চরক, চরক ঋষি নামেও পরিচিত,ছিলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক যিনি ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তার অগ্রগামী কাজের কারণে তাকে প্রায়ই ভারতে "মেডিসিনের জনক" বলা হয়। মনে করা হয় যে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর কাছাকাছি বসবাস করতেন।
তার জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট
ঐতিহাসিক নথির অভাব থাকা সত্ত্বেও,চরকের উত্তরাধিকার তার
কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। চরকসংহিতা একটি প্রাচীন
আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ যা আয়ুর্বেদের অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ
হিসেবে বিবেচিত হয়। চরক সংহিতা হল চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি বিস্তৃত গ্রন্থ যা
শারীরস্থান, শরীরবিদ্যা, প্যাথলজি,
রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিৎসা সহ বিস্তৃত বিষয়গুলিকে কভার করে।
এটি আটটি বিভাগে বিভক্ত, এতে বিভিন্ন রোগের কারণ, লক্ষণ এবং চিকিত্সার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। গ্রন্থটিতে
প্রতিরোধ, খাদ্য, জীবনধারা এবং ঔষধি
ভেষজ ব্যবহারের তথ্যও রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসায় চরকের অবদান শুধুমাত্র
চরক সংহিতার বিষয়বস্তুর মধ্যেই নয় বরং স্বাস্থ্যসেবার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির
মধ্যেও রয়েছে। তিনি ওষুধের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বের উপর জোর
দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র একটি রোগের লক্ষণগুলির পরিবর্তে
সম্পূর্ণ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। চরক "দোষ" ধারণায় বিশ্বাস করতেন,
যা তিনটি মৌলিক শক্তি বা নীতি যা শরীরের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
করে। আয়ুর্বেদ অনুসারে,এসব দোষের ভারসাম্যহীনতা আমাদের দেশের অসুস্থতার সৃষ্টি
করে। চিকিত্সার মাধ্যমেই এই শক্তিগুলির
ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। চরক সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও
প্রতিরোধ এবং প্রচারের গুরুত্বের উপরও জোর দিয়েছেন। তিনি একটি স্বাস্থ্যকর
জীবনধারার পক্ষে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে সঠিক খাদ্য, ব্যায়াম
এবং মানসিক ও মানসিক সুস্থতা অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রতিরোধ এবং সামগ্রিক যত্নের উপর
চরকের জোর আয়ুর্বেদের নীতিতে প্রতিফলিত হয়,যা আজও ভারতে
এবং সারা বিশ্বে চর্চা করা হচ্ছে। চিকিৎসায় তার অবদানের পাশাপাশি,চরকাকে আয়ুর্বেদে অস্ত্রোপচারের ধারণার বিকাশের জন্যও কৃতিত্ব দেওয়া
হয়। তিনি প্লাস্টিক সার্জারি, ছানি সার্জারি, এবং বিদেশী দেহ নিষ্কাশন সহ সার্জারি সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন অস্ত্রোপচার
পদ্ধতি,যন্ত্র এবং কৌশলগুলি বর্ণনা করেছেন। সামগ্রিকভাবে,প্রাচীন ভারতে একজন বিজ্ঞানী এবং চিকিত্সক হিসাবে চরকের উত্তরাধিকার
চিকিৎসা ক্ষেত্রে তার অগ্রগামী কাজের প্রমাণ। চরক সংহিতা এবং সামগ্রিক
স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে,তিনি আয়ুর্বেদের
ক্ষেত্রে অনুশীলনকারীদের এবং গবেষকদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। স্বাস্থ্য
ও নিরাময়ের বিষয়ে তাঁর নিরবধি জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে ওষুধের ইতিহাসে একটি
সম্মানিত ব্যক্তিত্ব করে তোলে এবং প্রাচীন ভারতীয় ওষুধে তাঁর অবদানগুলি আজও
স্বাস্থ্যসেবা অনুশীলন এবং বিশ্বাসকে রূপ দিতে চলেছে।
যে চিকিৎসক জ্ঞানের প্রদীপ নিয়ে রোগীর দেহে প্রবেশ করতে
পারেননা,তিনি রোগের চিকিৎসাও করতে পারেননা। চিকিৎসক প্রথমে রোগীর রোগের উপর
প্রভাবকারী সমস্ত কারণগুলি খুঁটিয়ে দেখে তবেই চিকিৎসা পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেন। এ
কথা ভুললে চলবেনা যে, রোগীর ওপর তার পরিবেশও যথেষ্ট প্রভাব
বিস্তার করে। রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগের প্রতিষেধক ব্যবস্থা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
ওপরের উক্তিগুলি আজকের দিনে অত্যন্ত সহজ সাধারণ কথা মনে হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে যে,চরক (charaka) বিশ-শতাব্দী আগে তাঁর বিখ্যাত আয়ুবেদিক গ্রন্থ "চরকসংহিতায়"
এগুলো লিখে গেছেন। শরীর তত্ত্ব,নিসান বিদ্যা,ভ্রূণবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি যা কিছু বলে গেছেন, তা আজও লোকেরা
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
পাচন (digestion), বিপাক (metabolism) অনাক্রম্যতা (immunity) ইত্যাদি
সম্পর্কে ধারণা চরকই প্রথম আমাদের দেন। তাঁর মতে বায়ু, পিত্ত,
কফ, এই ত্রি-দোষের পারস্পরিক সামঞ্জস্যের উপরে
শারীরিক সুস্থতা নির্ভর করে। খাদ্যের উপর রক্ত, মাংস ও মজ্জা
ইত্যাদি ধাতুর প্রতিক্রিয়ায় এই ত্রি-দোষের সৃষ্টি। একই পরিমাণ খাদ্য থেকে বিভিন্ন
শরীরে বিভিন্ন মাত্রায় এই ত্রি-দোষের সৃষ্টি হয়। সেইজন্য কারুর গঠন দূর্বল,কারও বা মজবুত,কেউ বা মোটা,কেউ
বা রোগা।
রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা
সত্ত্বেও তিনি এই ত্রি-দোষের অসামঞ্জস্যকেই অসুস্থতার মুখ্য কারণ হিসেবে
উল্লেখ করেছেন। এই সামঞ্জস্য পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি নানারকম ঔষধপত্রের ব্যবস্থা
দিতেন। এ ব্যপারে জীবাণুকে মোটেই গুরুত্ব দেননি।
ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণায়ক মুখ্য কারণ ইত্যাদি অনুবংশবিদ্যার
(genetics)
মৌলিক তত্ত্বগুলি তাঁর জানা ছিল। শিশুর জন্যগত দৈহিক বিকৃতি
(খঞ্জত্ব বা অন্ধত্ব) পিতামাতার দৈহিক ত্রুটির জন্য নয়। এই বিকৃতির গূঢ় তত্ত্ব যে
ডিম্বাণু ও শূক্রাণুর মধ্যে লুক্কায়িত এ কথা তিনি বলেছেন। আজও তাঁর কথা সত্য বলে
মানা হয়।
মানুষের শরীরের গঠন প্রণালী (Anatomy) এবং
অভ্যন্তরীণ যন্ত্রাবলী সম্বন্ধেও তাঁর প্রচুর জ্ঞান ছিল। তিনি বলে গেছেন যে
মানুষের দেহে দাঁত সহ মোট ৩৬০ টি হাড় আছে। তিনি জানতেন যে হৃদযন্ত্র থেকে সারা
শরীরে তেরটি প্রধান নাড়ী এবং অসংখ্য শাখা ও প্রশাখা নাড়ী ছড়িয়ে আছে। এই সমস্ত
নাড়ীর সাহায্যে শুধু যে পোষক বস্তুই শরীরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত হয় তা নয়,
এগুলির দ্বারাই আবার শরীরের অসার বস্তুগুলি নিষ্কাশিত হয়। তিনি এও
জানতেন যে এই প্রধান নাড়ীগুলির কোনও অংশে বাধা সৃষ্টি হলে বিভিন্ন প্রকার রোগ বা
দৈহিক বিকৃতি ঘটে থাকে। এই সমস্ত জ্ঞান থাকা সত্বেও হৃদযন্ত্রের প্রকোষ্ঠ সম্পর্কে
তাঁর একটি ভুল ধারণা ছিল। তিনি ভাবতেন যে হৃদযন্ত্রে মাত্র একটি প্রকোষ্ঠই আছে।
সুপ্রাচীন চিকিৎসক আত্রেয়ের তত্ত্বাবধানে অগ্নিবেশ
খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশদতথ্য সম্বলিত একটি গ্রন্থ
লেখেন। কিন্তু পরে চরক যখন এই গ্রন্থটির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেন তখনই এই গ্রন্থ
"চরকসংহিতা” নামে লোকপ্রিয় হয়। এরপর থেকে দু'হাজার বছর
পর্যন্ত এই গ্রন্থই চিকিৎসা শাস্ত্রের আকর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই সময়
এই গ্রন্থ আরবী, লাটিন ইত্যাদি বিভিন্ন বিদেশী ভাষাতে অনূদিত
হয়।
দুর্ভাগ্যবশত: চরকের ব্যক্তিগত জীবনসম্পর্কে কোনও তথ্যই
আমাদের জানা নেই। শোনা যায়, তিনি একজন সাধুর সন্তান ছিলেন। তাঁর
পিতা পদব্রজে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং পথে পীড়িতদের রোগ নির্ণয়
ও শুশ্রুষা করতেন।