বৈশেষিকা সূত্রের আবিষ্কারক হলেন কণাদ
মানুষের এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার
সম্পর্ক কি? এটি খুবই জটিল প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নের সমাধানের জন্য খৃষ্টপূর্ব
৬০০ বছর থেকে ২০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বহু ভারতীয় দার্শনিক অনেক গবেষণা করেছেন।
এইসব দার্শনিকদের মধ্যে প্রথমেই
যার নাম করতে হয়, তাঁর নাম কণাদ (Kanada)।
খৃষ্টপূর্ব ৬০০ সালেই তিনি তাঁর বিশেষিকা সূত্রের অবতারণা
করেন। বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মের সংমিশ্রণ এই সূত্রের সার
মর্মই পরমাণুবাদ। কণাদের সূত্রগুলি সঠিকভাবে বিশ্লষণ করলে দেখা যায় যে তাঁর
পরমাণুতত্ত্ব পরবর্তীকালের লিউসিপাস, ডেমোক্রিটাস ইত্যাদি
গ্রীক দার্শনিকদের পরমাণু তত্ত্ব থেকে অনেক প্রগতিশীল ছিল। তিনিই প্রথম পদার্থের
অবিভাজ্য অংশের নামকরণ করেন, "পরমাণু"।
কণাদের মতে যে কোনও
পদার্থই পরমাণুর সমষ্টি। পদার্থকে যখন ক্রমাগত বিভাজন করা হয়,
তখন শেষপর্যন্ত এমন একটি অংশ পাওয়া যায় আর বিভাজন সম্ভব নয়। এই
অবিভাজ্য বস্তু- কণাকেই তিনি "পরমাণু" বলেছেন। সাধারণভাবে এই পরমাণুর
কোনও একক অস্তিত্ত্ব নেই এবং এই পরমাণু মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও নয়। এই পরমাণু
শাশ্বত ও অবিনশ্বর। ভারতীয় চিন্তাধারা অনুয়ায়ী তিনি বিশ্বের বস্তুপুঞ্জকে পাঁচটি ভাগে
(পঞ্চভূত-ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম) ভাগ করেন এবং বলেন যে পাঁচ শ্রেণীর বস্তুপুঞ্জের
পরমাণুগুলি একে অন্যের থেকে আলাদা। এই পরমাণুগুলির ভিন্ন
ভিন্ন বিশেষ মৌলিক গুণ আছে। এই জন্যই তাঁর সূত্রের নাম ছিল বৈশেষিকা সূত্র। তাঁর
এই অবদানের জন্যই তাঁকে অন্যান্য দার্শনিকদের অগ্রণী বলে ধরা
হয়।
কণাদ বলেছিলেন যে পরমাণুগুলি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণের ফলে একে অন্যের সংগে যুক্ত হয়। একই শ্রেণীর দুটি পরমাণুর সংযোগ একটি দিনুকার (দ্বি-অংগী অণু-binary molecule) সৃষ্টি হয়। এই দিনুকার মধ্যে মূল পরমাণুর বৈশিষ্ট্যগুলি বর্তমান থাকে। বিভিন্ন শ্রেণীর বস্তুপুঞ্জের পরমাণুরা একে অন্যের সংগে বহু সংখ্যায় মিলিত হতে পারে।
কণাদের মতে যে কোনও জিনিসের পরিবর্তনের
মূলে হল তাপ। আর এই তাপের ফলে পরমাণুর বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়। তাপের ক্রিয়ার উদাহরণ হিসেবে
তিনি মাটির পাত্র কালো হওয়া এবং কাঁচা আম পেকে যাবার উল্লেখ করেছেন। এই ভাবেই তিনি
রাসায়নিক পরিবর্তনের ধারণা প্রচলন করেন। কণাদ বলেছিলেন, বিভিন্ন
পরমাণুর বৈশিষ্ট্য,জাতিগত পার্থক্য সংযোজন ক্রিয়ার বৈচিত্র্য
এবং তাপের ক্রিয়াই বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রত্যেকটি বস্তুগঠনের মূল কারণ।
যোগসূত্রের আবিষ্কর্তা পতঞ্জলি
আজকাল পতঞ্জলি নামটি খুবই পরিচিত একটি নাম। বিশেষ করে
যোগাসনের জন্য এবং রামদেবের জন্য। উপনিষদ ও অথর্ববেদে যোগের উল্লেখ
পাওয়া যায়,কিন্তু যোগের মূলতত্ত্ব ও ক্রিয়া কৌশল খৃঃপূঃ
দ্বিতীয় শতাব্দীতেই পতঞ্জলির (Patanjali) যোগসূত্রে পাওয়া
যায়। তাই যোগ যে অতি প্রাচীণ তা এ থেকেই বোঝা যায়। আজকাল তো সারা বিশ্ব এই যোগসূত্রকে
মেনে নিয়েছেন এবং তাই আজকাল বিশ্বযোগ দিবসও পালন করা হয়। এই যোগের প্রচার ও প্রসাসের
জন্য ভারতের নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
পতঞ্জলির মতে শরীরের
কতগুলি নাড়ী এবং চক্র নামে কয়েকটি কেন্দ্র আছে। যদি এগুলিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ
করা যায়,তাহলে শরীরের মধ্যে কুন্ডলিনী
নামক সুপ্ত শক্তির জাগরণে মানুষ "অতিলৌকিক" ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে।
এই বিষয়ে পতঞ্জলি নিম্নলিখিত আটটি স্তরের উল্লেখ করেছেন। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, (ইন্দ্রিয়কে বাহ্য জগৎ থেকে সরিয়ে
অন্তমূখী করা) ধারণা (একাগ্রতা), ধ্যান ও সমাধি। এই আটটি
স্তরের মধ্যে সবশেষের স্তর সমাধিই হ'লো সবচেয়ে কঠিন। এই স্তরে
পৌঁছলে মানুষের ঈশ্বরত্ব লাভ হয়।
পতঞ্জলি যোগের দ্বারা
ঈশ্বরপ্রাপ্তির একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন। মনকে তিনি একটি পরিষ্কার পুকুরের
উপরভাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পুকুরের জলের তলায় যদি কোনও বহুমূল্য রত্ন পড়ে থাকে
তাহলে সেটা আমরা ততক্ষণ দেখতে পাইনা,যতক্ষণ
হাওয়া পুকুরের জলের ওপর আলোড়ন সৃষ্টি করে। হাওয়ার দরুণ পুকুরের জলের ওপর আলোড়ন
সৃষ্টি হলে, জলের তলায় পড়ে থাকা রত্ন দেখতে পাওয়া যায় না।
অথচ জল শান্ত হলেই পুকুরের গভীরে সেই রত্ন স্পষ্ট দেখা যায়। সেরকম ভাবে মনের
বাইরের দরজা বন্ধ করে মনের আলোড়ন শান্ত করতে পারলেই অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা
ঈশ্বরের অনুভূতি পাওয়া যায়।
সম্প্রতি কয়েক দশক হ'লো, বৈজ্ঞানিকেরা যোগের শক্তি সম্পর্কে সচেতন
হয়েছেন। নানারকম মানসিক ও দৈহিক রোগের নিরাময়ে যোগের উপযোগিতা পরীক্ষা, নিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যোগীরা নানারকম ক্ষমতার অধিকারী হন দেখা
গেছে। দেখা গেছে যে বিনা অক্সিজেনে ও বিনা খাদ্যে তাঁরা সাধরণ মানুষের থেকে বেশি
সময় বাঁচতে পারেন। সমগ্র পৃথিবীতে যোগের প্রভৃত শক্তি সম্পর্কে গবেষণা চলছে।
পতঞ্জলির বক্তব্য আজ বহু শতাব্দী পর পন্ডিতদের চিন্তায় যথাযোগ্য স্থান করে নিতে
সমর্থ হয়েছে।
জ্যোর্তিবিজ্ঞানী আর্যভট্ট
যীশুখৃষ্টর
জন্মের প্রায় পাঁচশ বছর পর কুশমপুরের (পাটনা) কাছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খগোল
মানমন্দিরে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের এক নতুন চিন্তাধারার
প্রবর্তনকারী তত্ত্বের জন্ম উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিলো। তারিখটা ছিল
২১ শে মার্চ ৪৯৯ খৃষ্টাব্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘন্টা বাজলো,বেলা তখন বারোটা। সমবেত বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে আকাশ বাতাস ভরে উঠলো। পুরোহিতরা
হোমাগ্নির সামনে পূজার্চনা সমাধা করে এক ২৩ বছরের যুবক
জ্যোতির্বিজ্ঞানী কে বেদীর উপর নিয়ে গেলেন। বেদীর উপর একটি টেবিলে রাখা পুঁথির
কাগজ ও কলমের উপর জ্যোর্তিবিজ্ঞানী পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন; সমবেত জনগণ নীরবে অপেক্ষা
করতে লাগলেন। টেবিলে বসার আগে সস্তোত্রপাঠ করে তিনি সূর্য্য
প্রণাম করে নিলেন। তারপর পুরোহিতদের সুললিত কন্ঠে শ্লোক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কলম
তুলে তিনি এই তত্ত্বের প্রথম অক্ষর পুঁথিতে লিখলেন। অমনি সমবেত পন্ডিতেরা তাঁর ওপর
পুষ্প বৃষ্টি করলেন।
এই তরুণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর নাম আর্য্যভট্ট (Aryabhata) এবং
তাঁর গ্রন্থের নাম আর্যভট্টীয়। আর্যভট্ট ৪৭৬ খৃষ্টাব্দে কেরালায় জন্মগ্রহণ করেন।
পরে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য নালান্দা বিশ্ব বিদ্যালয়ে আসেন। তখনকার দিনে নালান্দা
উচ্চশিক্ষার একটি বড় কেন্দ্র ছিল। তাঁর এই গ্রন্থ যখন গুণীজনের সমাদর পেলো,তখন গুপ্তসম্রাট বৃদ্ধগৃস্ত তাঁকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান পদে সম্মানিত
করেন।
আর্যভট্ট প্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী
গোল এবং নিজের অক্ষরেখার ওপর আবর্তমান। দিন ও রাত্রির সৃষ্টির কারণ এই আবর্তন।
তিনি বলেন যে চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। সূর্যের আলোতে সে আলোকিত। সূর্য্য ও
চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত রাহু গ্রাসের কাহিনী তিনি বিশ্বাস
করতেন না। তাঁর মতে পৃথিবীর ছায়া চাঁদে পড়লে চন্দ্রগ্রহণ এবং চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে
পড়লে সূর্য্যগ্রহণ হয়।
তবে তাঁর ধারণা ছিল, এই ব্রহ্মান্ড
পৃথিবী কেন্দ্রিক অর্থাৎ সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বিভিন্ন
গ্রহের নির্দিষ্ট কক্ষপথ থেকে সাময়িক বিচ্যুতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি গ্রীক
সম্রাট টলেমির মতো "এপিসাইকেল" ব্যবহার করেন। কিন্তু তাঁর পন্থা টলেমির
পন্থা থেকে উন্নততর ছিল।
গণিত শাস্ত্রেও তাঁর অবদান সমান মূল্যবান। তিনি প্রথম
পাইয়ের এর মূল্য ৩.১৪১৬ নির্ধারণ করেন। এবং এও বলেন যে এটি আসন্নমান (approximation value) তিনি প্রথম একটি সাইন (Sine) সারণী লিপিবদ্ধ করেন।
তার তৈরী ax-by = c এর মতো সমাধানের প্রক্রিয়া সমগ্র
পৃথিবীতে স্বীকৃত। ১০০,০০-এর
মত বড় বড় সংখ্যাকে প্রকাশ করার নূতন পদ্ধতির প্রচলন করেন। আর্য্যভট্টীয় গ্রন্হে
গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিম্নলিখিত বিষয় গুলোর উল্লেখ আছে। জ্যামিতি,
আয়তন নির্ণয় (mensuration) বর্গমূল, ঘনমূল, প্রগ্রেশন খগোল ইত্যাদি। তবে এই গ্রন্থটি
খুবই সংক্ষিপ্ত হওয়ায় কিছুটা দুর্বোধ্য।
বৃদ্ধ
বয়সে তিনি আর্যভট্ট সিদ্ধান্ত নামে আরেকটি গ্রন্থ লেখেন। এই গ্রন্থটিতে প্রতিদিনের
জ্যোতিষ ঘটনা এবং শুভ মুহূর্তের নির্ধারণের পদ্ধতি দেওয়া আছে। এখনও আর্যভট্টের রীতি
অনুযায়ী পঞ্জিকা লেখা হয়। গণিত শাস্ত্র ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ
করে ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের নাম আর্যভট্ট রাখা হয়। এসব কারণেই তাঁকে ভারতের
প্রথম জ্যোর্তিবিজ্ঞানী বলে আখ্যা দেওয়া হয়।