শ্বেতাঙ্গিনী
মহিলা ক্যাব থেকে অর্জুনপুর বাজারের কাছে নেমে শিবানন্দ আশ্রমের খোঁজ করলে একটি
অল্পবয়স্ক ছেলে জানিয়ে দিল ওই আশ্রমটি দশ বছর আগেই অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
শ্বেতাঙ্গিনী মহিলার নাম সুসান ফেয়ারচাইল্ড,ও এসেছে লন্ডন থেকে। পঁচিশ বছর আগে স্বামী শিবাননন্দ যে আশ্চর্য ঘটনাটি
ঘটিয়েছিল সুসানের জীবনে তারই জন্য ওর এতদূর ছুটে আসা চব্বিশ পরগনার এই গন্ডগ্রামে।
“উনি এখন কোথায় আছেন বলতে পারেন আপনারা কেউ?” জিজ্ঞেস করল সুসান। মেমসাহেবকে দেখে আরো কয়েকটি ছেলে এগিয়ে এসেছিল। ওদের
মধ্যে একজন মোটামুটি ইংরেজি জানে কাজেই তাকেই সবাই ঠেলে দিল সামনে । “ নে বাবু তুই
এবার তোর স্পোকেন ইংলিশ ঝালিয়ে নে মেমসাহেবের সঙ্গে বাতচিত করে,” বলল সেই ছেলেটি যাকে সুসান জিজ্ঞেস করেছিল, “ কুড ইউ প্লিজ টেল মি হাও টু রিচ শিবাননদ আশ্রম?” ছেলেটি ভাঙা ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছিল, “ ম্যাডাম, আশ্রম ক্লোজ টেন ইয়ার্স বিকজ মানি প্রবলেম।“ সুসান মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “ ওহ্ মাই গড! সো স্যাড, বাট আই হ্যাভ কাম অল দ্য ওয়ে ফ্রম লন্ডন টু সী হিজ আশ্রম।“ সুকান্ত নামে ওই
ছেলেটির পেটে অত ইংরেজি ছিলনা তাই কোলকাতা থেকে তিন মাসের স্পোকেন ইংলিশ-এর
ক্র্যাশ কোর্স করে আসা বাবুকে দেখে ওকেই এগিয়ে দিয়েছিল সুকান্ত এবং আরো দুটি
ইংরেজি-না-জানা ছেলে।
বাবু এবার
মাথার চুলে চিরুনি চালিয়ে, জামার কলারের ভাঁজ ঠিক করে স্মার্ট হয়ে নিয়ে বলল, “ ম্যাডাম, দ্যাট আশ্রম হ্যাড টু বী ক্লোজড ডাউন বিকজ সাম বিগ বিজনেসম্যান ওয়ান্টেড
দ্যাট ল্যান্ড টু বিল্ড আ হাউসিং এস্টেট ফর দ্য রিচ পিপল। হি গ্র্যাবড ইট উইথ দ্য
হেল্প অফ লোকাল পলিটিশিয়ানস এ্যান্ড ল্যান্ড মাফিয়া। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড
ম্যাডাম হোয়াট আই সেইড?”
সুসান মাথা
নাড়ল। “ ইয়েস, আই ডু।
এ্যান্ড আই ফিল শকড, টেরিবলি ডিসএ্যাপয়েন্টেড। হোয়ার ডাজ শিবানন্দ লিভ নাও?”
বাবু নামের
সেই ছেলেটি এবার সাহেবি কায়দায় শ্রাগ করল, তারপর উপরের দিকে তর্জনী তুলে জানিয়ে দিল যে শিবানন্দ জীবিত নেই। সুকান্ত
এবং অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে ও মেমসাহেবকে এ-ও জানিয়ে দিল যে শিবানন্দ মারা
গিয়েছেন পাঁচবছর আগে। আশ্রম ভেঙে যাওয়ার দুঃখ উনি সহ্য করতে পারেননি। ওই ঘটনার
কয়েক বছর পরে একজন রিক্সাওয়ালাকে কিডনি দিতে গিয়ে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর ছ’মাসের
মধ্যেই মারা যান শিবানন্দ। হতাশ নয়নে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল সুসান। সহরতলীর
কোলাহলমুখর বাজার, মাছের গন্ধ ভেসে আসছে বাজারের পিছন দিক থেকে। সুসান ধন্যবাদ জানাল বাবু এবং
ওর সঙ্গীদের তারপর ক্যাবের দিকে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে বাবু বলল, “ ম্যাডাম, শিবানন্দ ইজ নো মোর, বাট হিজ ওয়ান এ্যান্ড ওনলি ডটার পূর্বা ইজ দেয়ার।“
সুসান ঘুরে
দাঁড়াল। শিবানন্দর পরিবার আছে জানতনা ও, অন্তত ওর মা এলিজাবেথ বা বাবা স্টিভ কোনদিন এ ব্যাপারে কিছু বলেনি ওকে।
“ হোয়ার ডাজ শী লিভ?” জিজ্ঞেস করল সুসান।
“ শী লিভস ইন আ নিয়ারবাই ভিলেজ কল্ড ঘুনি,” বলল বাবু। “ শী রানস এ্যান অর্ফানেজ। টেকস কেয়ার অফ দ্য চিল্ড্রেন লেফট বাই
দেয়ার প্যারেন্টস।“
শিবানন্দের
মেয়ে জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এটাইতো স্বভাবিক। সুসান বলল, “ আই ওয়ান্ট টু মিট হার। কুড ইউ টেক মি টু হার?”
ছেলেরা নিজদের
মধ্যে এবার কথা চালাচালি করতে আরম্ভ করল। বাবু জানাল ওর বাজার করে ঘরে পৌঁছে দিতে
হবে, সুকান্ত বলল ও
পাজামা আর গেঞ্জি পরে বাজারে এসেছে সিগারেট খেতে, ও কী করে এই পোষাকে মেমসাহেবকে নিয়ে যাবে পনের কিমি দুরের ওই গ্রামে। কাবুল
নামের একটি ছেলে রাজি হয়ে গেল এই সর্তে যে ওর ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে মেমসাহেবকে।
ওদের কথাবার্তা না বুঝলেও সুসান আন্দাজ করল যে ওরা ওকে সাহায্য করতে ইতস্তত করছে
কোন কারণে। ইন্ডিয়াতে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে আনএমপ্লয়েড, এসব ছেলেদের নোংরা পোষাক দেখলে মনে হয়না এদের কোন
রোজগার আছে। সুসান এবার বাবুকে জানিয়ে দিল যে কেউ যদি ওকে এস্কর্ট করে শিবানন্দের
মেয়ের কাছে নিয়ে যায় তবে তাকে ও এক হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত আছে। কাবুল এবার
এগিয়ে এল দন্ত বিকশিত করে। “ আই গো, ম্যাডাম। মাই নেম কাবুল। স্পিক ইংলিশ লিটল লিটল।”
“ থ্যাংক ইউ কাবুল,” বলল সুসান।
দুই
শিবানন্দর পূর্বাশ্রমে নাম ছিল অচিন্ত্য বিশ্বাস। অঙ্কে অনার্স করে অর্জুনপুর মিডল স্কুলে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। থাকতেন ভাড়াবাড়িতে। তিন বছরের মধ্যে মধুমিতা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে এবং কন্যালাভ। ঘুরতে ঘুরতে নারায়ণ আশ্রমে এসে স্বামী বিরজানন্দের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অচিন্ত্য। তিনি তখন সবে গ্রামে দুই একর জমি কিনে কাঁচা ইটের গাঁথুনি আর টালির ছাত দেওয়া কয়েকটি ছোট ঘর তৈরি করে ওঁর পাঁচজন শিষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন এই গ্রামে। বাচ্চাদের জন্য অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল আর মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো ছিল ওঁর আশ্রম খোলার প্রথমিক উদ্দেশ্য। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসালয় খুলেছিলেন কয়েক বছর পরে। বিরজানন্দ সাধন-ভজনের থেকে জনসেবার বেশি মর্যাদা দিতেন আর ঠিক একারণেই ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন অচিন্ত্য। ওঁর পরিবারে জনসেবায় নিযুক্ত কেউ ছিলেননা, কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে এবং কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওঁর মনে হয়েছিল সমাজসেবাই মানুষের আসল ধর্ম। পরিবারের চাপে বিয়ে করে সংসারি হলেও মনের ভিতরে কোথাও একটা চাপ ছিল অচিন্ত্যর। বিরজানন্দের আশ্রমে এসে সেই চাপটা অনুভব করতে পারলেন উনি। বিরজানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে শিবানন্দ নাম নিয়ে সমাজসেবার কাজে লেগে গেলেন অচিন্ত্য। প্রথমদিকে ঘরে থেকেই আশ্রমের কাজ করে যেতেন শিবানন্দ কিন্তু এমন একটা সময় এল যখন রাতে ঘরে ফেরার সময় পেতেননা উনি। মধুমিতা পূর্বাকে নিয়ে ফিরে গেলেন পিত্রালয়ে যদিও যতদিন স্কুলের মাস্টারিটা ছিল ততদিন মাইনেটা মধুমিতাকে পাঠিয়ে দিতেন শিবানন্দ। বিরজানন্দ অসুস্থ হয়ে পড়লে শিবানন্দই আশ্রম পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। ততদিনে আশপাশের গাঁয়ে নারায়ণ আশ্রম শিবানন্দের আশ্রম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে নিয়েছে।
নব্বুই-এর দশকের
গোড়ার দিকে বিরজাননন্দ শিবাননন্দকে ইউরোপে পাঠালেন ওঁর পরিচিত কয়েকজন ধনী শিষ্যের
সঙ্গে দেখা করে আশ্রমের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে। হল্যান্ড, জার্মেনি, ফ্রান্স ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে শিবানন্দ এলেন ম্যাঞ্চেস্টারের ইস্ট ডিডসবারি
রোডে অশ্বিনী সামন্ত নামের একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে যিনি একসময় বিরজানন্দের
দাক্ষিণ্য লাভ করেছিলেন ওঁর ছাত্র জীবনে। ট্যাক্সি থেকে নেমে পকেট থেকে চিরকূট বের
করে শিবানন্দ বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে এসে ওঁর
পা থেমে গেল। শিবানন্দের হঠাৎ মনে হল এই বাড়িতে একজন অসুস্থ ব্যক্তি আছে যে তারই
প্রতীক্ষা করছে। গেটে দেখলেন নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘ দ্য ফেয়ারচাইল্ডস’। বাড়ির নম্বর
এগারো, অশ্বিনী
সামন্তের নম্বর তেত্রিশ। এখানে কেন তিনি এভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন? চোখবুজে গুরুকে স্মরণ করলেন শিবানন্দ। ওঁর মনে পড়ে
গেল যে বিরজানন্দ একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, “ দ্যাখ, শিবানন্দ, এই যে জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছি আমরা, এটাই ঈশ্বরের প্রকৃত সেবা।”
শিবানন্দ
জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ আচ্ছা গুরুদেব, ঠাকুর দেবতার পূজার্চনা করে অনেকে অনেক রকম শক্তি পান, সিদ্ধি লাভ করেন শুনেছি। আমরা যে ঈশ্বরের সেবা করছি
তাতে কী কোন ঐশ্বরিক শক্তি লাভ হবে আমাদের?”
বিরজাননন্দ
হেসে শিবানন্দের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, “ নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু কখন হবে, কোথায় হবে কীভাবে হবে তা আমরা কেউ জানিনা।” বিরজানন্দ জানিয়েছিলেন জীবনে
তিনি একবার কিছু সময়ের জন্য এই ঐশ্বরিক শক্তি অনুভব করেছিলেন আর এই শক্তির প্রভাবে
তিনটি দুরারোগ্য রোগীকে সুস্থ করে তুলেছিলেন। এগুলো ওঁর জীবনে অতিলৌকিক ঘটনা যা
উনি কাউকে বলেননা কেননা সাধারণ মানুষ এগুলো শুনলে তাঁর আশ্রমে ভিড় করবে নিজেদের
নানা সমস্যা নিয়ে।
এগারো
ডিডসবারি রোডের সেই বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে শিবানন্দের মনে হল তাঁর উপরও কী ঈশ্বরের
কৃপা দৃষ্টি পড়েছে? এই বাড়িতে কারও প্রয়োজন আছে তার সেবার? শিবানন্দ কলিং বেল টিপলেন। দরজা খুললেন এক মহিলা, তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন শিবাননন্দের দিকে। “
ইয়েস? সরি আই জাস্ট
কান্ট প্লেস ইউ।”
শিবানন্দ তখন
একটা ঘোরের মধ্যে। ইংরেজ রমনীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি উল্টে জিজ্ঞেস করলেন, “ ইজ দেয়ার সাম প্রবলেম ইন ইওর হোম?”
মহিলা ভুরু
কুঁচকে বললেন, “ হোয়াট প্রবলেম?”
“ আই ডোন্ট নো . . . সামওয়ান সাফারিং ফ্রম ইলনেস?”
“ মে আই নো হু আর ইউ?” মহিলা এবার প্রশ্ন করলেন একটু অবাক হয়েই।
শিবানন্দ তখন
জানালেন যে তিনি ইন্ডিয়াতে একটি আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন, গুরুর নির্দেশে এদেশে এসেছেন অর্থ সংগ্রহের জন্য। যে
বাড়িটিতে ওঁর যাওয়ার কথা তার নম্বর তেত্রিশ, কিন্তু এই এগারো নম্বর বাড়িটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওঁর মনে হল এখানে একটি
কোন বড় সমস্যা চলছে যা হয়ত ও সুরাহা করতে পারে বা করার চেষ্টা করতে পারে। মহিলা
এবার বললেন, “ প্লিজ কাম
ইন।”
সেমি-ডিটাচড, দোতলা বাড়ির বেশ প্রশস্ত বসার ঘরে নিয়ে বসালেন
শিবানন্দকে ওই মহিলা। তারপর বললেন ওঁর মেয়ে সুসান যার বয়স মাত্র বারো বছর ও একটি
দুরারোগ্য রোগে ভুগছে গত পাঁচ বছর ধরে। এই রোগটির নাম ফাইব্রোমায়ালজিয়া। অবসাদ বা
ক্লান্তি, দুর্বলতা, ঘুম না হওয়া, স্মৃতিলোপ পাওয়া, মাথা ধরা, হাত পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরা কিংবা হঠাৎ যন্ত্রণাদায়ক খিঁচুনি এবং দুশ্চিন্তা এই
বিশেষ রোগটর প্রধান লক্ষণ। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে সুসান গত
দু’বছরে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে – একবার ছুরি দিয়ে হাতের শিরা কেটে
আরেকবার বাথরুমে গিয়ে বাথটাবে মাথা ডুবিয়ে। এই রোগের চিকিৎসা করেন রিউমেটোলজিস্ট
বা পেইন স্পেশালিস্ট। কিন্তু ওষুধ সাময়িকভাবে ব্যথা-বেদনা কমাতে পারলেও অসুখটা
থেকেই যায়। সুসান এখন মেন্টাল ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছে, স্কুলে যেতে চায়না, সারাদিন শুয়ে থাকে বা টিভির সামনে বসে থাকে।
“ ও এখন কী করছে?” জিজ্ঞেস করলেন শিবানন্দ।
“ ও ওর কামরায় শুয়ে কড়িকাঠ গুনছে।”
“ আমাকে একবার ওর কাছে নিয়ে যাবেন, মিসেস . . .?”
“ আমার নাম এলিজাবেথ ফেয়ারচাইল্ড। আমাকে আপনি এলিজাবেথ বা লিজ বলে ডাকতে
পারেন।”
“ আপনার স্বামী কি ঘরে আছেন?” শিবানন্দ একজন অপরিচিত শ্বেতাঙ্গের বাড়িতে অনুপ্রবেশ করেছেন। বাড়ির কর্তার
অনুমতি ছাড়া কী করে অন্দরমহলে যাবেন তিনি?
“ স্টিভতো কাজে গেছে। কিং স্ট্রিটে ওর গাড়ি মেরামত করার গ্যারাজ আছে। আচ্ছা
আপনি কী ফেইথ হিলার?”
শিবানন্দ
বললেন, “ না সিস্টার, আমি ফেইথ হিলার নই, তবে আজ এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমি সুসানের কষ্ট পুরো না হলেও কিছুটা
লাঘব করতে পারি। তবে আপনার স্বামীর কোন আপত্তি হবেনাতো আমার কাজে?”
এলিজাবেথ মাথা
ঝাঁকালেন। “ একদম নয়। যে রোগের কোন চিকিৎসা নেই সে রোগ সারাবার জন্য যে কোন
ব্যবস্থাই গ্রহণযোগ্য আমাদের কাছে। আপনি প্লিজ উপরে চলুন।”
সিঁড়ি দিয়ে
উপরে উঠে এলিজাবেথ ওঁকে একটি ছোট বেডরুমে নিয়ে গেলেন। জানালার কাছে পড়ার টেবিলে
কম্পুটার, দেয়ালে শেলফে
কিছু বই। ছোট একটি বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে সুসান। নাম ধরে এলিজাবেথ ওকে ডাকলে ও
চোখ মেলে তাকাল, নিরাসক্তভাবে দেখল গেরুয়া পোষাক পরা শিবানন্দকে।
“ সুসান, এই ভারতীয়
দয়ালু মানুষটি তোমার রোগ সারিয়ে দেবেন বলেছেন,” এলিজাবেথ মেয়েকে বললেন। সুসান ভ্রু কুঁচকে একবার তাকাল শিবানন্দের দিকে
তারপর ঠোঁট উল্টে দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুল।
“ সরি স্যার, শী হ্যাজ লস্ট অল হোপস এ্যান্ড হ্যাজ বিকাম আ লিট্ল আনরেসপন্সিভ,” মেয়ের হয়ে মার্জনা চাইলেন মা।
শিবানন্দ
বললেন, “ আমি শুধু
ঈশ্বরের নাম নিয়ে ওর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দেব। ওকে কোন কষ্ট দেবনা আমি। শুধু ওর
মুখটা দেখতে চাই আমি।”
এলিজাবেথ এবার
মেয়ের শিয়রে বসে ঝুঁকে পড়ে ওর কানে ফিসফিস করে কিছু বলতে লাগলেন। শিবানন্দ তাকিয়ে দেখলেন
সুসানের শিয়রে দেয়ালে টানান আছে যীশুর সুন্দর একটি ছবি যাঁর মাথায় জ্যোর্তিবলয়।
শিবানন্দ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট পড়েছেন যীশু এবং তাঁর শিষ্যরা চল্লিশটি মানুষকে
দুরারোগ্য ব্যধি থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এক মহিলাকে রোগমুক্ত করে যীশু যা বলেছিলেন
শিবানন্দ সেই দুটি বাক্য মনে রেখেছিলেন। এলিজাবেথ মেয়েকে অজ্ঞাত, অপরিচিত ভারতীয় মানুষটির দিকে মুখ ঘোরাবার জন্য কি
বলছিলেন তা শুনতে পাচ্ছিলেননা শিবানন্দ, কিন্তু যীশুর বাক্য দুটি মনে পড়ায় তিনি বলে উঠলেন, “ Daughter, your faith has healed you. Go in peace and be freed from
your suffering.”
সুসান মুখ
ঘোরাল। শিবানন্দ নতজানু হয়ে বসলেন মেঝেতে, তারপর দুই হাত ওর মাথায় রাখলেন। ওর মনে হল ওর শরীর থেকে বিদ্যুতের মত কিছু
বেরিয়ে মেয়েটির শরীরে প্রবেশ করল। সুসানের শরীর কেঁপে উঠল থর থর করে আর এলিজাবেথ
নিজেকে ক্রস করে ফিস ফিস করে প্রার্থণা করতে লাগলেন।
পাঁচ মিনিট
পরে শিবানন্দ উঠে দাঁড়ালেন। সুসান ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর মুখে যন্ত্রনার কোন ছাপ নেই এখন দেখলেন এলিজাবেথ।
“ ও লর্ড! দিস ইজ মিরাকেল!”
শিবানন্দ হেসে
বললেন, “ সিস্টার, ঈশ্বর আমাকে দিয়ে আপনার মেয়ের জন্য এই কাজটা করিয়ে
নিয়েছেন। আমি নিমিত্ত মাত্র। এবার নীচে চলুন, আমাকে একগ্লাস জল খাওয়াবেন আর এক কাপ চা বা কফি।”
এগারো নম্বর
ইস্ট ডিডসবারি রোডের সেই বাড়িটি থেকে বেরোবার আগে শিবানন্দ একটি কাগজে আশ্রমের
ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিলেন এলিজাবেথকে।
তিন
‘শিবানন্দ অনাথ আশ্রম’ ঘুনি গ্রামের এক প্রান্তে একটি ভাড়া করা দোতলা
বাড়িতে। নীচের তলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর, অফিস আর পড়াশুনার জন্য কিছুটা খোলা জায়গা। উপর তলায় কুড়িটি ছেলের জন্য
শোবার ব্যবস্থা, প্রতিটি খাটের পাশে রাখা আছে একটি ছোট আলমারি যাতে কাপড়জামা বইপত্র সব
রাখতে পারে ছেলেরা। বাড়ির সামনে ছোট একটি বাঁধান উঠোন যার একপাশে রয়েছে চৌকিদারের
আস্তানা। সুসানকে আশ্রমটা ঘুরিয়ে দেখাল পূর্বা তারপর ওকে নিয়ে এসে বসল অফিসে।
কাবুল ততক্ষণে কিচেনে গিয়ে ঘুগনি আর পাউরুটি আদায় করে নিয়ে খাবার জায়গায় বসে গেছে।
“ বাবার কাছ থেকে আশ্রমটা ছিনিয়ে নেবার সময় ওরা যে টাকা দিয়েছিল তাই দিয়েই এই
অর্ফানেজ খুলেছিলেন বাবা,” জানাল পূর্বা সুসানকে। “ বাবাতো কিডনি দিতে গিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন কিন্তু
নিয়মিত ডোনেশান না আসায় আর সরকারি সাহায্য না পাওয়ায় এই অনাথ আশ্রম আর বেশিদিন
চালান যাবেনা।”
“ ভেরি স্যাড,” সুসান বলল। “ আমি কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”
পূর্বা মাথা
ঝাঁকাল। “ আপনি ওয়ান টাইম কিছু সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু তাতেতো কাজ হবেনা। শুধু থাকা খাওয়া নয়, এদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করতে হয় আমাদের। অনেক খরচ।
শিবানন্দের শিষ্যদের অনেকেই মারা গিয়েছেন, ওঁদের ছেলেমেয়েরা আর টাকা পাঠাননা। আমি রামকৃষ্ণ মিশন এবং আরো অন্যান্য
কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলছি যদি ওর এটাকে নিয়ে নেয়।“
“ ইউ ওয়ান্ট টু কুইট?”
“ আই কান্ট হেল্প, সুসান।”
“ ডোন্ট।”
এবার পূর্বা
অবাক হয়ে তাকাল এই বিদেশি মহিলার দিকে। শিবানন্দ ওকে জানিয়েছিলেন সুসানের কথা, ওর দুরারোগ্য অসুখ সারাবার সেই অবিশ্বাস্য কাহিনি।
পূর্বার মা মধুমিতা দু’বছর আগেই মারা গেছেন। পূর্বা লেখাপড়া শিখে চাকরি বা বিয়ে
কোনটাই না করে বাবার ইচ্ছায় এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে একটা অনাথ আশ্রম চালাচ্ছে সেটা
মধুমিতা মেনে নিতে পারেননি যেমন পারেননি অচিন্ত্যর সংসার ছেড়ে রাতারাতি সন্ন্যাসী
হয়ে যাওয়া। যেমন বাবা তেমনি মেয়ে, মনে দুঃখ নিয়েই চলে গেলেন মধুমিতা। কিন্তু অর্থাভাবে বিপর্যস্ত পূর্বা আর
ধরে রাখতে পারছেনা এই আশ্রম। বিদেশিনি এই মহিলা যে এতদূর থেকে ওকে দেখতে এসেছেন
তাতে পূর্বা খুশি হয়েছে। যাবার সময় কয়েকশো পাউন্ডের একটা চেক দিয়ে যাবেন উনি যেমন
বাইরে থেকে আসা ভারতীয়রা দিয়ে থাকেন কিন্তু তাতেতো কাজ হবেনা। আশ্রমকে বাঁচাতে হলে
অনেক টাকা দরকার। খাওয়া, থাকা, পড়াশুনা, কাপড়চোপড়, চিকিৎসা সব মিলিয়ে একটা বাচ্চার পেছনে বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়।
তাছাড়া চৌকিদার, রাঁধুনি, অফিস কর্মচারি, স্টেশনারি . . . সব মিলিয়ে পূর্বা হিসেব করে দেখেছে বছরে কমপক্ষে দশ লাখ
টাকার প্রয়োজন এই আশ্রম চালাতে। টাকার অভাবে অনেক টেনেটুনে চালাতে হচ্ছে শিবানন্দের
অনাথ আশ্রম। একদু’ ঘন্টার জন্য এখানে এসেছে সুসান, ওকে এই সাতকাহন শুনিয়ে বিরক্ত করতে চায়না পূর্বা।
“ কিন্তু আর্থিক দিকটাতো আমাকে ভাবতে হবে সুসান।”
“ আই উইল হেল্প ইউ,” সুসান বলল ওর হাতে হাত রেখে।
পূর্বা তাকাল
বিদেশি মহিলার দিকে। বয়স ওর মতই হবে, দেখতে সুন্দরি না হলেও সুশ্রী বলা চলে, চুলের রঙ বাদামি, চোখদুটি গভীর নীল সমুদ্রের মত।
“ অনেক ধন্যবাদ সুসান,” বলল পূর্বা ক্লিষ্ট হেসে। “ কিন্তু এটা চালাতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। বছরে
. . .” পূর্বা মনে মনে টাকার অঙ্কটা পাউন্ডে হিসেব করার চেষ্টা করল। শিবানন্দ
অঙ্কের মাস্টার ছিলেন, পূর্বা স্কুলের শেষ পরীক্ষায় অঙ্কে সাতানব্বুই পেয়েছিল। মনে মনে দশ লাখকে
নব্বুই দিয়ে ভাগ করে দেখল পূর্বা এগারো হাজার পাউন্ডের একটু উপরে।
“ হাও মাচ?” সুসান জিজ্ঞেস করল।
“ আ লিটল ওভার ইলেভেন থাউস্যান্ড পাউন্ডস।”
“ দ্যাটস নট আ ভেরি বিগ এমাউন্ট।” এবার সুসান নিজের অঙ্ক কষতে বসল, মনে মনে নয়, পূর্বার সামনে রাখা নোটপ্যাড আর পেনটা টেনে নিয়ে। সুসান কাজ করে
ম্যানচেস্টারের একটা ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনে যাদের কাজ পেনশনারদের টাকা বিনিয়োগ
করে ওদের হাতে কিছু বাড়তি টাকা তুলে দেওয়া। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং ওর
স্কুলের পড়া শেষ হবার আগেই ওর বাবা স্টিভ ওর মা এলিজাবেথকে ছেড়ে অন্য এক মহিলাকে
বিয়ে করায় সুসানকে ‘ও’ লেভেল শেষ করেই চাকরিতে ঢুকে যেতে হয়। ইস্ট ডিডসবারির এগারো
নম্বর বাড়ি ছেড়ে এলিজাবেথ আর সুসান এখন থাকে ম্যানচেস্টার থেকে চল্লিশ মাইল দূরে
ব্রিকফিল্ড নামে একটা ছোট্ট গ্রামে। গাড়ি চালিয়ে ওকে আসতে হয় ম্যানচেস্টার সিটি
সেন্টারে ওর অফিসে। অফিসে পল নামে একজন সহকর্মির সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে কিছুদিন
হল, কিন্তু এখনো
বিয়ের কথা ওঠেনি। বছরে ষাট হাজার পাউন্ড মাইনে পায় সুসান আর গ্রামে একটি কর্নার
শপে কাজ করে ত্রিশ হাজার পাউন্ড রোজগার করেন এলিজাবেথ। রোববার এখনও নিয়মিত চার্চে
যান এলিজাবেথ আর প্রার্থণা করেন সেই অদ্ভুত ভারতীয় মানুষটির কল্যাণে যিনি সুসানকে
মুক্ত করে দিয়েছিলেন দুরারোগ্য ফাইব্রোমাইয়ালজিয়া থেকে। ভারতে আসার আগে এলিজাবেথ
বলেছিলেন সুসানকে, “ হেল্প ইওর স্যাভিয়ার এ্যাস মাচ এ্যাস ইউ ক্যান। হী ওয়াজ আ গডসেন্ড, ফর ইউ হী ওয়াজ জাস্ট লাইক জিসাস ক্রাইস্ট।“
শিবানন্দ
বেঁচে নেই কিন্তু তাঁর মেয়েতো এখনো বেঁচে আছে আর ও কাজ করে যাচ্ছে অসহায়, অনাথ বাচ্চাদের জন্য। ওকে সাহায্য করাতো সুসানের
কর্তব্য, ধর্ম।
“আমি টাকার ব্যবস্থা করব পূর্বা, তুমি এই অর্ফানেজটা বন্ধ কোরোনা,” সুসান বলল পূর্বার হাতটা শক্ত করে ধরে। “তোমার বাবা আমাকে নতুন জীবন দান
করেছিলেন, তার ঋণ আমি
কোনদিন শোধ করতে পারবনা। আমি শুধু এটুকু প্রতিদান করে ধন্য হব।”
পূর্বা উঠে
দাঁড়াল তারপর টেবিলের এপাশে এসে সুসানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে
কাঁদতে লাগল। সুসানের চোখও শুষ্ক রইলনা।
রাত আটটায় সুসানের ফ্লাইট, তাই বিকেল চারটায় আশ্রম থেকে গাড়িতে উঠল সুসান। গাড়িতে ওঠার আগে আরেকবার পূর্বাকে বুকে জড়িয়ে ধরল সুসান। ভারতবর্ষে আসা ওর সার্থক হয়েছে। দুপুরে অনাথ ছেলেদের সঙ্গে বসে ডাল-ভাত আর পাঁচমেশালি তরকারি খেতে খেতে সুসান শুনেছিল শিবানন্দের জীবনের কাহিনি যা ওকে মুগ্ধ করেছিল। ওর মনে হয়েছিল ও কোন মহাপুরুষের কথা শুনছে যাকে এখনো অনেকে চিন্তে পারেনি ওঁর নিজের দেশেই। অর্জুনপুরে কাবুলকে নামিয়ে দেবার সময় ওর হাতে সুসান তুলে দিল পাঁচ হাজার টাকা। কাবুল হা করে তাকাল এই বিদেশি মহিলার দিকে, তারপর দুই হাত তুলে নমষ্কার করল সুসানকে।
- - -
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে,
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের
শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘ Hem And Football’ ফরাসি, জার্মান এবং নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। ইংরেজিতে দেশে ও বিদেশে ওঁর কিছু
গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে।
বাংলায় এ যাবৎ চারটি উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, নব
কল্লোল, সাপ্তাহিক বর্তমান, পরিচয়,
কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায়
গল্প লেখেন নলিনাক্ষবাবু।