গ্রীষ্মের সেই নির্জন দুপুরে আমরা দু’জন ঘুমোচ্ছিলাম। আমি আর আমার বাবা। সেটা ছিল ছুটির দিন। আমার তখন জ্বর চলছে। প্রচন্ড গরমে,মাথার যন্ত্রণায়,গায়ের ব্যথায় মাঝে মধ্যেই আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে গেলে বাবার নাক ডাকা আর বাইরে কাকের ডাক কানে আসছিল। গরম হাওয়া যাতে ভেতরে না ঢুকতে পারে সেজন্য দরজাটা বন্ধ। আমার বেশ স্পষ্টই মনে পড়ে মা সেদিন আমার অন্য ভাইবোনদের নিয়ে কোন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে জনহীন সুড়কির রাস্তা আর একটা ধুতুরা গাছের ডাল ছাড়া কিছু নজরে পড়েনা। ধুতুরার পাতা বড় স্থির।
হঠাৎ কড়ানাড়ার
শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল, বাবার নাক ডাকা থেমে গেল আচম্কা।
বাবা উঠে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলতেই একজন অচেনা লোক ঘরের ভেতরে ঢুকে বলল, “এক গ্লাস জল খাওয়াবেন?”
বাবা ভেতরে
চলে গেলেন। লোকটা কয়েক পা এগিয়ে এসে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কড়িকাঠের দিকে
তাকিয়ে রইল। লোকটির উচ্চতা ছ’ফুটের কম হবেনা। এই প্রচন্ড গরমেও সে পড়েছে কালো
প্যান্ট, কালো কোট। চোখে কাল রোদ চশমা, বয়স
চল্লিশের কাছাকাছি। আমি তার মুখের শুধু একটি পাশ দেখতে পাচ্ছিলাম। দোহারা চেহারার
এই লোকটিকে আমার খুব পরিশ্রমী এবং কঠিন স্বভাবের লোক বলে মনে হচ্ছিল। দৃঢ় কোন
প্রতিজ্ঞার ছাপ যেন তার কপালের প্রতিটি রেখায় এবং মুখাবয়বে স্পষ্ট।
বাবা কাঁচের
গ্লাসে জল নিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালেন। আমি লোকটার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলামনা, কেন জানিনা। তখন লোকটা একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। জলের গ্লাসটা বাবার হাত
থেকে নিয়ে সে একবার মাত্র ঠোঁটে ছোঁয়াল তারপর ঘুরে টেবিলের উপর গ্লাসটা রেখে
আমাদের দু’জনকে হতভম্ব করে দিয়ে লোকটা বাইরে বেরিয়ে গেল। বাবা ও আমি পরস্পরের দিকে
তাকিয়ে রইলাম নির্বোধের মত। অনেকক্ষণ পরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুতে যাবার
সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম,“ বাবা, জলে কি
নোংরা ছিল?” বাবা তখনও বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
শুধু বললেন, “ না।”
* * * *
আমাদের
পরিবারে সুখ এবং শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনাটির পর থেকে সবার অলক্ষ্যে
একটা কালো ছায়া এসে গ্রাস করল আমাদের পরিবারকে। বাবা দিনকে দিন কেমন যেন ম্লান, বিমর্ষ হয়ে পড়তে লাগলেন। আমি প্রায়ই সেই লোকটাকে স্বপ্নে দেখে আঁতকে
উঠতাম। বাবা ছিলেন খুব খোলামেলা প্রকৃতির সাদাসিধে মানুষ। তাই মা-দাদা-দিদি কারোরই
ঘটনাটা জানতে বাকি রইলনা। দরজা জানলা বন্ধ করে গোল হয়ে আমরা সবাই সেই অদ্ভুত
লোকটার সম্পর্কে গভীর আলোচনায় ডুবে যেতাম। লোকটার উদ্দেশ্য কী ছিল, লোকটা কে হতে পারে, কেনই বা সে পরেছিল গরমের দিনেও
শীতের পোষাক, কেন সে জল চেয়েও খেলনা ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে
আমরা জল্পনা কল্পনা করতাম, কিন্তু কোন প্রশ্নেরই আমরা সঠিক
উত্তর খুঁজে পেতামনা । অথচ ঘটনাটা এত সামান্য যে পুলিশে জানানোর কথা আমরা চিন্তাও
করতে পারতামনা।
তারপর একটা
সময় আসত যখন আমরা সবাই একে একে নীরব হয়ে যেতাম। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় সেই বদ্ধ
ঘরে আমরা সবাই অনুভব করতাম একটা অভিশাপ আমাদের পরিবারের উপর নেমে আসছে নিঃশব্দে!
অমঙ্গল চিন্তায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিত; গভীর রাত্রে
দুঃস্বপ্নে চিৎকার করে উঠতাম আমি কিংবা দিদি।
আমার তখন বয়স
ঠিক বারো বছর। লুকিয়ে লুকিয়ে স্বপনকুমার-এর ডিটেকটিভ বই পড়ি। মনে মনে স্থির করে
ফেললাম যেভাবেই হোক, যে কোরেই হোক এই লোকটাকে আমি খুন করব
কারণ এই মানুষটা তার দু’মিনিটের উপস্থিতিতে আমাদের পরিবারের সুখ এবং শান্তিকে
হত্যা করেছে।
চৈত্র বৈশাখের
সেই ওলট পালট হাওয়ায়, আমি এক ছোট্ট মানুষ, প্যান্টের পকেটে একটি ছুরি লুকিয়ে রেখে স্কুল পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায়,
স্টিমার ঘাটে, খেলার মাঠে, সিনেমা হলের সামনে, রাজনৈতিক বক্তৃতার মাঠে, জনসমাগমের প্রতিটি স্থানে খুঁজে ফিরেছি সেই লোকটাকে। কালো চশমা পড়া
দীর্ঘদেহি কোন লোক দেখলেই নিঃশব্দে আমি এসে তার পাশে দাঁড়াতাম। প্যান্টের পকেটে আমার
দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাতের মুঠোয় ছুরিটা থর থর করে কাঁপতে থাকত।
কিন্তু হায়!
কালো চশমা পরা দীর্ঘকায়, রহস্যময় সেই অচিন পুরুষকে আমি আর
কোনদিন খুঁজে পাইনি।
- - -
লেখক পরিচিতি