রবীন্দ্রনাথকে যে তাঁর জীবনচরিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না একথা কবি স্বয়ং কতবার কতভাবে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবনে যে পরিমান চিঠি লিখেছেন এ পর্যন্ত কোনো সাহিত্যিক এত চিঠি লেখেননি। কবি চিঠি পেতেও ভালবাসতেন লিখতেও ভালবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তখন কবির বয়স দশ বছর। শেষ চিঠিটি লিখেছিলেন একাশি বছর বয়েসে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। একবার ক্ষিতিমোহন সেন কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি। প্রত্যেকের কাছে আমার স্টাইল ভিন্ন। কিছুতেই একজনকে অন্যের লেখা স্টাইলে লিখতে পারিনে।“ রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা প্রায় আট হাজার। একাত্তর বছর ধরে দেশী ও বিদেশী ভাষায় সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিঠি লিখেছেন।
এইসব চিঠিপত্র থেকে তাঁর জীবনচরিতের কিছুটা খুঁজে পাই আমরা। অল্প বয়স থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লেখার মধ্যে নিজেকে মেলে ধরার পথ খুঁজে পেয়েছেন। ভর্তি মনের অবস্থায় জরুরি কথা ছাপিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে যে মুখরতা, তা কখনও প্রকাশ পায় বৈঠকি আলাপে, কখনও ডায়েরির স্বগত লিখনে, কখনও বা চিঠির সহজ রাস্তায়। “পথে ও পথের প্রান্তে” নামে পত্রসংকলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ সেদিনকার বানীমুখর ঋতুর ফসলের কথা বলেছেন। সর্বজনের দরবারে যে ‘সাধারন সাহিত্য’ তার স্থান রবীন্দ্র রচনাবলীতে, আর অন্তরঙ্গ মহলের জন্য লেখা ‘চিঠির সাহিত্য’ তার পরিমাণও নিতান্ত কম নয়। যথা ‘ছিন্নপত্র’,’ভানু সিংহের পত্র’, ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ ও বিশ্বভারতী প্রকাশিত আপাতত উনিশ খন্ড চিঠিপত্র। বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত চিঠিপত্রের সংখ্যা ২৫৬৮ টি। হিসেব মত রবীন্দ্রনাথের ৬০ শতাংশ চিঠি এখনও সংকলিত করাই সম্ভব হয় নি। এর বাইরে আরও কত চিঠি পড়ে আছে পত্রিকার পাতায়, রবীন্দ্রভবনে বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে তার হদিশ আমাদের জানা নেই।
রবীন্দ্রনাথের চিঠি অনেকদিন পর্যন্ত
আত্মীয় পরিজুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ভাইঝি
ইন্দিরা বা স্ত্রী মৃণালিনী অথবা পুত্রকন্যাদের উদ্দেশে লেখা চিঠি এক সময়ে ছেপে সাধারণের
সাহিত্য হিসাবে বাজারে বিকোবে, এ কথা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ
ভাবেন নি। পরে
যে তিনি ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন নি তা নয়। তবে
অনেক সময় পত্রপ্রাপকের কাছ থেকে নিজের লেখা চিঠি বা চিঠির কপি ফেরত চেয়েছেন, কারণ সেক্ষেত্রে ব্যক্তির দাবিকে ছাপিয়ে গিয়েছে সাধারণের দাবি। ক্রমশ
চিঠির পরিমান কমেনি বরং দাবিদার যত বেড়েছে, চিঠির সংখ্যা তত বেড়েছে। চিঠি
পেয়ে কবি প্রাপ্তিস্বীকার করবেন না, এমন ঘটনা বোধহয় শেষ
শয্যাগ্রহণের আগে পর্যন্ত ঘটেনি। কোনও
একদিন হয়তো প্রকাশিত হবে রবীন্দ্রনাথের পত্রসমগ্র আর সেদিন হয়তো লেখা সম্ভব হবে সেই
কাঙ্খিত কবি জীবনী যা শুধুই চেষ্টা করবে কবির প্রাণপুরুষকে আবিস্কার করতে। ১৯২৫
সালে ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’ তে তিনি লিখেছেন, “কতকাল থেকে আমাকে একখানা নির্জন নিঃসংগতার
ভেলার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তীরে
দেখতে পাচ্ছি লোকালয়ের আলো, জনতার কোলাহল, ক্ষণে ক্ষণে
ঘাটেও নামতে হয়েছে, কিন্তু কোনোখানে জমিয়ে বসতে পারিনি। বন্ধুরা
ভাবে তাদের এড়িয়ে গেলুম; শত্রুরা ভাবে অহংকারেই দূরে দূরে
থাকি।“ একসময় মনে হয়,
কলকাতার জোড়াসাঁকো রবীন্দ্রনাথের আর ভাল লাগছে না। ইন্দিরা
দেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “আমাদের পরিবারের সঙ্গে
আমার সম্পর্ক এখন ছায়াময় হয়ে এসেচে-তার একটা কারন, ছেলেবেলায় যাদের সঙ্গে আমার জীবনের পারিবারিক গ্রন্থি বাঁধা হয়েছিল তারা প্রায়
সবাই কোথায় অপসারিত-পরলোকে এবং ইহলোকে; এখন জোড়াসাঁকোর
বাড়িটা নদীর সেই বালুময় পথের মতো যাতে নদীর স্রোত আর চলে না।“ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের চিঠি কখনও স্নেহাতুর, কখনও আবেগবিহ্বল
হৃদয়ের প্রকাশ। একদিকে
স্ত্রীকে লিখেছেন, ভালমন্দ দুই অত্যন্ত সহজে গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করতে হবে-ক্রমাগত পদে পদে রাত্রিদিন এই অভ্যাসটি করতে হবে-যখনই
মনটা বিকল হতে চাইবে তখনি আপনাকে সংযত স্বাধীন করে নিতে হবে, তখনি মনে আনতে হবে সংসারের সমস্ত সুখ দুঃখ ফলাফল থেকে আমি পৃথক…।“ অন্যদিকে মাধবীলতাকে কখনও লেখেন,
“তোর শরীর তেমন ভাল নেই শুনে আমার মন বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।“ মীরাকে লেখেন, “তোর আর খোকার জন্য আমার মন উদ্বিগ্ন হয়ে
আছে। আবার বোম্বাই
পুনা অঞ্চলে প্লেগের উপদ্রব আছে বলেও ভাবনা হয়।“ “রোজ ভাবি একখানা চিঠি আসবে, কোথায় আছিস, কেমন আছিস জানতে পারব। …সংসারে স্নেহ করলেও সুখী করবার ক্ষমতা কারও নেই……।“ বউঠানের অকাল মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া
হয়তো কোনও চিঠিতে ধরা নেই, তবে স্ত্রী বিয়োগের পর বা দুই কন্যা,
কনিষ্ঠ পুত্র এবং দৌহিত্রের মৃত্যু যেমন কবির জীবন ও কাব্যে স্থায়ী রেখাপাত
করেছে, তেমনই চিঠিতে দুভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে। শোক
দুঃখে রবীন্দ্রনাথ কাতর হতেন না,
এমন কথা বললে অত্যন্ত ভুল হবে। মৃণালিনী
দেবীর প্রয়াণের পর দীনেশ চন্দ্র সেন কে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ
লিখেছেন, “ঈশ্বর আমাকে যে শক দিয়াছেন তাহা
যদি নিরর্থক হয় তবে এমন বিড়ম্বনা আর কি হইতে পারে। ইহা
আমি মাথা নিচু করিয়া গ্রহণ করিলাম। যিনি
আপন জীবনের দ্বারা আমাকে নিয়ত সহায়বান করিয়া রাখিয়াছিলেন তিনি মৃত্যুর দ্বারাও আমার
জীবনের অবশিষ্ট কালকে সার্থক করিবেন।“ একবার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কে কবি লিখলেন, “জানি না,
কি কারনে সংসারে আমার বন্ধুত্বের সীমা অত্যন্ত সংকীর্ণ। আমার
মধ্যে একটা গুরুতর অভাব নিশ্চয়ই আছে। আমার বিশ্বাস সেই অভাবটা হচ্চে, আমার হৃদ্যতা প্রকাশের প্রাচুর্যের অভাব।“
মীরা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে ধরা আছে
রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব মৃত্যুভাবনা – “শমী যে রাত্রে
গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়চে তার লক্ষণ নেই। মন
বললে,কম পড়েনি-সমস্তর মধ্যে
সবই রয়ে গেছে- আমিও তারি মধ্যে।“
সৃষ্টির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এক পরম
বিস্ময়। কী বিচিত্র
বিপুল সেই সৃষ্টি। কোনও
খন্ড সীমার মধ্যে তার পরিচয় মেলে না। কবির
কর্মজীবনও বহুধা বিস্তৃত- সেই শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতন,
কলকাতার জোড়াসাঁকো থেকে ইউরোপ-আমেরিকা। একদিকে
নিজের অক্ষমতার জন্য ক্ষোভ অন্যদিকে জীবনের আদর্শ রক্ষার প্রানপণ চেষ্টা জীবনের মধ্যভাগ
থেকে শেষ পর্যন্ত নানান চিঠিপত্রে ধরা আছে। তাঁর
দীর্ঘজীবন ও বিপুল সৃষ্টি সর্বক্ষেত্রে এতই স্বতন্ত যে কোনও সাধারণ নিয়মে বাঁধা যায় না।
-----------------------------------------------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি -
জন্মঃ কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুল, কলেজ, অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত। বর্তমানে দিল্লী ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। কলমের সাত রঙ পত্রিকার একজন সক্রিয় সদস্য।