ধারাবাহিক উপন্যাস – প্রতি বৃহস্পতিবার ।
২১তম পর্ব পড়তেএখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্যলেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
২২তম পর্ব শুরু ……
মায়ের কোল, ঠাকুর
মায়ের আদর, বাবার অভয় হাত, কাকাদের
সোহাগ ছেড়ে চলে এলাম সম্পূর্ণ নতুন একটি জীবনে। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে। প্রথম
একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছিলাম। আপন করে নিয়েছিলাম বাড়ির প্রত্যেকটি
মানুষকে। আর
পাঁচটা মেয়ে যেমন নেয়।
দিন যায় দিন আসে। সময় বদলায়। যে মেয়ে একটি পরিবারের রাজকন্যা ছিল সে এখন একটি ঘরের কাজের মেয়ে ছাড়া আর কিছু নয়। যে পড়াশোনা গান বাজনা ছাড়া আর কিছু জানত না তাকে এখন মনে রাখতে হয় কোন কৌটায় হলুদ থাকে কোন কৌটায় জীরা থাকে কোথায় থাকে লবণ? কতটা চালে কতটা জল দিতে হবে বুঝে ওঠা ভারি মুশকিল। এ যেন গোলোকধাঁধাঁ। ভাষা জানিনা। হিন্দি সিনেমা দেখা মানা ছিল আমাদের। হিন্দি কিছুই বুঝিনা। যদি সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকত তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারতাম।
নিজের মানুষ নেই, নিজের ভাষা নেই। কোনো কালচারাল প্রোগ্রাম নেই। রবীন্দ্র সঙ্গীত নেই। আমার কলেজ নেই। হারমোনিয়াম নেই। রঙ তুলি নেই। আছে ঘর গোছানো আছে রান্না করা। এটুকু কাজ করতে কতটা আর সময় লাগে? কিছুতেই সময় কাটাতে চায় না। ফোন নেই কাছে তখন। বাড়ি কথা বলতে হলে টেলিফোন বুথে গিয়ে লাইন দিতে হতো। তারও আবার সময় ছিল। ভোর বেলা কথা বললে লাইন ক্লিয়ার পাওয়া যেত আর পয়সাও কম লাগত। খুব হিসেব করে কথা বলতে হতো একটু কথাতেই ৭০ , ৮০, ১০০ টাকা বিল উঠে যেত। গ্রামে তো তখন ফোন ছিলই না। আমাদের কল্যাণীর বাড়িতে ফোন ছিল। মাঝে মাঝে সেখানে একটু ফোন করে সবার খোঁজ খবর নিয়েছি। বুক ভেঙ্গে কান্না বেড়িয়ে এসেছে কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। মুখ চেপে ধরে কান্নাকে আটকে রেখেছি। এটাই নিয়ম। একটা চিঠি লিখে পোস্ট করার দিন থেকে উত্তরের অপেক্ষায় বসে রয়েছি । দিনের পর দিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছি। দিন গুনেছি শুধু। পিওনের উপর ভারি রাগ হতো তখন।
ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি মানুষের কল্পনা আর বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। যেমন যেমন কল্পনা করেছিলাম তার কিছুই দেয়নি বাস্তব আমাকে। আর যা দিয়েছে সে তো স্বপ্নেও ছিল না আমার। নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিইবা করতে পারি। এই সময়ের মেয়েরা হয়তো এতটা মেনে নিতনা বা নেয় না কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মেয়েদের শেখানো হতো মা বাবা যেখানে বিয়ে দিয়েছে সেখানেই থাকতে হয়। তোমার স্বামীর কুঁড়ে ঘর হলেও সেটাই তোমার স্বর্গ। বিয়ের পর এটাও বুঝতে পেরেছিলাম ভাগ্য বলে কিছু একটা আছে। মানুষ চাইলেই তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। বনের পাখি বন্দী হলো সোনার খাঁচায়। অবুঝ পাখি বোঝেনা সে শুধু আকাশ পানে চায়। প্রেম ভালোবাসা কাকে বলে জানেনা পাখি। তবে বন্দী হয়ে বেঁচে থাকা যদি ভালবাসা প্রমাণ করার একমাত্র পথ হয় তবে মৃণ্ময়ী নামের মেয়েটি ভালোবাসা চায়নি এতটুকুও। মন প্রাণ দিয়ে সে খাঁচা ভাঙার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। সমাজের ভয়। মা বাবার মলিন মুখ, শ্বশুর ভাসুরের সম্মান, ছোট ছোট ভাই বোনের খুশি তাকে আটকে রেখেছিল। ভালো মেয়ে হওয়ার অনেক রকম ঝঞ্ঝাট আছে। তারা সবার কথা ভাবে শুধু নিজের কথা ছাড়া। ডানা মেলে উড়তে সাধ তো থাকে কিন্তু সাধ্য থাকে না। বসতে বারন, উঠতে বারন, বলতে বারন, হাসতে বারন, কাঁদতে বারন। বারনের গগনচুম্বী পাঁচিল উঠেছিল তার চৌহদ্দি জুড়ে। একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?" রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।"
তাই তো মন থেকে
উৎসারিত হয় এমন কবিতা।
স্বাধীন হবো
আমার একটা ইচ্ছে আছে
ছোট্ট একটা স্বপ্ন আছে
আমি একটু স্বাধীন হব
একদিনের জন্য হলেও হব...
ঝর্ণার জল হয়ে বয়ে যাব
নীল পাহাড়ের বরফ হব
অতল সমুদ্রের উচ্ছল তরঙ্গ হব
একদিনের জন্য হলেও হব...
সাহারা মরুভূমিতে মরূদ্যান হব
মনের সুখে বৈকাল ঝিল হব
মাঝির গলায় ভাটিয়ালি গান হব
একদিনের জন্য হলেও হব...
অসীম গগনে সাদা বলাকা হব
মানুষের মনে অফুরন্ত ভালবাসা হব
পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নার আলো হব
একদিনের জন্য হলেও হব...
সত্যি বলছি , একদিনের
জন্য হলেও
স্বাধীন আমি হবোই
হবো...
ক্রমশ …………………
২৩তম পর্ব পড়ুন আগামি বৃহস্পতিবার ।
মনীষা কর বাগচী বিয়ের পর দিল্লিতে আসেন। শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে সবুজে শ্যামলে ঘেরা নদীয়া জেলার মাঝেরগ্রাম নামক একটি গ্রামে।
স্কুল থেকেই লেখা লিখি শুরু । নিজের মনেই লিখে যেতেন কত কিছু। আজ সে সব লেখাগুলোও হারিয়ে গেছে। লেখার অনুপ্রেরণা জোগান সেজোকাকা কবি নিশিকান্ত বাগচী।
দেশে এবং বিদেশে অসংখ্য লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হয়। প্রতিদিন কিছু না কিছু লেখেন। শ্রদ্ধেয় কাকু বিরাট বৈরাগ্যের সহায়তায় হরিচাঁদ ঠাকুরের গান লিখেছেন।
এ পর্যন্ত লেখিকার নিচের আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১ নীল দিগন্ত
২ চোখের কোণে জল
৩ নূতন ভোর
৪ বসন্তরেণু
৫ শিউলি বেলার সুর
৬ বিবর্ণ বনলতা
৭ তপন বাগচী গভীর অনুধ্যান
৮ স্বপ্ন সফর (গল্প বই)
দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পথে।
১ শিমুলরঙা সূর্য