ধারাবাহিক বড় গল্প
২য় পর্ব শুরু
দুই
দেরাদুনের রক্উড স্কুলে ভাল শিক্ষা দীক্ষার সঙ্গে আদব কায়দাটাও শেখান হয় খুব যত্ন নিয়ে, কাজেই মনে যাই থাক মা-র ঠিক করে দেওয়া একমাসের সঙ্গীকে ভালভাবেই অভ্যর্থনা জানাল বান্টি। ছেলে যেভাবে হাসিমুখে চিন্টুর সঙ্গে হাত মেলাল তাতে নন্দিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওর সঙ্গী নির্বাচন বিফলে যায়নি। চায়ের সঙ্গে পেস্ট্রি আর বিস্কিট খাইয়ে নন্দিতা চিন্টুকে স্বাগত জানাল ওর বাড়িতে। সকালে খেলাধূলা করে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর চিন্টুর বিশ্রামের জন্য একটি ছোট কামরা,যেটি আগে ছিল বান্টির স্টাডিরুম, বিছানাপত্র দিয়ে, এসি লাগিয়ে ঠিক করে রাখা হয়েছে। নন্দিতার মাস্টার বেডরুম ছাড়া ফ্ল্যাটের অন্য তিনটি কামরায় কিংবা কামরা সংলগ্ন ব্যালকনিতে যাবার কোন বাধা নেই চিন্টুর,নন্দিতা ওকে ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবার সময়ই জানিয়ে দিল। বান্টির আলাদা শোবার ঘর আছে, কাজেই দুপুরে এক বিছানায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শোবার প্রয়োজন পড়বেনা ওদের।
যে কথাটা নন্দিতা বান্টি এবং চিন্টু
দুজনের কাছ থেকেই গোপন রাখল সেটা হল ঘরের প্রত্যেকটি কামরায় ও সিসি টিভি লাগিয়ে
দিয়েছে। দেয়ালে বা সিলিংএ এমনভাবে ক্যামুফ্লেজ করে ক্যামেরাগুলো লাগান হয়েছে যে
খুব ভালভাবে না দেখলে ওগুলো চোখে পড়বেনা কারো। খবরের কাগজে প্রতিদিনই চাইল্ড
এ্যাবিউজের নিউজ পড়ে ছেলের জন্য এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে
নন্দিতা। অফিসে বসে সিসি টিভির মনিটরিং করার দায়িত্ব রূপার। খেলাধূলো,গানবাজনা
যা খুশি করুক ওরা কিন্তু ওদের সম্পর্কটা শারীরিক সম্বন্ধের দিকে এগিয়ে গেলে
শুরুতেই বাধা দেবার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় নন্দিতা।
“ তোমরা দুজন কোথায় যাবে,কী দেখবে
এ সবের একটা লিস্ট বানিয়ে নিতে পার,” নন্দিতা
বলল ছেলেকে।
“ এ্যাডভান্স প্ল্যানিং-এর কোন
দরকার হবেনা, মম,” বান্টি
বলল। “কাল দশটায় বসন্ত বিহার পিভিআর-এ
আমরা বাহুবলী টু দেখতে যাব। এ্যানি অবজেক্শান ফ্রম ইওর সাইড?”
“ নট এ্যাট অল ডার্লিং। আমি
সকালে অফিসে গিয়ে শিউশরণকে পাঠিয়ে দেব।”
বান্টি এবার তার নতুন বন্ধুকে জিজ্ঞেস
করল, “ বাহুবলী টু দেখেছ তুমি?”
“ না ও ছবিটা দেখা হয়নি আমার।”
“ তা হলে তোমারও কোন অবজেক্শান
নেই নিশ্চয়ই?”
“ নট এ্যাট অল, ডার্লিং,” চিন্টু
হেসে বলল নন্দিতার অনুকরণ করেই।
“ বান্টিকে ডার্লিং বলবেনা
তুমি চিন্টু,” নন্দিতা বলল ভ্রুকুটি
করে। “ওই ডাকটা আপাতত আমার জন্যই তোলা
থাক।”
“ ওঃ মম, ডোন্ট বি
সিলি। আমার স্কুলেওতো আমরা অনেক সময় ঠাট্টা করে একে অপরকে ‘ডার্লিং’ বলি, তাতে কি
এসে যায়?”
“অল রাইট বান্টি, বাট ইউজ
দ্যাট টার্ম ভেরি স্পেয়ারিংলি, রাইট?”
আজকালকার ছেলেমেয়েদের শাসন করাও এক
প্রবলেম। ভাগ্যিস বান্টি মেয়ে হয়ে জন্মায়নি। মেয়ে হলেতো ওকে সামলাতে আরো অনেক বেশি
সাবধানতা অবলম্বন করতে হত। সেদিন বিদায় নেবার সময় বান্টি যে চিন্টুকে লিফট অব্দি
এগিয়ে দিয়ে এল সেটা নন্দিতার ভালই লাগল। রক্উড স্কুলে গিয়ে ও ম্যানার্স, এটিকেট ভালই
শিখেছে,মনে হল নন্দিতার।
তিন
প্রথম দু’সপ্তাহে ওরা দু’জন চারটে মলে গিয়ে ঘোরাঘুরি করল, তিনটা সিনেমা দেখল, দুপুরে ঘরে বসে ক্যারাম আর চাইনিজ চেকার্স খেলল, বিকেলে পার্কে গিয়ে অন্য ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলল। দু’দিন রাতে নন্দিতা ওদের নিয়ে ভাল রেস্তরাঁয় মোগলাই আর চাইনিজ খাইয়ে দিল। তারপর তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে দুজনেই খুব বোর হয়ে গেল। বান্টি বলল, “ হোয়াট নেক্সট,মেট?”
গ্রামের স্কুলে ক্লাস এইট অব্দি শেখা
ইংরেজি ভুলে গেছে চিন্টু,তাই একটু অবাক হয়ে বলল,“মানে?”
“তুমি দেখছি একেবারেই ইংরেজি
জাননা। আমি বলছি আমরা এখন কী করব? ফিফ্থ
উইকেতো মম আমাকে নিয়ে গোয়া যাবে। আমি বললে মম তোমাকেও সঙ্গে নিয়ে নেবে।”
“কিন্তু আমাকেতো তোমার মা
একমাসের জন্য রেখেছেন। আমি কী করে তোমাদের সঙ্গে গোয়া যাব?”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন
বল কী করব আমরা এই বাকি দু সপ্তাহ?”
“হোয়াট নেক্সট?” চিন্টু
বলল ওর নতুন পাতান বন্ধুর গলা নকল করে। “আমি একটা বুদ্ধি দিতে পারি।”
“কি বুদ্ধি?”
“তুমি আমাকে ইংরেজি শিখিয়ে
দাও, আমি তোমাকে নাচ শেখাব।”
“তুমি ভাল নাচতে পার?”
চিন্টু বলল,“গাঁয়ে
থাকতে ওটাইতো করতাম। বিয়ে শাদিতে,জন্মদিনে
হিট হিন্দি, ভোজপুরি,মৈথিলী
গানের সঙ্গে নাচতাম আমি। ওর জন্য পয়সাও পেতাম।”
“ভেরি ইনট্রেস্টিং, মানে খুব
মজাদার ব্যাপার। তা আমাকে দু’একটা নাচ দেখাও দেখি।”
“কিন্তু বান্টি, গানের
সিডিতো আমার কাছে নেই এখন। গান না হলে কি করে নাচ দেখাব আমি?”
“ডোন্ট বি সিলি। আমার স্মার্ট
ফোনে ইউ টিউব থেকে তোমার পছন্দসই গান বাজাব আমি। আমার কাছে এস।”
চিন্টুর হাতে এখনও স্মার্ট ফোন আসেনি। ওর
ছোট ফিচার ফোন থেকে শুধু ফোন করা আর ফোন ধরা যায়। মাসের শেষে পুরো টাকাটা হাতে এলে
অল্প দামের একটা স্মার্ট ফোন কিনে নেবে ভেবে রেখেছে ও। বান্টি ওর স্মার্ট ফোনে ইউ
টিউব খুলে বলল, “কি ধরনের
গানে নাচতে পছন্দ কর তুমি?”
“আমি সব রকম গানেই নাচি।
পুরনো হিন্দি গান বাজাওনা একটা।”
“ওকে। “ আঙুল ঘসে ইউ টিউবে
‘গোল্ডেন ওল্ডিজ’ খুলে নিল বান্টি, তারপর
একটা একটা করে গানের প্রথম কলি আওরাতে লাগল। ‘রাজা হিন্দুস্তানী’ ছবির ‘ আয়েহো
মেরি জিন্দেগিমে’ গানটা দুজনেরই পছন্দ হল। কিন্তু কোথায় নাচবে চিন্টু? দুটো
শোবার ঘরেইতো খাট বেশির ভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। ওরা শেষে ঠিক করল বাইরের ঘরেই
হবে ওদের নৃত্যানুষ্ঠান। বেলা তখন দুপুর বারোটা, কাজের
মেয়ে সন্ধ্যা রান্নাঘরে প্রেশার কুকারে ডাল বসিয়ে আলু কাটছে মাছের ঝোলের জন্য।
বান্টি গিয়ে ওকেই ধরে নিয়ে এল সোফা, টেবিল
সরিয়ে সিটিং রুমে জায়গা করে দেবার জন্য। চিন্টু নাচবে শুনে সন্ধ্যার উৎসাহ বেড়ে
গেল। টিভিতে ‘ডান্স ইন্ডিয়া ডান্স’ প্রোগ্রামে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কি দারুণ নাচে
আজকাল! সন্ধ্যার খুব ইচ্ছা ওর আট বছরের
মেয়ে টুস্কিও কোথাও নাচ শিখে টিভির পর্দায় নেচে ওর নাম রোশন করে। ওর মোদোমাতাল
বরটা যদি রোজ সন্ধ্যায় মদ গিলে বাড়িতে এসে হল্লাগুল্লা না করে দুটো পয়সা বাঁচিয়ে
মেয়েটাকে নাচের ক্লাসে দিত . . .। রান্নাঘরে উনুন বন্ধ করে, সোফা, টেবিল
সরিয়ে সন্ধ্যা বান্টি বাবার সঙ্গে নাচ দেখতে বসে গেল। ইউ টিউবে গান শুরু হলে
চিন্টু পুরোপুরি নাচের মুদ্রায় চলে গেল। গানের সুর তাল লয় অনুযায়ী ওর হাত, পা, চোখ যে
ভাবে নাচের ভঙ্গিমায় দ্রুত পালটে যাচ্ছিল তাতে বান্টি বা সন্ধ্যা কারো মনেই সন্দেহ
রইলনা যে চিন্টু খুব দক্ষ নাচিয়ে আর ও নাচে কোমর দুলিয়ে ঠিক মেয়েদের মতই। ‘আয়েহো
মেরি জিন্দেগিমে’ শেষ হলে দু’জন দর্শকের তালিতে খুশি হয়ে চিন্টু বলল, “গাঁয়ের নাচের দলে আমার নাম
কী ছিল জান তোমরা? লায়লা।”
সন্ধ্যা খিল খিল করে হেসে উঠে ভাঙা গালায়
গেয়ে উঠল, “লায়লা ও
লায়লা . . .!”
“এখন থেকে লায়লাই ডাকব তোমাকে,” বান্টি
বলল।
সন্ধ্যা বলল, “ আমিও।”
চিন্টু হেসে বলল, “ বেশ, কিন্তু
ম্যাডামের সামনে নয়, মনে থাকে যেন, নইলে
আমাকে বের করে দেবেন এখান থেকে।”
সন্ধ্যা বলল, “ ঠিক আছে, এবার
আমাদের আরেকটা নাচ দেখাও, লায়লা।”
লায়লা বলল, “ কিন্তু
সন্ধ্যা দিদি, তুমিতো রান্না ফেলে এসেছ।
বান্টির খাবার তৈরি করতে দেরি হয়ে যাবে যে।”
“আরে দশ বিশ মিনিট দেরি হলে
বান্টি বাবাকে কেক খাইয়ে দেব আমি, তোমাকেও
দেব।”
“কি নাচব এবার বল?”
আবার গানের লিস্ট বার করল বান্টি। দু
চারটে গানের প্রথম কলি শুনে চিন্টু ওরফে লায়লা রাজি হয়ে গেল ‘ইয়াদো কা বরাত’ থেকে
‘ চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে যো দিল কো’ নাচতে। বান্টি আর সন্ধ্যাকেও এবার টেনে স্টেজে
তুলে দিল লায়লা, তারপর বলল, “আমার সঙ্গে নাচ, তোমারাও
স্টেপগুলো শিখে যাবে।”
সন্ধ্যার বয়স ত্রিশের নীচে কিন্তু
মেদবহুল ভারি চেহারা। কয়েক মিনিট হাত পা ঘুরিয়ে ও থপ করে বসে পড়ল। “ বান্টিসোনা
তোমরা দু’জন নাচ, আমি দেখি কেমন?” সন্ধ্যা
বলল হাঁপাতে হাঁপাতে। ‘চুরা লিয়া’র পর ‘সজন’ ছবির ‘দেখা হ্যায় পেহেলি বার’ আর ‘কুছ
কুছ হোতা হ্যায়’ ছবির ‘ তুম পাস আয়ে, ইঁউ
মুস্কুরায়ে’ গানের সঙ্গেও নাচল লায়লা বান্টিকে হিরোর ভূমিকায় নামিয়ে দিয়ে। বেলা একটার সময় পরিশ্রান্ত হয়ে দুজন গা এলিয়ে
দিল সোফায়। রান্নাঘরে ফিরে যাবার আগে সন্ধ্যাকে বলল লায়লা, “ ম্যাডামকে
বলবেনা কিন্তু সন্ধ্যা দিদি, তাহলে আমার কাজ চলে যাবে আর
তোমাকে নাচ দেখাতে পারবনা।”
সন্ধ্যা বলল, “পাগল নাকি? কাল আমার
মেয়ে টু্স্কিকে নিয়ে আসব। ওর নাচের খুব শখ,একটু
শিখিয়ে দিও ওকে।” বলা বাহুল্য, সেদিন
দুপুরে লায়লার পাতে আর মাছের ল্যাজা কিংবা গাদার কাঁটাভর্তি ছোট পিস নয়,বান্টির
পিসের সমান বড় একটা পিস পড়ল।
ওদিকে ওদের অলক্ষ্যে অফিসে নিজের সিটে
বসে রূপা বসের ফ্ল্যাটের সিসি টিভি মনিটর করতে গিয়ে চিন্টুর নাচ দেখে গালে হাত দিল।
ওতো ম্যাডামকে এই মেয়েলি ছেলেটার ব্যাপারে প্রথমেই সতর্ক করে দিয়েছিল, কিন্তু
উনি কী বুদ্ধিতে এই হিজরেটাকে ঘরে ঢোকালেন কে জানে। লাঞ্চের সময় নন্দিতা যখন সোফায়
বসে বিশ্রাম করছিল,রূপা এসে সবিস্তারে খবরটা
জানাল ম্যাডামকে। রূপা ভেবেছিল বস লাফিয়ে উঠে চিৎকার করবেন,“স্টপ দিস
নুইসান্স রূপা,ফায়ার দ্যাট এফেমিনেট বয়,” বা ওই
জাতীয় কিছু। কিন্তু কি আশ্চর্য! ম্যাডাম মুচকি হেসে বললেন, “লেট দেম
এনজয় রূপা। যতক্ষণ ওরা আমার ঘরের জিনিষপত্র ভাঙছেনা ততক্ষণ আমি ওদের নাচগানে
ইন্টারফেয়ার করবনা।”
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
৩য় পর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার।
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘ Hem And Football’ ফরাসি, জার্মান এবং নরওয়েজিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়। ইংরেজিতে দেশে ও বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাংলায় এ যাবৎ চারটি উপন্যাস এবং দু’টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, নব কল্লোল, সাপ্তাহিক বর্তমান, পরিচয়, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষবাবু।