Advt

Advt

baro-maa-galpo-golpo-story-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-বড়মা-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

baro-maa-galpo-golpo-story-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-বড়মা-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

বাহাত্তর পেরিয়ে এসেছি। আজও একটু সময় পেলে এই বড় বাড়িটার ভেতর শিউলি গাছটার নীচে এসে দু'দণ্ড দাঁড়াই। কত কথা মনে এসে ভিড় করে। যেন সেই দিনের ঘটনা। শরৎকালের আকাশ, মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখলেই বড়মাকে খুব মনে পড়ে।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা।আমাদের পাড়ায় প্রাসাদসম একটি বাড়ি আছে। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বড় লোহার গেট। সবাই বলে সাহেবের বাড়ি। ড্রাইভার, দারোয়ান, চাকর-বাকর --- সকলের পোশাক-আশাক একেবারে টিপটপ, ফিটফাট।  অনেকটা জায়গা নিয়ে ফুলের বাগান। চারজন মালি সারাক্ষণ পরিচর্চা করে।

আমি তখন বড় হয়ে গেছি। কলেজে পড়ি। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করি, এবার পাড়ার দুর্গাপুজোর সমস্ত ফুল সাহেবদের বাগান থেকে চুরি করব। স্থলপদ্ম, বড় বড় দু'টো শিউলি ফুলের গাছ, সার সার গাঁদা, গোলাপ, টগর আরও বহু ফুল।

রাত তখন তিনটে। আমরা পাঁচবন্ধু। তিনজন প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে গেছি। বাইরের দু'জনকে ফুল তুলে তুলে দেব। অপারেশন শুরুও করে দিয়েছি। তখনই হঠাৎ বাগানের লাইটগুলো পটাপট জ্বলে উঠল। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তারপরেই দেখি, চারজন মালি ও দু'জন দারোয়ান আমাদের ঘিরে ফেলেছে। থরহরি কম্পন কাকে বলে সেইদিনই প্রথম টের পেলাম। ভয়ে কুঁকড়ে আছি। একজন দারোয়ান বলল, এদের বেঁধে সাহেবের কাছে নিয়ে চল। তারপর থানায় চালান করে দেব। কিছুদিন জেলের ঘানি টানলেই চুরি করার শখ জন্মের মতো ঘুঁচে যাবে।"  আমি বললাম," সামান্য কয়েকটা ফুল পুজোর জন্য নিতে এসেছি। এরজন্য আমাদের চোর বলছেন কেন?"

দারোয়ান চিৎকার করে উঠল, " এই গভীর রাতে প্রাচীর টপকে ঢুকেছিস, আবার বলছিস চোর নয়। এই এদের বেঁধে নিয়ে চল।"

থানা, পুলিশ, জেল -- এসব শুনে শরীরের শক্তি যেন নিঃশেষ। লঘু পাপে গুরু দন্ড হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি।

এমন সময় এক বয়স্কা মহিলা এলেন। বয়স হলেও বোঝা যায় একসময় অনিন্দ্যসুন্দরী ছিলেন। তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, " তোমরা ঠাকুরের জন্য ফুল নিতে এসে চোরের মতো প্রাচীর টপকে কেন এলে বাবা। অন্যায় করেছ, আর কখনো এমন করবে না। যাও, যা ফুল দরকার নিয়ে যাও। কাল থেকে দারোয়ানকে বলে গেট দিয়ে ঢুকবে। পুজোর ফুল নিয়ে যাবে।"

এত সহজে যে মুক্তি পাব কল্পনাও করিনি। তারপর থেকে সাহেবের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। চায়ের নিমন্ত্রণ, লাঞ্চ, ডিনারের নেমন্তন্ন লেগেই থাকত। আমরা ওঁকে বড়মা ডাকতাম। তিনিই বলেছিলেন, আমি তোদের মায়ের থেকেও বড়, তাই বড়মা বলে ডাকবি। পরে জেনেছিলাম, সাহেব ইংরেজ হলেও বড়মা খাঁটি বাঙালি। বন্ধুদের মধ্যে আমাকে একটু বেশি ভালবাসতেন। একদিন রাতে আমাদের সবার নেমন্তন্ন। গিয়ে দেখি জন্মদিনের উৎসব। কেক কাটা হবে। সাহেব বললেন, " অখিল, তুমি কেক কেটে স্টার্ট করো।"

আমি অবাক ! আমি কাটবো?

সাহেব বললেন," ইয়েস মাই সান, তুমিই কাটবে।" বড়মাও ইঙ্গিতে সম্মতি দিলেনসেদিন সাহেবের যে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখেছি, কখনো ভোলার নয়। পরে জেনেছি, সাহেব-বড়মায়ের একমাত্র ছেলে চাকরি নিয়ে কানাডায় চলে গেছে। আর ফেরেনি। যোগাযোগও রাখে নি। সেই হাহাকার, শুন্যতা প্রতিনিয়ত টের পেতাম।

 হঠাৎ একদিন সাহেব হার্ট ফেল করে মারা গেলেন। এত বড় বাড়িটাতে বড়মা ও কয়েকজন চাকরবাকর। আমরা একপ্রকার স্নেহের টানে প্রতিদিনই একবার করে যেতাম। আমরা ছাড়া কে দেখবে তাঁকে? তিনি একদিন প্রস্তাব দিলেন, পাড়ার বারোয়ারি দুর্গাপূজাটি ওদের ক্যাম্পাসের ভেতর করার জন্য। সমস্ত খরচ তিনি দেবেন। প্রথমে খ্রিস্টান বলে অনেকে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বড়মা বললেন, আমি ঠাকুরের কোনও কিছুই স্পর্শ করব না। তোরাই সব করবি। পরে সকলে সম্মতি দিয়েছে শুধু নয়, বড়মাকেও কাছে ডেকে নিতেন। সেই বড়মাও সকলকে অবাক করে দুর্গাপূজোর দশমীর দিন চলে গেলেন। অনেকে বলেন, তিঁনিও মায়ের অংশ ছিলেন। বড়মায়ের ইচ্ছে , এই বাড়িতে বহু মানুষের সমাগম হোক। আমাদেরকেই জায়গাটি দান করে দেন। বড়মা বেঁচে থাকতেই একটি দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে ওঠে। আর দুর্গাপূজাটি মহা ধুমধাম করে আজও হচ্ছে।

লেখক পরিচিতি: 

জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।

তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট,  দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর  ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।

তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। 

Tatkhanik digital bengali online e magazine