লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
ভারতীয় জীবন ও
সংস্কৃতিতে রাম ও রামায়নের আসন চিরকালের জন্য পাতা । বাল্মীকির রামচন্দ্রকে তারা
ভক্তিভরে প্রনাম করেন,তুলসী দাসের রঘুরাইকে
পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরতে চান। উত্তর ভারতের গ্রামে বা শহরে,মন্দিরে বা নদীতীরে,প্রভাতের প্রথম আলোয় বা
সন্ধ্যাকালে পাঠক সুর করে বর্ননা করেন সেই মুহুর্তের কথা,যখন
হনুমান অশোক বনে নির্বাসিতা সীতার কাছে রামের অঙ্গুরী এনেছেন,যা দেখে সীতার হৃদয় হরষ ও
বিষাদে আকুল হয়ে উঠেছে -
তব দেখি মুদ্রিকা মনোহর
রামনাম অঙ্কিত অতি
সুন্দর ।
চকিত চিতব মুদরী পহিচানী
হরম বিষাদ হৃদয়ে অকুলানী ।।
শ্রোতা ও পাঠকের মন সমানভাবে আর্দ্র হয়ে ওঠে,যেন নিজের কন্যার বেদনা ছুঁয়ে গেল পিতা মাতার হৃদয়ে। আবার সীতা হরণের পর শূন্য কুটির দেখে যখন হাহাকার করে ওঠেন কমললোচন শ্রী রামচন্দ্র,বনের পশু পাখীর সঙ্গে চোখের জল ফেলেন রামায়নের পাঠক।
কান্দিয়া বিকল রাম,জলে ভাসে আঁখী রামের ক্রন্দনে কান্দে বন্য পশুপাখী । রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন,“রাম যে
একইকালে আমাদের কাছে দেবতা ও মানুষ,রামায়ন যে একই কালে
আমাদের কাছে ভক্তি ও প্রীতি পাইয়াছে,ইহা কখনোই সম্ভব হইত না
যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেই সামগ্রী হইত,যদি তাহা আমাদের সংসার সীমার মধ্যেও ধরা না দিত ।
আজ সীতাকে নিয়ে আলোচনা
করব। কখনো সীতাকে আমরা বলেছি জনমদুখিনী,কখনো
বলেছি সীতা এক সাধনা। সীতা রামময় জীবিতা। সীতাকে নিয়ে অনেক রকম কথা আছে। মধ্য
প্রদেশের এক জনজাতি বরজ ভুর্জানদের রামায়নে সীতা হলেন কৃষির দেবী।
আনন্দ রামায়নে আছে
বিষ্ণু জলন্ধর অসুরের স্ত্রী বৃন্দার সতীত্ব হরন করেন। বৃন্দা বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন
সাধারন মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ বেদনা সইতে হবে ।
অদ্ভূত রামায়নে আছে
নারদ ও তার মামা পর্বতের মধ্যে অম্বরীশের কন্যাকে-কে গ্রহণ করবেন তাই নিয়েও দ্বন্দ হয়। স্বয়ংবর
সভায় নারদ ও পর্বত উপস্থিত হলেন কিন্তু কন্যাটি বিষ্ণুকেই স্বামীরূপে বরন করেন।
নারদ বিষ্ণুকে অভিশাপ দিলেন ধরাতলে জন্ম নিয়ে পত্নী বিচ্ছেদের দুঃখ ভোগ করতে হবে
।
আবার এ কাহিনীও আছে
লক্ষ্মী দেবী নারদকে অপমান করলে তিনি অভিশাপ দেন যে
ধরায় গিয়ে রাক্ষসরাজ রাবনের স্ত্রী মন্দোদবীর গর্ভে জন্ম নিতে
হবে।
বহ্নীপুৱান অনুযায়ী ধরিত্রীদেবী একবার বিষ্ণুলোকে
উপস্থিত হলে লক্ষ্মীদেবী তার উপর বিরক্ত হন। লক্ষ্মীর বিরক্তি দেখে ধরিত্রীদেবীও
অপমানিতা বোধ করেন। তিনি লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেন যে ধরায় জন্মে তাকে স্বামী বিচ্ছেদের জ্বালা সহ্য করতে
হবে ।
তত্ত্বসংগ্রহ রামায়নে
আছে রামায়নের সৃষ্টিকর্তা বাল্মীকি এক সময় সমুদ্রের ধারে বসে তপস্যা করছিলেন।
সমুদ্রের গর্জন-এর ফলে তপস্যায় বিঘ্ন হলে তিনি
বলেন “লক্ষ্মীকেই আমি কন্যারূপে লাভ করতে চাই।“ লক্ষ্মী সাধনায় সন্তষ্ট হয়ে তাঁকে দেখা দিলে তিনি বলেন যে লক্ষ্মীকে তিনি কন্যারূপে পেতে চান। মাতা লক্ষ্মীদেবী তখন বলেন,ত্রেতাযুগে বিষ্ণু দশরথপুত্র রাম হয়ে জন্মাবেন আর আমি জনকরাজার কন্যা
সীতারূপে তার ঘরনী হব। রাজা রাম আমাকে বনবাসে পাঠালে আমি তোমার আশ্রমে কন্যার মত বসবাস করব।
বাল্মীকি রামায়নে
বেদবতীর কথা আছে। সেই অনুসারে সীতা পূর্ব জন্মে ছিলেন রাজা কুশধ্বজের কন্যা। একদা রাবন বেদবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর হাত ও চুল স্পর্শ
করেন। বেদবতী রাবনকে অভিশাপ দেন “আমি পরজন্মে অযোনীসম্ভূতা
নারী হয়ে জন্মাব,তোমার বিনাশের কারন হব”।
অসমে প্রচলিত রামায়নে
আছে,লক্ষ্মীদেবী
পৃথিবীতে এসে এক পর্বতচূড়ায় অবস্থান করছিলেন। তাঁকে দেখে সেখানে রাবন এলে দেবী
ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন তোমার এতবড় সাহস,তোমাকে
বধ করবার জন্য বিষ্ণু পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেছেন -এই বলে তিনি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে
ধরিত্রী মাতা তাকে গ্রহন করলেন। পরে এই ধরিত্রী কর্ষনের সময় কন্যারূপে সীতার জন্ম
হয়।
তার জন্ম ও মৃত্যু দুইই
রহস্যাবৃত। তিনি ধরিত্রী থেকে জন্মগ্রহন করেন আবার ধারিত্রীমাতার কোলেই বিলীন হন ।
বালিকা বয়সে সীতা পক্ষীমুখে রামায়ন শুনে চমৎকৃতা হয়েছিলেন। সর্বদা রামনাম শ্রবনের
মানসে পাখিটিকে তার সখীর সাথে উড়ে যেতে দিলেন না। তার সঙ্গী
উড়ে চলে গেলে স্ত্রী পক্ষীটি দুঃখিত অন্তরে সীতাকে বলে,"আমি অন্তঃস্বত্তা,এই অবস্থায় আমাকে তুমি সঙ্গীহারা
করলে, তুমিও অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হবে "- এই বলে পক্ষীটি প্রাণ ত্যাগ করে।
আমাদের মহাকাব্যে নারীদের বিভিন্নভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। নারদমুনি রামকে বলছেন, হে রাম,যত পুরুষ সব তুমিই,সীতাই
যত স্ত্রীলোক। হনুমানের ল্যাজের আগুনে নয় সীতার নিঃশ্বাসে আর রামের কোপে লঙ্কা দগ্ধ
হয়েছিল ।
ধরার ধূলি হতে উৎসারিত অলৌকিক
এক আবির্ভাব। রাজা জনক খুব অল্প কথায় মুনিবর বিশ্বমিত্রকে জানাচ্ছেন আকস্মিক প্রাপ্তি: ক্ষেত্র শোধন করবার সময় লাঙ্গলের অগ্রভাগ থেকে একটি কন্যা উঠে এল। সীতা নামেই সে পরিচিতা । মাটি থেকে উঠে এলেও সে আমারই কন্যা।
কিন্তু প্রকৃতই কি
এ প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই? মা তুমি চির
রহসময়ী। রহস্যের অন্তরালেই থাকো মা । রাম ও সীতা দুজনের বংশলতিকা রয়েছে বহুকাল
ধরে। হাজার হাজার বছর ধরে। সারা রামায়ন জুড়ে রয়েছে অজস্র
দেবদেবী,মুনিঋষি,যক্ষ-রক্ষ,পশু পাখীদের তপস্যা, সাধনা, সিদ্ধি,
বরপ্রাপ্তি আর শাপ শাপান্তু। অভিশাপ এমন এক
সর্প,যা ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে পড়লেই ছোবল মারবে । শাপ আর সাপে
বিশেষ কোন তফাৎ নেই তবে শাপমুক্তি কিভাবে ঘটবে তার নিদানও আছে ।
লক্ষ্মীর সভায়
নিমন্ত্রত নারদ উপযুক্ত সমাদর না পাওয়ায়
লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন রাক্ষসী গর্ভে জন্ম নিতে হবে ।
লক্ষ্মী অপ্রস্তুত হয়ে
অনুরোধ করেছিলেন যে রাক্ষসী নিজের ইচ্ছায় মুনিদের শোনিতে পূর্ন কলস থেকে শোনিত
পান করবে আর আমি সেই তার গর্ভে উৎপন্ন হব! শুক্র শোনিতে আমার যেন জন্ম না হয়।
সীতার জন্য কথা নিয়ে যত
কথাই থাকুক না কেন সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ এককথায় প্রকাশ করে দিলেন
- প্রেম,দুঃখ,সহিষ্ণুতার
আকর - সীতা জন্মদুখিনী,সীতা জনকরাজ
নন্দিনী,রামময় জীবিতা,দেবী,মানবী ।
মানবশরীর ধারন করলে
পঞ্চভূতে তৈরী খাঁচাটাকেও স্বীকার করতে হবে।
মানুষের সুখ দুঃখ জরা ব্যাধি শোকতাপ সবই থাকবে। পিতা দশরথের কর্মফল হল রামের ভাগ্য
আর রামের কর্মফল হল সীতার ভাগ্য। মানব মানবীরূপে রামসীতা জগতের নাগশাপে বাঁধা এক
মহা যন্ত্রনা। সীতা ধরনীর ধূলা আর সেই ধূলাই হবে রামের অঙ্গরোগ ।
চিত্রকুটে প্রত্যন্ত
পর্বতময়
নির্জন প্রদেশে
স্ফটিকশিলায়
সীতা ক্রোড়ে রাখিয়া
মস্তক
নিদ্রিত রাঘব ।
বরষিছে বৃক্ষদল কুসুম
নিচয়
শ্রীরামের শ্যাম কলেবরে
।
(ওঙ্কারনাথ)
মানুষের মধ্যেই ভগবানের শোভা প্রকাশিত হয়। দুঃখের অশ্রুতে মুক্তঝবে,হাহাকারে জ্বলে শ্মশানচিতা। প্রেম বিরহ বিচ্ছেদে রচিত হয় মানবজীবন। তাই সীতাকে হরন করবে লঙ্কার রাজা রাবন। অসহ্য নির্যাতন সীতার কপালের লিখন। রাম কিন্তু বিদ্রোহী হবে না ।
সীতা রামকে পরিত্যাগ
করবেনা,কারন সম্পর্কের বন্ধন। রাম
ভূস্বামী হয়ে রাজছত্রতলে সিংহাসনে বসতে চায় না। সে বসতে চায় মানুষের হৃদয়ের
সিংহাসনে। রাম কি শুধুই দশরথ পুত্র অযোধ্যার রাজা? রাম যদি রামের মত না হয় তবে যুগান্তরে ভক্ত তুলসীদাস জগৎকে কেমন করে শোনাবে এই দোঁহা-
এক ঘড়ি আধি ঘড়ি,আধি হুমে আধ
তুলসী সঙ্গত,সন্তুকি,হরে কোটি অপরাধ
অশোক বনে সীতার দুঃখে কবিবর মধুসূদন দত্ত রচনা করেছেন চারিদিকে এক কোমল করুন বেদনা বিধুর পরিবেশ -
একাধিনী শোকাকুলা,
অশোক কাননে,
কাঁদেন
রামববাহণ আঁধার কুটিরে ।
নীরবে দুরস্ত চেড়ী সতীরে
ছাড়িয়া
ফেরে দূরে মত্তসবে উৎসব কৌতুকে
-
হীন-প্রানা হরিনীরে
রাখিয়া বাঘিনী
নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর
বনে
মলিনবদনা দেবী, হায়রে, যেমতি
খনির তিমির গর্ভে (না পারে
পশিতে)
সৌর কর রাশি যথা সূর্যকান্ত
মনি
কিম্বা বিম্বধরা রমা অম্বুরাশি
তলে।
পঞ্চবটী বনে রাম ও সীতার জীবন একটি দ্বৈতসংগীতের মত বেজে উঠেছিল । সরমার কাছে সীতা সেই কাহিনীই ব্যক্ত করেছেন ।
* (ছিনু
মোরা,সুলোচনে,গোদাবরী তীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চ
বৃক্ষ চূড়ে
বাঁধি নীড়,
থাকে সুখে, ছিনু ঘোর বনে,
নাম পঞ্চবটী,
মর্ত্যে সুর-বন-সম।
………………………………
সরসী আরসি মোর তুলি কুবলয়ে
(অমূল্য রতনসম) পরিতাম কেশে
সাজিতাম ফুলসাজে; হাসিতেন
প্রভু
বনদেবী বলি মোরে সম্ভাষি
কৌতুকে।)
বাল্মীকি যেমন সীতার
জন্য বেদনার্ত,মধুসূদনও তাই। সীতার মধুর
দাম্পত্য জীবন বর্ননায় মধুসূদন তার সব সহানুভূতিটুকু নিঃশেষে উজাড় করে দিয়েছেন
।
কবিতব মনোভূমি রামের
জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো ।
সীতাসহ রাম এসেছেন চিত্রকূটে বাল্মীকির আশ্রমে। এত সুন্দর পরিবেশ যেন স্বর্গের একটি খন্ড। বৃক্ষরাজি,ফলফুল,পক্ষীনিনাদ,নির্ভয় হরিনের বিচরন। মধু সন্ধানী ভ্রমরকূল,মহামুনিকে প্রণাম করে শ্রীরামচন্দ্র বললেন,আমাদের পরিচয় আপনি জানেন। কেন এসেছি তাও আপনার অজানা নয়,আগামীতে কি হবে আপনি লিখে রেখেছেন,বাল্মীকি বললেন,আজ সশরীরে সদলে আপনার আগমন,পূর্ন হল এই ভূমি আপনার পদাচিহ্ন ধারন করে,স্রষ্টার সমনে আজ সৃষ্টি এসে উপস্থিত ।
নারদ বললেন,
আমি বিদায় নেব, তার আগে রাম আপনি আমার একটি ভয়ঙ্কর
প্রশ্নের সমাধান করুন - "রাম কি নিষ্ঠুর, সেকি তার জীবন
সঙ্গিনীকে নানা পরীক্ষার মধ্যে ফেলে নিজের পুরুষাধিকার
প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। সীতার শক্তিকে খর্ব করেছেন।”
উত্তর দিলেন বাল্মীকি,
"রাম সীতা তো পৃথক সত্ত্বা নয় । রাম হল
আগ্নি আর সীতা তার দাহিকা শক্তি,অগ্নিতে অগ্নি প্রবেশ করলে
দাহিকা শক্তি বৃদ্ধি পায়। সীতার উজ্জ্বলতা ছেড়ে যায়। চোদ্দ বছর পর রাম ফিরেছেন
অযোধ্যায়। রাজাসনে রাম,রাজা দশরথ এই উৎসব দেখেযেতে পারেননি।
সব লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল কর্মদোষে। চোদ্দ বছর অযোধ্যা যেন দমবন্ধ করে ছিল। মৃত
নগরীতে প্রান ফিরে এল ।
রামের বীরত্ব কথা আকাশে
বাতাসে। সশিষ্য মুনিরা এসেছেন,তাঁরা
রাম চন্দ্রের অসীম বীরত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাক্ষসরাজ রাবনের ত্রাসমুক্ত
হয়েছে পৃথিবী,আর আমাদের সীতা মাকে অসহ্য কষ্ট নির্যাতন সহ্য
করতে হয়েছে। সীতা এইসব প্রশংসা বাক্য শুনে মিটিমিটি হাসছেন, হাসির কারন জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন পৃথিবীতে ও দুই রাবন,একজন দশমাথা লঙ্কার রাজা আর এক রাবন সহস্র মাথা পুষ্করে বাস,তাকেও নিধন করা হোক। পৃথিবী ত্রাসমুক্ত হোক তবে তো রামের প্রশংসা,তবে তো পৃথিবীর
শান্তি। সীতার কথা শুনে রাম উত্তোজিত হয়ে সমরসজ্জার আদেশ
ছিলেন। বললেন আজই যাত্রা করব সহস্রমাথা
রাবনকে সহস্রমাণ বধ করতে। সবাই রনসাজে সজ্জিত হলেন। আবার যুদ্ধ (অতর্কিত আক্রমনে সহস্রমাথা রাবন হতচকিত, রাম ঘোষনা করলেন তোমার অনুজ দশমাথা রাবন রামভার্যা সীতাকে অপহরন করছিল বলেই তাকে নিহত করে সীতা
উদ্ধার হয়েছে । আজ রাম,সীতা,বিভীষন,ভ্রাতৃগন,বানর,মনুষ্যগন পরিবৃত
হয়ে তোমাকে বধ করবে। রাবন বায়ব্যবাণ নিক্ষেপ করলে সবাইকে
স্ব স্ব স্থানে উড়িয়ে নিয়ে গেল। রইল শুধু একেবারে একা রাম ও সীতা। সহস্রবদন
রাবনের হুঙ্কার দিল,
- রাম,তুমি
আমার ভাইকে হত্যা করেছে আজ আমি তোমাকে হত্যা করে ভাতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেব। আজ
তোমার রক্তে আমার ভ্রাতার তর্পন করবো।
সহস্ররাবন রামচন্দ্রের প্রতি
ক্ষুরপ্রবান নিক্ষেপ করলে তা রামের বক্ষোভেদ করে পাতালে প্রবেশ করল,রাম তখন সঙ্গাহারা হলেন, দানবের
উল্লোসিত নৃত্য চলতে লাগলে। ত্রিলোক বিস্মিত,মুর্ছিত রামচন্দ্রের দিকে সীতা তাকালেন তারপর অট্টহাস্য করে উঠলেন । তার
রূপ সম্পূর্ন বদলে গেল। কেমন সে রূপ ?
ক্ষুৎকামা কোটরাক্ষী চক্রক্রমিতলোচনা,দীর্ঘ জঙ্ঘা মহারাধা মুক্তমালা বিভূষনা । অস্থি কিঙ্কিনিকা ভীমা ভীম বেগ পরাক্রমা, খরস্বনা মহাঘোরা, বিকৃতা বিক্রিতাননা। এই ভয়ঙ্করী একলাফে সেই সহস্রবদন রাবনের সামনে গিয়ে একে একে সবকটি মুন্ডচ্ছেদন করলেন। সে এক ভয়ঙ্কর রূপ ।
তাঁর বিরাট বিশাল
ঘূর্নায়মান শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন মাতৃকাগন প্রভাবতী, বিশালক্ষ্মী, কমলাক্ষ্মী, শোভনা
…………………………………
ইত্যাদিরা।
পৃথিবী কাঁপছে,
ভূতল রসাতলে প্রবেশের আশঙ্কা,মুনিরা সন্ত্রস্ত,দেবতারা অসহায় দর্শক, সবার প্রার্থনায় মহাদেব এলেন,তিনি জানেন এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে শান্ত করার কৌশল, রনরঙ্গিনী
মায়ের পদতলে তিনি বুক পেতে দিলেন,নিমিষে সব শান্ত।
রণক্ষেত্রে রুধিধারার মাঝে শিব বক্ষে ধীর স্থির,ব্রহ্মা স্তব
করছেন,রঘুনন্দন রাম শক্তিসমূহের আধার,তুমি
দেবী বিশ্বেশ্বরী, তুমি শান্তি হও মা,পৃথিবী
শান্ত হোক,উগ্রমূর্তি সীতা বললেন,শান্তি!রাক্ষসের ক্ষুরপ্রবানের আঘাতে আমার স্বামী অচৈতন্য এখন,কিসের শান্তি? আমি একগ্রাসে জগৎকে গিলে ফেলব,
মহাকাল নৃত্য করবে ।
ধীরে ধীরে চোখ মেলছেন
রঘুবীর,সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন পরমেশ্বরী,জ্যোতির্ময়ী। রামচন্দ্র সীতার প্রকৃত রূপ দর্শন
করছেন আর পুলকিত হচ্ছেন। রামচন্দ্র আর মহাযোদ্ধা নন,নতজানু হয়ে এক উপাসক ।
শান্ত,স্তব্ধ পরমেশ্বরী সীতার কণ্ঠস্বর বায়ুমন্ডলে মুখর
হল: পৃথিবীর সূর্য একটাই। রাম তুমি উদয়,আমি অস্ত,পূর্বদিক তোমার,পশ্চিমদিকের
ভূমি আমার,আকাশ তোমার,তুমি আমাকে ত্যাগ
করার আগে আমি তোমাকে ত্যাগ করব। ঐ দেখ ভূমি থেকে উত্থিত হয়েছে আমার স্বর্নসিংহাসন,বিদায় শ্রীরাম,নাগবাহিত সিংহাসনে আমার প্রবেশ ঘটবে
অতলে। আমি চিরদুঃখী,আমার আসন মানবের অন্তরে আর সেই অন্তর হলে
তুমি ।
সেদিন গঙ্গারধারে সাধক
শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ আমাকে দেখে ফেলেছিল। নির্জন দ্বিপ্রহরে আমি আমারই কালীরূপ দেখতে
গিয়েছিলাম। প্রায়ই যাই ওই মন্দির উদ্যানে। সাধক আমাকে হারিয়ে ফেলেছিল । নহবতে
উকি মারলেই দেখতে পেত আমি সীতা হয়ে বসে আছি ।
সুত্র – পরমেশ্বরী সীতা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ।
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।