লেখিকারঅন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
আজ ১৫ ই আগস্ট, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস। সারাদেশে খুশির বানভাসি। প্রত্যেকের মনে
আনন্দ। সবাই উৎসবে মেতে উঠেছে। এমন একটি সুন্দর দিনে ঘরে মন টেকে না। মালবিকা ঠিক
করল কোথাও যাওয়া যাক।
আজ বহু
জায়গায় পতাকা উত্তোলন হচ্ছে,অনুষ্ঠান হচ্ছে। যেখানে
দেখবে অনুষ্ঠান হচ্ছে,মন চাইলে ওরাও যোগ দেবে।
হু হু করে গাড়ি
ছুটে চলল হাইওয়ে ধরে।কিছুটা আসবার পর চোখে পড়ল ছোট্ট জন- সমাবেশ, অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ,বেশ কিছু বাচ্চা, কিশোর কিশোরী। মালবিকা সুরজিৎকে বলল, জায়গাটা বেশ নিরিবিলি,চারিদিকে
কেমন সুন্দর সবুজ গাছ! এখানেই গাড়ি রাখো। ওইতো অনুষ্ঠান
হচ্ছে,ওখানেই যাওয়া যাক।
ওরা এগিয়ে গেল।
হাইওয়ের পাশে
মাঠ,সেই মাঠেই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। আটপৌরে কটি দোকান ও চোখে পড়ল। ছোট্ট একটি বাচ্চা এসে পট করে ওর হাতে ছোট
পতাকা ধরিয়ে,দে ছুট।
মালবিকার চোখ
পড়ল দোকানটিতে,দোকান তো নয় টেবিলের ওপরে কিছু
বিস্কুট চানাচুর চকলেট পাপড় ভাজা রাখা,এইমাত্র । একটি বয়োমে দেখতে পেল কিছু লজেন্স! বহু বছর বাদে
এই লজেন্স চোখে পড়ল, গুড়ের লজেন্স। মালবিকার চোখের সামনে মাস্টারমশাইয়ের মুখটা ভেসে উঠলো।
মাস্টার মশাইর
ঘরে এই লজেন্স থাকতো। মাস্টারমশাই নিখিল
পাকড়াশী,মাঝে মাঝেই ওকে দাঁড় করিয়ে খুব বকূনি দিতেন। কাকিমা (মাস্টার
মহাশয়ের স্ত্রী) পর্যন্ত ভেতর বাড়ি থেকে
এসে বলতেন মেয়েটাকে এত বকছো কেন! দেখেছো
তো কেমন লাল হয়ে গেছে! কেমন টস টস করে জল পড়ছে! তোমার কি দয়া মায়া নেই!
মাস্টার মশাই
কাকির দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসে
বলতেন,ওর ওই কান্না কান্না মুখটা বেশ লাগে।
মাস্টারমশাইর স্ত্রী বলতেন,কি সব যা তা বলো! কাঁদো কাঁদো মুখ
আবার বেশ লাগে!৷
তারপর মাস্টার
মশাই দুটো গুড়ের লজেন্স হাতে দিয়ে বলতেন
এবারে বাড়ি যা। মালবিকাও গুড়ের লজেন্স দুটো পেয়ে বকুনির কথা বেমালুম
ভুলে যেত। কেন বকেছে কতক্ষণ বকেছে কি বলে বলে বকেছে ওর মাথায় থাকতো না। সামান্য
গুড়ের লজেন্সের এতটাই ক্ষমতা।
সেই সময় বডি
সেম,সেফ ডিসটেন্স,হিউম্যান রাইট,
কর্পোরাল পানিশমেন্ট এই শব্দগুলো dictionary-তে থাকলেও,তেমন একটা সোচ্চার ছিল না।
ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায়ও এসব গিজির
গিজির করত না। মালবিকারা কেবল এটাই জানত
মাস্টারমশাই গুরু। পড়া না পারলে বকুনিও
দিতে পারেন, দরকার হলে কানটাও মুলে দিতে পারেন। সেই
কান্ড হয়েছে বৈকি। সে নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিল না। বকুনি,কান টানাটানির আধিক্য হলে মা-বাবারা নিশ্চিন্ত থাকতেন,যাক এবারে তবে পাসটা হয়েই যাবে।
মালবিকা যখন ঘরে ফিরত মা জিজ্ঞেস করত এত দেরি হল কেন? মালবিকার মাথায় থাকতো না বকুনি
খেয়েছে,বলত কি জানি। মা ও ছাড়বার পাত্রী নয়। ওর হাতের
মুঠি খুলে দুটো বড় বড় গুড়ের লজেন্স
দেখত। মা-র মুখে
একটা হাসি, আজও পড়া পারনি! আচ্ছা বকুনি খেয়েছ! এবার
রশিয়ে রশিয়ে পাঁচ পয়সার গুড়ের লজেন্স খাও।
লজেন্সের
কিন্তু দারুন স্বাদ ছিল।
কেটে
গেছে অনেকগুলো বছর।
আজ হঠাৎই হাইওয়ের ধারে সেই লজেন্স দেখতে পেয়ে পটাপট
বেশ কিছু কিনে ফেলে। ইস মাস্টার মশাইকে যদি দেখানো যেত! মুখে দিয়ে দেখে তেমন স্বাদ তো নেই! কেন! স্বাদটা কোথায় গেল!
মালবিকা বুঝতে পারে,মাস্টারমশাই বকুনির ঝুলিটা সাথে
নিয়ে চলে গেছেন। সেই বকুনির সাথে
লজেন্সের স্বাদটাও চলে গেছে।
এক মুঠো লজেন্স হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মালবিকা। ছোটবেলার সেই দিনগুলি চোখের
সামনে স্পষ্ট। হঠাৎ কেন জানো খুব কান্না
পাচ্ছে। মাস্টারমশাইর কথাগুলো ওর কানে বাজছে,কান্না কান্না
মুখটা দেখতে বেশ লাগে। ও নিজেও কত বছর মাস্টার মশায়ের মুখটা দেখেনি।
মালবিকার দুই চোখ বেয়ে টস টস জল গড়িয়ে পড়লো।
পতাকা উত্তোলন
হলো। ছোট ছোট বাচ্চাদের অনুষ্ঠান হয়ে
যাচ্ছে একের পর এক। মালবিকার মন ফিরে
যাচ্ছে পুরনো দিনে। এই দিনটিতে মাস্টারমশাই ছাত্র-ছাত্রীদের সবাইকে বাড়িতে ডাকতেন,তার এক চিলতে বাগানে বৃক্ষরোপন হতো। মালবিকা নিজেও গাছ লাগিয়েছিল, চাঁপা গাছ। পরে সেটি বেশ ঝাপড়া
হয়েছিল। পতাকা উত্তোলন হতো,সবাই সমস্বরে গাইত। অনেকেই মুখ
বন্ধ করে থাকতো । মাস্টার মশাই পেছন থেকে বলতেন
মুখ খুলে মনে আনন্দ নিয়ে গাও,জাতীয় সংগীত। এতে
সংকোচের কিছু নেই লজ্জার কিছু নেই ভয়ের
কিছু নেই। গলা ছেড়ে গাও। এ আমাদের গর্ব।
মালবিকা
প্রতিবছরই " ভারত আমার ভারত বর্ষ "এই গানটি গাইত। ওর গলায় ভারী মিষ্টি
শোনাতো। এই গানটি মাস্টার মশাই-র প্রিয় গান। মন ভরে শুনতেন।
আজও অনুষ্ঠান
চলছে। মালবিকা চুপটি করে বসে আছে। মনে হল ওর অন্তরের অন্তস্থলে কেউ যেন ওকে বারে বারে বলছে,গলা ছেড়ে আজকের দিনে সেই গানটি গা,ভারত আমার ভারত
বর্ষ । গানটি তোর গলায় ভারী মিষ্টি শোনায় । ওঠ মালবিকা। এগিয়ে যা গানটি ধর। আজই তো এই গানটি গাইবার দিন।
আর বসে থাকতে
পারলো না মালবিকা,উঠে দাঁড়ালো। মালবিকা,গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো,
"ভারত আমার ভারত বর্ষ "। ওর মিষ্টি সুরে ভরে উঠল
চারিদিক। নীল আকাশে রং ছড়িয়ে দিল তিরঙ্গা, ভারতবাসীর
গর্ব ভারতবাসীর অহংকার ভারতবাসীর সম্মান ভারতবাসীর পরিচয়।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।