লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
বেলা একটা। গাড়িটা ঢাকুরিয়ার সেলিমপুরের মোড়ে এসে দাঁড়ালো।
প্রবীর স্ত্রীকে বললো,"
তুমি কোনো কথা বলো না, যা বলার আমিই বলবো।" স্ত্রী নীলা বললো "যদি
রিফিউজ করে তখন আমাকেইতো এগিয়ে যেতে হবে নাকি?
আসল সময়ে তোমার মুখেতো কথাই ফোটে না। টু
দা পয়েন্ট আন্সারও দিতে পারো না। তার উপর
বড়দার সম্মুখে দাঁড়ালেইতো তুমি কাঁত।"
"সে আমি ম্যানেজ করবো, তুমি
সর্বক্ষণ বোবা,মনে থাকে যেন। বড়দার মায়ের প্রতি একটা
আলাদা সিমপ্যাথি আছে। আমাদের বেশি বাক্য ব্যয় করতে হবে না।"
ডিসেম্বরের শেষ। ঝলমলে রোদের আকাশ,তবু এতটুকু কষ্ট নেই। গাড়িটা
একটি গলির মধ্যে কিছুটা গিয়ে একটি তিনতলা বিল্ডিংয়ের সম্মুখে দাঁড়ালো। একতলায়
থাকেন, শ্রী সুবীর রায়। প্রবীরের বড়দা। অধ্যাপক। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। মেধাবী।
কিন্তু সংসারের সমস্ত দ্বায়িত্ব স্ত্রী সুলতার। তিনি শুধু নিজের পড়াশুনা এবং
সুলতার হুকুম তামিল করা মুখ্য কাজ।
প্রবীর কলিং বেল টিপে নিজেকে তৈরি
করছে, কি ভাবে শুরু করবে। একটু যে টেনশন হবে তা বলাই বাহুল্য। ওদিকে গাড়িতে
অপেক্ষারত স্ত্রী এবং মা।
বড়দাই দরজা খুললেন,"কিরে এই দুপুর টাইমে? কি
ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো?"
"হ্যাঁ বড়দা,সব ঠিক আছে। আমরা কয়েক দিনের জন্য একটু বাইরে যাবো। তাই মাকে তোমার
কাছে রেখে যাচ্ছি।"
"ও, কোথায় যাবি? মাকে
গাড়িতে বসিয়ে রেখেছিস কেন? নিয়ে আয়। "
তিরাশি বছরের বৃদ্ধা। এখনো যথেষ্ট
শক্ত-সামর্থ।
মুখে সর্বদা অমায়িক হাসিটি লেগে আছে। এক সন্তানের থেকে আরেক সন্তানের বাড়ি যাচ্ছে,
তাঁর দুঃখ কিসের।
বৃদ্ধার তিন পুত্র। তিনজনেই
কলকাতার বুকে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। দেশের বাড়ি বর্ধমান জেলার বলগোনা। বছর
দশেক আগে স্বামী গত হন। তারপর থেকেই মায়ের দ্বায়িত্ব ছেলেরা ভাগাভাগি করে নেয়। রীতিমত
মিটিং করে, দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় যে এক-এক ছেলের বাড়িতে চার মাস
করে মা থাকবেন। বড় মেজ ঠিক আছে । ছোটটি একটু গড়বড় করে। ক্লাস ফাইভ থেকে হোস্টেলে
থেকে পড়াশুনা করেছে। ফলে মা-বাবার প্রতি দয়া-মায়া একটু কম। এছাড়া নীলার কথাই শেষ
কথা। নীলা মনক্ষুন্ন হবে এমন কাজ সে জীবনে করতে পারবে না। চার মাসের মেয়াদে দেড়
মাসের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই এই ছলাকলার আশ্রয়। মেজ ভাই নিবির এমনিতে ঠিকই আছে। তবে একটু নাক উঁচু। মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির বড় অফিসার। বউ-টাও নাকি
অফিসার। বাঙালি মেয়ে, অথচ বাড়িতেও নাইন্টি পার্সেন্ট ফ্লুয়েন্ট ইংলিশ বলে। শাশুড়ি
মায়ের তাতেই অস্বস্তি। তাঁর তো ক্লাস সেভেন পর্যন্ত বিদ্যে। তার উপর পড়ালেখার পাঠ
কবেই চুকেবুকে গেছে। বাংলা বই বা বাংলা
পেপারটা নিয়মিত পড়েন কিন্তু ইংরেজি ভাষাটা
মাথা থেকে কবেই উবে গেছে। তাই তিনিও মেজর কাছে থাকতে সচ্ছন্দ বোধ করেন না।
মাস তিনেক আগের ঘটনা। বাড়িতে এক পার্টির আয়োজন করেছে। সেখানে অফিসের টপ বস থেকে
শুরু করে বিভিন্ন ক্যাটাগরির অফিসাররা থাকবে। কর্পোরেট অফিস বলে কথা। তার ঠাটবাটই
আলাদা। একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রেস্টিজ ডুম। এখন শাশুড়ি
মাতা কে নিয়ে সমস্যা। এনাকে নিয়ে কি করা যাবে। শেষমেষ অবশ্য রাস্তা বেরিয়ে আসে। টপ ফ্লোরে একটি রুম আছে। কারো গেস্ট এলে ঐ
ঘরে থাকে। তা সন্ধের আগে আগে তাঁকে খাইয়ে-দাইয়ে ওই রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা
দিয়ে দেওয়া হয়। যাতে হঠাৎ কোনো প্রয়োজনে নিচে
নেমে আসতে না পারেন। ঘরটি অবশ্য এটাচড বাথ। অর্থাৎ কোনো অসুবিধা নেই। মাও স্বস্তি
পেলেন বলা যায়। কারণ তিনিও তাদের সম্মুখে থাকতে চান না।
গভীর রাত অবধি পার্টি চলে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেছে প্রায় নটা। তাড়াহুড়ো করে স্নান খাওয়া করে অফিস চলে যায়।
দুজনেই ফিরেছে রাত আটটা। ক্লান্ত শরীর। একটু আর্লি ডিনার করে বিছানায় সটান। পরদিন
ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটা। তখনই খেয়াল হয়,আরে! মাতো গেস্ট রুমে রয়ে গেছেন। আর অবশ্য
দেরি করেনি। সঙ্গে সঙ্গে টপ ফ্লোরে গিয়ে তালা খুললো। দেখে মা বিছানায় লক্ষ্মী
ঠাকুরের মত বসে আছেন।
নিবির বললো," মা, খিদেতে
খুব কষ্ট পেয়েছ ,না?"
মা মুচকি হেসে বললেন, নারে খুব
কষ্ট হয়নি। দেখলাম এখনো আটচল্লিশ ঘন্টা উপোস দিয়ে থাকতে পারি। বলেই সেই অমায়িক
হাসি।
এদিকে সাত দিন কেটে যাওয়ার পর
বড়দা,অর্থাৎ
সুবীর মাকে নিয়ে চলল ছোট ভাইয়ের কাছে রাখতে। ইচ্ছে ছিল,কলেজ
থেকে ফিরে মাকে দিয়ে আসবে কিন্তু স্ত্রীর হুকুম, মাকে আগে পৌঁছে দিয়ে কলেজ চলে
যাবে।
ছোট ভাই প্রবীর ও নীলা একটু মার্কেটে গিয়েছিল। ফ্লাটের ক্যাম্পাসে ঢুকতে
গিয়ে দেখে বড়দা মাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু আড়ালে চলে গেল এবং মোবাইল
দুটোর সুইচ যথারীতি অফ হয়ে গেল। অগত্যা
বড়দা আর কি করবেন? মাকে নিয়ে আবার বাড়ি। কলেজ যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু উপায়
কি? বাড়ি ফিরে মাকে রেখে ছুটল কলেজে। স্ত্রীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে,মুখে কোনো কথা নেই। মা ঘরে গিয়ে
বিছানায় বসে আবার সেই অমায়িক হাসি।
সমাপ্ত
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।
তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।
তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।
Tatkhanik digital bengali online e magazine