এ ব্যাপারে রামমোহনের সাহায্য নেন। আলেকজান্ডার ডাফ এবং রামমোহন রায় যৌথভাবে জেনারেল অ্যাসেম্বলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে রামমোহন রায় শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা নেন।
সাম্যবাদের প্রতি রামমোহন রায়ের প্রবল সহানুভূতি ছিল। ১৮১৬
সালে তিনি 'আত্মীয় সভা' নামে একটি সভা
প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সভায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। তিনি ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর
উদ্দেশ্য ছিল অসাম্যের পরিবর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার ও
সাম্য প্রতিষ্ঠা। ব্রাহ্মসমাজের উপর রচিত ট্রাস্ট দলিল গণতন্ত্রের এক সোচ্চার ঘোষণা এবং একটি শক্তিশালী
পদক্ষেপ। সেই দলিলের অন্যান্য মন্ত্রগুলি ছিল দাতব্য,সেবা,নৈতিক চরিত্রের বিকাশ,দয়া,ঈশ্বর ভক্তি, পরের
উপকার করা, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সাথে বন্ধুত্ব ও
ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা। এই দলিলটি ৮ই
জানুয়ারী,১৮৩০ সালে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শকে রূপ দেওয়ার জন্য
স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
ব্রিটিশরা সতীদাহের মতো নৃশংস বিষয় সম্পর্কে অনেক আগে
থেকেই সচেতন ছিল। ১৮৪৩ সালে,কাশিমবাজার কুঠির সামনে ১৮ বছর বয়সী এক বিধবা সহমরণে যান। ব্রিটিশরা এই ঘটনার
প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। ১৮৪৫ সালে গভর্নর জেনারেলের
সেক্রেটারি বিধবাদের জোরপূর্বক দাহ করার বিপক্ষে বিধান জারি
করেন এবং ১৮৪৫ সালেই ভারত সরকার এ
ব্যাপারে সক্রিয় হয়। ১৮৪৭ সালে কিছু নিয়ম চালু করা হয়। রামমোহন রায় কলকাতায় আসার আগেই সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু
হয়। তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে এ বিষয়ে জনমত বাড়তে থাকে।
এই কুপ্রথার পক্ষে এবং বিপক্ষে জনমত খুবই
শক্তিশালী হতে থাকে। রামমোহন রায়ের 'কৌমুদী'এবং ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চন্দ্রিকা'সতীদাহ
প্রথার বিরুদ্ধে ও পক্ষে জনমত গঠনে প্রয়াসী হয়। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে
পড়েন। অবশেষে,১৮৪৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর,উইলিয়াম বেন্টিক রামমোহনের প্রচেষ্টায় সতীদাহ
প্রথার বিরুদ্ধে আদেশ পাস করেন। কলকাতার হিন্দুরা সতীদাহ পোড়ানো
বন্ধ করার জন্য খুবই উত্তেজিত হয়ে পরে। তারা বেন্টিকের কাছে
এই আইন বাতিলের আবেদন করেন। অন্যদিকে, রামমোহন রায় তার
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লর্ড বেন্টিকের কাছে মাত্র কয়েকজন বন্ধুর স্বাক্ষরিত একটি
অভিনন্দন পত্র পাঠান। সামাজিক চেতনার উত্থানের সাথে সাথে সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়ে
যায়।
রাজা
রামমোহন রায়ের সময়ে ভারতীয় সমাজে নারীদের
কোনো অধিকার ছিল না। রামমোহনই সর্বপ্রথম তাদের স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে নারীর
অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
রামমোহন রায়ের পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। প্রথমে তার
প্রচার হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত
হলে, এর কর্মকর্তারা তার সাথে কাজ করতে অস্বীকার করেন।
রামমোহন রায়কে তারা তাড়িয়ে দেন। ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার
জন্য তিনি একটি স্কুল খোলেন। ১৮২০ সালে তিনি যীশুর উপদেশাবলি
নামে একটি বই প্রকাশ করেন। ১৮২১সালে মিঃ উইলিয়াম অ্যাডাম তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং
অ্যাডাম খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করেন এবং মিঃ রামমোহনের একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ
করেন। ফলে তিনি হিন্দু ও খ্রিস্টান উভয়েরই শত্রুতে পরিণত হন। শ্রীরামপুরের
মিশনারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে শ্রীরামপুরে রামমোহন রায়ের বই ছাপানো বন্ধ
করে দেওয়া হয়। তিনি কলকাতার ধর্মতলায় একটি প্রেস খোলেন। সেখানে বই-পত্র
ছাপা শুরু করেন। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের
জন্যই একজন মিশনারিকে ধর্মান্তর করা সম্ভব হয়েছিল।
রামমোহন রায় সর্বদা ভারতের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা
বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। রামমোহন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
খর্ব করার জন্য আদম সাহেবের আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং তার আত্মসম্মান
রক্ষার জন্য তিনি সম্পাদিত পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন।
তখনকার সময়ে ভারতীয়দের ইউরোপে যাওয়াকে ভালচোখে
দেখা হতো না। অন্যায় বলে মনে করা হতো। কিন্তু রামমোহন রায়হ এসব
মতবাদে বিশ্বাস করতেন না। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-র দৌলতে তিনি
ব্রিটেনে যান। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তিনিই সম্ভবত
প্রথম বাঙালী যিনি দিল্লি পৌঁছেছিলেন। গোঁড়া হিন্দুরা তাকে আগেই
ধর্মত্যাগী বলেছিলেন। এরপর তাঁকে সমাজ
থেকে বিতারিত করার কথা ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু গোঁড়া হিন্দুদের এসব বিরোধিতা রামমোহনের মনে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি।
১৮৩০ সালে, রামমোহন রায় ডাফ সাহেবের উপর জেনারেল
অ্যাসেম্বলি কলেজের উন্নয়নের দায়িত্ব দিয়ে বিলেত যান।
তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশে যান। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় ফ্রান্সে থাকতেন।
কারণ ফরাসি বিপ্লব তাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিলেতে রামমোহন রায়কে
ইউনিটেরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সম্বর্ধনা দেন।
২৭শে সেপ্টেম্বর,১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে, এই ক্ষণজন্মা মনীষী ৬৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের
ব্রিস্টল শহরে অমৃতলোকে যাত্রা করেন। তাকে ব্রিস্টলের স্টেপলটন
গ্রোভে সমাহিত করা হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ
দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রিস্টলে গিয়ে রাজা রামমোহন রায়ের পবিত্র
দেহটি সেখান থেকে সরিয়ে 'আর্নোজভেল'
নামক স্থানে সমাহিত করেন।
মনীষী ব্রজেন্দ্রনাথের ভাষায়, রামমোহন ছিলেন 'ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণ'। তার মৃত্যুর পর ব্রাহ্মধর্ম
প্রবল আকার ধারণ করে। ব্রাহ্মধর্মের অস্তিত্ব
ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হলেও হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব রক্ষায় এই ধর্মের অবদানই যথেষ্ট পরিমাণে
ছিল । রামমোহন সর্বপ্রথম এই ব্রাহ্মসমাজ সৃষ্টি করেন।
পরাধীনতার মধ্যে জীবনযাপনের ফলে হতাশা,দারিদ্র্য ও নৈরাজ্য বাংলার মানুষের মনের আস্থা, সাহস ও বিশ্বাসকে নষ্ট করে ফেলেছিল। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কারণে মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। সেই সময়েই
আমাদের বাংলার রামমোহনের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন সেই যুগে
জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস এবং পরবর্তীতে তাঁর প্রতিভা,
বীরত্ব, ত্যাগ, নিষ্ঠা,
আত্মবিশ্বাস ও পাণ্ডিত্যর জন্যই বাংলার
মানুষ আবার মনের জোর, সাহস ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, দৈনিক বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), সন্দেশ, প্রসাদ, ছোটদের প্রসাদ, কলেজস্ট্রীট, উল্টোরথ, তথ্যকেন্দ্র, জাগ্রত বিবেক (দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির থেকে প্রকাশিত) , স্টেটসম্যান , কিশোর বার্তা অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ৬ টি এবং প্রকাশের পথে ২টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান, সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে 'আজীবন সম্মাননা' লাভ করেন। এ ছাড়া আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত 'কলমের সাত রঙ' ও www.tatkhanik.com এর সম্পাদক এবং দিল্লিতে প্রতিমাসে একটি সাহিত্য সভা পরিচালনা করেন।