Advt

Advt

juger-bali-story-galpo-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-যুগের-বলি-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

juger-bali-story-galpo-by-nityaranjan-debnath-tatkhanik-digital-bengali-web-bangla-online-e-magazine-যুগের-বলি-নিত্যরঞ্জন-দেবনাথ

 

বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। এক সন্তান হওয়ার যে কি জ্বালা ভুক্তভোগী  ছাড়া ভাবতেও পারবে না তার যন্ত্রণা কতটা গভীরে। আকাশ সমান দাবি সবার। ভাবে না ক্ষমতা কতটুকু ।অবশ্য সোনার চামচ নিয়ে যাঁরা জন্মেছে তাঁদের কথা আলাদা। তাঁরা ভাগ্যবান। বাবা-মায়ের কল্যানে ওদের বৈভব, প্রাচুর্যের সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে। যাদের ঘরে অভাব-অনটন, অসুখ-বিসুখ নিত্যদিনের সঙ্গী। তাদের কাছে স্বপ্ন দেখা দিবাস্বপ্ন।

অংক  নিয়ে এমএসসি পাস করেছি। ছাত্র পড়িয়ে দিন চলে। সুপ্ত আশা গুপ্ত-ই থাক।।এখন  আমার একটাই স্বপ্ন, আরেকটা ভাল টিউশনি যদি পাই। মায়ের স্বপ্ন, খোকা বি.এস.সিতে ফার্স্ট ক্লাস,এম.এসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করেছে।সরকারি চাকরি নিশ্চিত। শীঘ্রই সংসারের শ্রী ফিরবে। বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনবে। তারপর ঠাকুমা হবে, আরও কত কি ! ওটাই মায়ের বড় স্বপ্ন। বাবা অবশ্য খুব প্র্যাকটিক্যাল। জীবনের সার বুঝে গিয়েছেন। পোড় খাওয়া এক বাস্তব মানুষ।  তবু  বলেন, প্রাণপণ চেষ্টা করে যা, চাকরি নিশ্চিত পাবি। তুই না পেলে অনেকেই পাবে না। তবে ইদানিং বাবার আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। দেশের বর্তমান হালচাল দেখে কেমন বোবা বনে যাচ্ছেন। বাবা একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন।  হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। সংসারে কিছুটা টানাটানি থাকলেও টিমটিম করে চলে যাচ্ছিল। এবার কী হবে? ডাক্তার বলেছেন, দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হওয়ার আশা ক্ষীণ।গরিবের ঘরে কেন এই রাজরোগ?

সন্ধ্যের টিউশনিতে না গিয়ে বন্ধু ত্রিদিবের বাড়ি গেলাম।বাবার চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা যদি হয়। ত্রিদিব আমার অনেক দিনের বন্ধু। স্কুল কলেজে এক সঙ্গে পড়েছি ।  যদিও ত্রিদিবের পড়াশুনায় মন ছিল না কোনোদিনই। কোনোক্রমে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক উৎরে  কলেজে আর্টস নিয়ে পাশ কোর্সে ভর্তি হয়।ইদানিং সময়ের অভাবে দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও  বন্ধুত্ব অটুট আছে আজও। কলেজে পড়ার সময় উভয়ে উভয়ের বাড়ি নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ত্রিদিবই জোর করে টেনে নিয়ে যেত। ওর মায়ের অথিতি পরায়নতা ভোলার নয়। না খাইয়ে ছাড়তেন না কোনওদিন। কিন্তু আজ ওর বাড়িতে এসে থমকে গেছি। এমন পেল্লাই বাড়ি কবে করলো ওরা ! বোধহয় বছর ছয়েক পরে এলাম।  চাকরির চেষ্টা, টিউশনি ইত্যাদি নানা ঝামেলায় আসা হয় নি। এর মধ্যেই আমূল পরিবর্তন ! ইনকাম বলতে ওর বাবার স্টেশন রোডে একটি কাপড়ের দোকান। তেমন বিক্রি বাটা না হলেও সংসারটা ভালোভাবেই চলে যায়। ত্রিদিবের এক দাদা আছে লন্ডনে থাকে। ওখানেই নাকি বিয়েথা করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না বললেই জানতাম। তবে কী তিনিই টাকা পাঠিয়েছেন? আর অন্য কোনও রোজগারের উৎস তো দেখতে পাচ্ছে না। আর ত্রিদিব তো দেশ সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। ইনকাম দূরে থাক ওর দায়িত্বও বাবা-মায়ের ঘাড়ে। কলেজে থাকতেই ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি। পরে পাকাপাকি ভাবেই দেশের কাজে লেগে পড়েছে । এখন পার্টির এক বড় নেতা। অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ তাকে সামাল দিতে হয় শুনেছি।

কলিং বেল টিপতেই এক মধ্য বয়স্ক লোক গেটের সম্মুখে দাঁড়াল।

"কাকে চাই?"

" ত্রিদিবের সঙ্গে একটু দেখা করব। ত্রিদিব কি বাড়িতে আছে?"

"আপনার কি এপয়েন্টমেন্ট করা আছে? কখন টাইম দিয়েছে?"

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। ওর সঙ্গে দেখা করতে আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট করতে হয় ! এত বড় হয়ে গেছে ! ভাবতেও ভালো লাগছে।

বললাম," আমি ওর প্রিয় বন্ধু। গিয়ে বলুন, অনির্বাণ এসেছে, তাহলেই সব বুঝতে পারবে।"

"প্রিয় বন্ধু ! কই আপনাকে তো কোনোদিন দেখিনি আমি। ঠিক আছে, এই স্লিপটার মধ্যে আপনার নাম, ফোন নাম্বার লিখে দিন। সাহেবকে দেখাই। যদি অনুমতি দেন তবেই গেট খুলব।"

অগত্যা স্লিপে লিখে বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তিন তলা বিশাল বাড়ি । আগে ছিল এক তলা । বাড়িতে তিনটে মাত্র প্রাণী । এত বড় বাড়ির দরকার কতটুকু কে জানে।  আগে প্রাচীর ছিল না। এখন চারিদিকটা ঘিরে বড় এক লোহার গেট। যেন এক জমিদার বাড়ি।

লোকটা এসে  গেট খুলে বললেন," আপনি ভেতরে আসুন। সোজা গিয়ে ডান দিকটার ঘরে গিয়ে বসুন।"

হলঘর না হলেও লম্বামত একটা ঘর। অনেকগুলো চেয়ার পাতা রয়েছে। চারজন পুরুষ ও তিনজন মহিলা বসেও আছে।  ডাক্তার বাবুদের চেম্বারে এমনটা দেখা যায়। একজন একজন করে যাচ্ছে, আসছে। আমার কখন ডাক পড়বে কে জানে।  চৈত্র মাসের মাঝামাঝি। কদিন ধরে গরমের দাপট বেশ বেড়েছে। অথচ কাল বৈশাখী,  ঝড়বৃষ্টির কোনো লক্ষণই নেই। মাঝেমধ্যে হলে বরং ধরিত্রী ঠান্ডা থাকে।ঘরে তিনটে ফ্যান বন বন করে ঘুরছে। সুবিধা মত একটা ফ্যানের নীচে গিয়ে বসলাম। বুঝতে পারছি পরের টিউশনটাও কামাই হবে। হোক। আজ ত্রিদিবকে ধরে যেভাবেই হোক রাজি করাতেই হবে, নাহলে বাবাকে যে বাঁচানোই যাবে না।

ভাগ্য ভালো তিনজনের পর আমি ডাক পেয়ে গেলাম। লোকটি এসে বলল, আপনি আসুন। সত্যি কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি আসার আগে থেকে এঁরা বসে আছেন, অথচ আমি আগে যাবো? এক মধ্য বয়স্কা মহিলা আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছেন। মনে মনে বলি, আমি কি করতে পারি বলুন। ডাক পড়েছে যেতে তো হবেই। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সাহেবের চেম্বারে।

"আয় আয়। কত দিন পর তোকে দেখছি বলতো? আমার পাশের চেয়ারটায় এসে বস।

এসি ঘর। খুব বড় না হলেও ছোটর মধ্যে ছিমছাম একটা অফিস ঘরের মত। টেবিলের জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে জল খেলাম অনেকটা। শুধু শরীর নয় বন্ধুর ব্যবহারে মনটাও বেশ ঠান্ডা হল।

বন্ধু কলিং বেল টিপতেই লোকটা এসে হাজির। ত্রিদিব বলল, " যারা বসে আছে ওদের কাল আসতে বলে দাও। অনেকদিন পর আমার বন্ধু এসেছে। অনেক কথা আছে বন্ধুর সঙ্গে। "

আমি বললাম,"  আমি এসে তো ভড়কে গেছি। চিনতেই পারছি না। এত বড় বাড়ি কবে করলি? "

"অনেকদিন তো আসিসনি।তাই নতুন নতুন লাগছে। বিয়ে করবো ভাবছি। বাবা-মাও খুব প্রেসার দিচ্ছে।ভাবলাম , করেই ফেলি। আগের বাড়িটাকে তো তুই দেখেছিস। বাড়ি ছিল কি? কুঁড়ে ঘর। দেখে কেউ মেয়েই দেবে না। তাই বাড়িটা আগে করলাম। তাও বছর দুই হয়ে গেল। এবার মেয়ে দেখাদেখি চলছে। ইচ্ছে আছে আগামী বৈশাখে সেরে ফেলব। যাকগে, ছাড় আমার কথা। মাসি মেসো কেমন আছে বল? যাবো যাবো করেও এত কাজের চাপ সময়ই পাই না, বুঝলি?"

বাবা খুব অসুস্থ। সেই জন্যই তো তোর স্মরণাপন্ন হয়েছি। একমাত্র তুইই পারিস সঠিক ট্রিটমেন্ট করাতে।

মেসোমশাইয়ের খবরটা জানি।

তুই জানিস বাবার কি হয়েছে?

কেন জানবো না? আমাদের নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। রাজনীতি কি এমনি এমনি করি। জনগণের স্বার্থেই সব খবর রাখতে হয়। যে ডাক্তার দেখছেন তাঁকে ফোন করেই ডিটেলস জানলাম। ইমিডিয়েট কেমো স্টার্ট করতে বলেছেন, তাইতো?

"ঠিকই শুনেছিস। এক-একটা কেমোর যা দাম,আমাদের মত ফ্যামিলির কি করে ট্রিটমেন্ট করাবো বলতো?  তুই ভাই একটা ভাল সরকারি হসপিটালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দে। তোর কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব।"

"আরে তুই ওভাবে বলছিস কেন?  তোর বাবার প্রতি আমার কোনও দায়িত্ব নেই নাকি? উনি তো আমারও মেসোমসাই।আমি অলরেডি যেখানে ভর্তি করালে ভালো হয় কথা বলে রেখেছি। কিন্তু আপাতত বেড ফাঁকা নেই। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।"

সেটা কত দিন? বেশি দেরি হলে তো মুশকিলে পড়ে যাব।

তাড়াতাড়িই হবে আশা করছি। তুই চিন্তা করিস না। ফাঁকা হলেই আমি তোকে ফোন করে দেব।

"তোর সঙ্গে কথা বলে কিছুটা আস্বস্ত হলাম।ক'দিন ধরে রাতে ঠিকমত ঘুমোতে পারিনি জানিস? এবার একটু শক্তি পেলাম। তা মাসিমা কেমন আছেন? মাসিমাকে খুব মনে পড়ে। যেদিনই আসতাম পেট পুরে মাসিমার হাতের রান্না খেয়ে যেতাম। এলেই জোর করে খাওয়াতেন। মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা?"

"কেন মনে পড়বে না?মা এমনিতে ঠিকই আছে তবে কদিন ধরে বাতের ব্যাথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন।মা তোর কথা প্রায়ই বলে। গতকালই তো বলছিল, অনির্বাণটা এত মেধাবী ভালো ছেলে অথচ একটা চাকরি জোটাতে পারল না। তুই দেখ না বাবা ওর যাতে একটা হিল্লে হয়। মাকে কি বলে বোঝাই বলতো? আজকাল  যোগ্যতার থেকে যে অন্য এলেম লাগে সে ক্ষমতা কী অনির্বাণের আছে? থাকলে কবেই চাকরি হয়ে যেত।"

"আমার দুর্ভাগ্য। চাকরি আদৌ পাবো কিনা ঈশ্বর জানেন। খুব হতাশায় ভুগছি জানিস তো। বাবা বলতেন, ধন দৌলতের দরকার নেই, তুই ঠিকমত পড়ালেখাটা করে যা, তাহলেই সব পাওয়া হয়ে যাবে। শিক্ষার কদর সর্বত্র। ভালো রেজাল্ট করলে চাকরি নিশ্চিত। কিন্তু কি হলো বলতো?"

ত্রিদিব বলল," ওসব নীতিবাক্য আজকাল আর চলে না। বাস্তবকে সর্বদা মেনে চলতে হয়।"

আমি বললাম," যাই হোক, আমার যা হওয়ার হবে। তুই অন্তত বাবার ব্যাপারটা একটু দেখিস। এই মুহূর্তে কিছু ঘটে গেলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। মাকেও সামলানো যাবে না কিন্তু।"

"তোকে একটা কথা বলি অনির্বাণ। অন্যভাবে নিস না। বি প্র্যাকটিক্যাল। মেসোমশাই-এর এখন যা কন্ডিশন, বলতে পারিস লস্ট কেস। ডাক্তারের কাছে যা রিপোর্ট পেলাম,এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। একমাস-দু'মাস বড়জোর ছ'মাস টিকবে। তাই বলছি মনকে শক্ত কর। মানসিক প্রস্তুতি সেভাবেই নিতে হবে। অযথা অর্থ খরচ করাও বৃথা।"

আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোনোরকমে বেরিয়ে এলাম। সারা শরীরে যেন কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছে। এসব কি বলছে ত্রিদিব! যে মানুষটা সন্তানকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য নিজের শখ-আহ্লাদ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে যে ভাবে অমানুষিক পরিশ্রম করে গেলেন , তাঁর কথা ভাবতে বারণ করছে ত্রিদিব ! হায় ঈশ্বর ! এ কি পরীক্ষা নিচ্ছ তুমি! এবার আমার কী করণীয় !

লেখক পরিচিতি: 

জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।

তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট,  দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর  ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।

তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। 

Tatkhanik digital bengali online e magazine

Choto Maa, Story, Galpo, by Nityaranjan Debnath, Tatkhanik digital, bengali online, bangla web, e magazine, ছোটমা, গল্প