লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় কফি হাউসে আড্ডা দিতে যেতাম তখন যেসব কবি বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল গৌতম মুখোপাধ্যায়। মনে পড়ে পাতলা চেহারা এবং উজ্জ্বল চোখের এই তরুণ কবি আসত সিঁথি থেকে, ওর পকেটে থাকত একগুচ্ছ কবিতা বা কবিতার খাতা। সুযোগ পেলেই গৌতম সদ্য লেখা একটি দুটি কবিতা শুনিয়ে দিত আমাদের।
কফি হাউসের দোতলায় দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে জানলার কাছে একটি টেবিল সন্ধ্যা থেকেই আমরা ক’জন অধিকার করে থাকতাম। সবুজ কাঁচ লাগানো ওই টেবিলে যারা এসে বসতাম তাদের মধ্যে গৌতমই সর্বকণিষ্ঠ,ও তখনও কলেজের দরজা পার করেনি আমাদের মত,কিন্তু লেখার দিক থেকে ও তখনই অনেকটা এগিয়ে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ওর কবিতা ছাপা হয়েছে কৃত্তিবাস পত্রিকায় যার কর্ণধার ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের টেবিলে তখন যাঁরা এসে বসতেন তাঁদের অনেকেই পরবর্তী জীবনে কবি কিংবা গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ কর্রেছেন। যেমন বাণীব্রত চক্রবর্তী,শুভাশিস্ গোস্বামী, যিশু চৌধুরি,শুভ বসু,শ্যামল রায়চৌধুরি এবং আরও অনেকে যাদের সবার নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা। আমাদের আসরে মাঝে মাঝে দেখা দিতেন কবি এবং দুর্ধর্ষ সমালোচক অতনু রেজ যাঁর সঙ্গে আমার লেখার সূত্রে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘকাল ধরে। আমরা বেশির ভাগই তখন বেকার,আমাদের চা সিগারেট আর বাস ভাড়ার টাকা আসে একটি দুটি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে,কাজেই দ্বিতীয়বার কালো কফি ( ইনফিউশন) এবং তৃতীয় চারমিনার সিগারেটটির জন্য নির্ভর করতে হয় চাকুরিজীবি দাদা স্থনীয় কবি সাহিত্যিকদের উপর। বলতে দ্বিধা নেই এই কাজে কোন গাফিলতি করেননি দাদারা। লিটল ম্যাগাজিনে লেখার ব্যাপারেও একে অপরকে সাহায্য করার যে ঔদার্য এবং সহায়তা তখন দেখেছি বলতে কষ্ট হয় তা এখন একেবারেই দেখিনা। বরিষ্ঠ,নামি লেখকরা আমাদের মত নতুন শিং গজানো তরুণ লেখদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিতেন,কফি খাওয়াতেন,আমাদের লেখা পড়তেন এবং লেখার ব্যাপারে উপদেশ দিতেন যা আমাদের লেখক জীবনে পরবর্তী কালে অনেক সাহায্য করেছিল। এভাবেই অতীন বন্দোপাধ্যায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী,শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত স্বনামধন্য লেখকদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কফি হাউসের সেই স্বর্ণযুগে। মনে পড়ে ‘ব্যান্ডমাস্টার’ খ্যাত তুষার রায়,‘ফিরে এসো চাকা’র কবি বিনয় মজুমদার এবং প্রখ্যাত শিল্পি দেবব্রত মুখোপাধ্যায় কখনো এসে বসেছেন আমাদের টেবিলে। আর প্রতি রবিবার সকালে প্যান্টের উপর গুরু পাঞ্জাবি চড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে কফিহাউসে এসে হাজির হতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় - অভিনেতা হিসেবে নয়,এক্ষণ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে। উনি বসতেন জানলার কাছে একটি কোণার টেবিলে নির্মাল্য আচার্য্য এবং আরও দু’একজন ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবির সঙ্গে। সিগারেট আর কফির ধোঁয়া আর শিল্প-সাহিত্যের সরব আলোচনায় রবিবারের সকালে কফি হাউস তখন প্যারিসের কোন নামি সালোঁ (salon) কে হারিয়ে দিতে পারত।
কফি হাউসের সেই আড্ডার কাহিনি আরও লেখার ইচ্ছে রইল
ভবিষ্যতে,কিন্তু আমি
যাকে নিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম সেই গৌতমের কাহিনিই আরেকটু বিস্তারে বলা যাক এই
কিস্তিতে। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম বাড়ির কাছের কোন লাইব্রেরিতে গিয়ে গৌতম একটি মেয়ের
প্রেমে পড়েছে। আমি জানতে চাইলাম মেয়েটির সঙ্গে ওর কথা হয়েছে কিনা,ও জানাল সেরকম সুযোগ তখনও আসেনি। ওই মেয়েটিকে দেখতেই
ও লাইব্রেরিতে যাতায়ত করেছে কয়েকবার কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলার সাহস যোগাতে পারেনি
গৌতম। আমি আশ্চর্য হইনি কারণ তখনকার সময়ে বেশিরভাগ প্রেমই একরতরফা,এমনকি বিনয় মজুমদারের প্রেমও তো একতরফাই ছিল। কিন্তু
কবিতা লেখায় এই প্রেম যে ভাল ইন্ধন যোগায় তা ‘ ফিরে এস চাকা’ পড়লে বুঝতে পারা যায়।
গৌতম মেয়েটিকে এতই ভালোবেসে ফেলেছিল যে ওকে নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিল। আমাকে
বলেছিল ওর প্রথম কবিতার বই উৎসর্গ করবে ওর সেই কথা-না-বলা প্রেমিকাকে কবিতার এই
তিনটি অনবদ্য লাইন দিয়ে –
‘কথা হয়নিকো,হয়েছিল দেখা,
নায়িকা উদ্ধত,নায়ক চন্দ্রাহত
সূচনায়,আদিরসে।’
মনে আছে চন্দ্রাহত গৌতমকে ওর সেই উদ্ধত নায়িকার থেকে বিচ্ছিন্ন করার
প্রয়াসে আমি ওকে একাধিকবার নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি,ওকে নিয়ে চলে গেছি গ্রামের দিকে। নানারকম গাল-গল্প,হাসি ঠাট্টা,গাছপালা,ঘন সবুজের ছোঁয়ায় ওর মনকে অন্যদিকে ঘোরাতে। কিন্তু ওর প্রেমের আঠা পুরোপুরি
ছাড়ান যায়নি কোনদিন। বেশির ভাগ সময়েই ও অন্যমনস্ক থাকত,এটা ওর পরিচিত সবাই লক্ষ করেছেন। পরিবারের আর্থিক
অবস্থা ভাল না থাকায় খাওয়া দাওয়া বা মানসিক চিকিৎসা কোনটাই ঠিকমত হয়ে ওঠেনি
গৌতমের। বাস ভাড়া বা চা সিগারেট খাবার জন্য আমরা কখনো সখনো সাধ্যমত দশ বিশ টাকা
ধার দিয়েছি ওকে, কিন্তু তা দিয়েতো কারও জীবন চলেনা।
চাকরি সূত্রে দিল্লি চলে আসার পরে গৌতমের সঙ্গে আমার
সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু ও যেসব দুর্দান্ত কবিতা আমাকে শুনিয়েছিল এককালে তার বেশ কয়েকটি আমার
স্মৃতিতে থেকে গেছে। সকালে বা সন্ধ্যায় ঘুরতে বেরিয়ে সেসব কবিতা আমি এখনো মনে মনে
আউড়ে চলি।
কবি শুভাশিস গোস্বামীর কাছ থেকে সম্প্রতি জানতে
পারলাম কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের উদ্যোগে গৌতমের একটিমাত্র কবিতার বই ছাপা
হয়েছিল যার নাম ‘ প্রভাস।’ শুভাশিসদা এ-ও জানালেন যে মানসিকভাবে
গৌতম কোনদিনই সুস্থ ছিলনা,সেরকম চিকিৎসাও হয়নি ওর। আর এভাবেই ২০০২/২০০৩ সালে মাত্র পঞ্চান্ন/ছাপান্ন
বছরেই ও মারা যায়। কিন্তু গৌতম আমার মনের একটা কোণায় স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে,যখন কিছুই ভাল লাগেনা তখন ওর কবিতাই আমি মনে মনে
আওড়াই। আর সেরকমই একটি ভালো কবিতা,যেটি ছাপা হয়েছিল কৃত্তিবাস পত্রিকায় তা দিয়েই এই স্মৃতিচারণে ইতি টানছি।
জপমালার প্রতি
জপমালা,দূরে রাখ মন।
কাছের গাঙে বরং সন্তরণ,
অনেক ভালো,অলুক্ষুণে দেশে
নৌকো বেয়ে লাভ কি বল এসে?
কলাকাতা তোর স্বপ্নে জাগায়
মায়া
মণি-মানিক জ্বলে মেধায়,গাছে।
মনে যে তোর আশার রঙিন কায়া
কলকাতাতে সোনার খনি আছে।
বুকে পাবি মাতাল দুখের
জ্বালা
জপমালা,অনেক দূরে পালা
সিঁথির সিঁদুর পুড়বে আগুন
রাঙে,
না’ ভাসা তুই বরং কাছের
গাঙে।
জপমালা,দূরে রাখ মন।
কাছের গাঙে বরং সন্তরণ,
অনেক ভালো,অলুক্ষুণে দেশে
নৌকো বেয়ে লাভ কি বলো এসে?
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়;কর্মজীবন দিল্লিতে,কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ
দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি
থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ
প্রকাশিত হয়েছে। দেশ,আনন্দবাজার,সাপ্তাহিক
বর্তমান, নবকল্লোল,পরিচয়,কালি ও কলম (বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প
লেখেন নলিনাক্ষ। দিল্লি থেকে
প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।