Advt

Advt

sakshi-story-by-nandita-saha-tatkhanik-digital-bengali-online-bangla-web-e-magazine-সাক্ষী

sakshi-story-by-nandita-saha-tatkhanik-digital-bengali-online-bangla-web-e-magazine-সাক্ষী

 নন্দিতা সাহার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

আমরা বাড়িতে সর্বসাকুল্যে আট জন ছিলাম। আমরা তিন ভাই বোন, বাবা, মা, ঠামি।  আর ছিল আমার ছোট্ট পোষা কুকুর নাম মুসি । এছাড়া  ছিল রাইমোহন দাদা।

রাইমোহন দাদাকে আমি কখনো কাকু কখনোবা দাদুও বলে ফেলতাম। জন্ম ইস্তক ওকে  আমি দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে। সে নাকি আমাদের বহু পুরনো, যাকে বলে পুরাতন ভৃত্য।   তিন কুলে তার কেউ নেই, সারাজীবন রয়ে গেছিল আমাদের বাড়িতেই। যাকে  বলে  নিপাট ভালো মানুষের অনবদ্য উদাহরণ। 

 এমনিতে আমরা তিন ভাইবোন পড়াশোনা, খেলা ধূলো নিয়ে  ব্যস্ত,  বাবা ব্যস্ত তার কাজে, মা গেরস্থালি, ঠাকুমা ব্যস্ত তার আচার বিচার নিয়ে। মাকে শাসন বাসন করাতেও মোটে পিছপা ছিল না ঠামি। আমার জাঁদরেল ঠাকুমার শাসনের ভারে মায়ের ঘাড় সেই যে  কুঁজো হয়ে রইল  সে আর  সারা জীবনে সোজা হলো না। তবে মায়ের  কিন্তু তাতে মহা  আনন্দ ছিল, এতটুকু দুঃখ ছিল না।

নিয়ম মেনে সব পূজো পার্বণই হত বাড়িতে ঠামির নির্দেশে। প্রতিবছর রং খেলার দিন ঠামি তার গোপাল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। সকাল থেকেই সারা পাড়ায়, এলো রে এলো রে হোলি এলোরে, শুরু হয়ে যেত। সবাই মেতে উঠতো।  বাবার দু'চারটে বন্ধু আসতো। তারা এলেই শুরু হতো হুটোপুটি,  কে কাকে রং দেয়, জোর জুলুম! মাকে ঘর থেকে টেনে  বের করে রং দিতে পাড়া র দিদিরা। সব দেখে আমি ভয়ে সিঁটকে থাকতাম। আমার পাংশু মুখ দেখে কেউ আর আমায় ঘাটাতো না, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে চলে যেত, খুব বেশি হলে কপালে আবিরের ছোট্ট একটি টিপ পরিয়ে দিতো আহ্লাদ করে । আমার দাদা দিদি আমাকে ঠেঙ্গা দেখিয়ে  রং- এর  বালতি নিয়ে  বাইরে চলে যেত, হই হই করতে করতে।

 আমি তখন একা কি করি! আমার একমাত্র সঙ্গী তখন মুসি। আমি মনের সুখে নিরুপদ্রবে মুসির সাদা ধবধবে শরীরে নানা রকম রং লাগাতাম, লাল নীল সবুজ। মুসি একেবারে রঙ্গিন  হয়ে উঠতো। মুসিও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতো হয়তো বেশ আরাম লাগতো। ঠামি মুখ বেঁকিয়ে বলতো  কুকুর টাকে আর কত রঙ মাখিয়ে  সং সাজাবি রে, এবার নিজের মাথায়  মাখো। ভিতুর ডিম একটা! মানুষকে রং মাখাতে পারিস না!! 

মা ও আমার কান্ড দেখে খিলখিল করে হাসে।  আমার খুব রাগ হত। মনে হত ঠামির  দিকে খানিক রং ছুড়ে দেই।  কিন্তু সে দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠামি সাদা থান পরে, শরীরে এক বিন্দু রং লাগলে নাকি বংশ নির্বংশ হবে, তার নাকি নরকেও স্হান হবে না। তাই ঠামিঐ দিন  ঘর থেকে বেরোয় না পাছে একফোঁটা রং উড়ে এসে তার কপালে কিংবা শাড়ির আঁচলে লাগে। সে পাপ নাকি ধম্মে সইবে না।

 আমি রাইমোহন দাদার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। রাইমোহন দাদা বিন্দাস তার মাথাটা  এগিয়ে দিতো হাসি হাসি মুখ করে, আমিও তার তেলতেলে টাকে আবির ঢালতাম। তাতেও ঠামি চুপ থাকত না,জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে  বলতো, আবিরের পয়সাই জলে, টাকে আবার কেউ রং ঢালে? আবির ধরবে? ফু দিলে সব তো উড়ে চলে যাবে।

  মিথ্যে অবশ্য কিছু বলেনি। আমারও কিছু করার নেই। রাই মোহন দাদা দুই মিনিটে ঝেড়ে ঝুড়ে একেবারে পরিষ্কার ঝকঝকে। শেষমেষ আমার পুতুলগুলোকেই বসে বসে  রং মাখাতাম। মাখাতে মাখাতে সবার আড়ালে একটা কান্ড করতাম!!!!! কেউ জানতে পেত না। সাংঘাতিক কান্ড! জানলে আমার কি শাস্তি  যে হত!ভাবতে ও গায়ে কাঁটা দেয়।

ঠামি তখন চোখ বন্ধ করে মালা টপকাতে ব্যস্ত,  মা তখন স্নানঘরে। বাড়ির অন্য রা সবাই বাইরে। আমি এই সুযোগটাই খুঁজতাম সকাল থেকে। সুযোগ বুঝে আমি পায়ে পায়ে যেতাম  বাড়ির পেছনের ঘরে। কেউ যেন টেরটি না পায়। 

আগেই বলেছি আমরা বাড়িতে সর্ব সাকুল্যে আটজন। অষ্টম মানুষটি একেবারে পেছনের  ঘরে থাকে, আমার বাবার পিসতুত বোন, বাল বিধবা। আমার ঠামির দুই চোখের  বিষ। তাই তার আলাদা ঘরে  আলাদাভাবে থাকার  ব্যবস্থা। আমি চুপিচুপি তার ঘরে ঢুকতাম,  পিসিও যেন আমার জন্য সে দিনটিতে হা করে  বসে  থাকতো। 

আমাকে দেখে তার দুই চোখে সে কি আনন্দ! আমি ঘরে ঢুকলেই দরজায় খিল দিত। আমি ছোট্ট ছোট্ট হাতে  পিসির  মুখে,মাথায়,ধবধবে সাদা শাড়িতে রং মাখিয়ে পিসিকে রঙিন করে দিতাম। পিসি তার ছোট্ট আরশিতে বারে বারে নিজের রঙিন মুখটা  দেখতো। খুব  খুশি হত, কখনো কখনো দুই চোখে থাকতো জল।  তারপর আবার চুপিচুপি আমি ফিরে আসতাম বাড়িতে। কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারত না।  পিসির সাথে  চুক্তি  ছিল। পিসি আমাকে মনে করিয়ে দিত কাউকে  বলবি না কিন্তু, কাউকে না, তবে কুলের আচার দেবো।

 না, কাউকে বলিনি, আজও বলিনি। কাণ্ডটি গোপনই রয়ে গেছে চিরকাল।   পিসির বছরের কেবল এই একটি দিন রঙিন হয়ে ওঠার বাসনা আমি  বাঁচিয়ে রেখে ছিলাম। তার ইচ্ছে আমি পূর্ণ করেছিলাম যত দিন পেরেছি ,  কুলের আচার এর লোভে নয়, এমনি, কিছু না বুঝেই না ভেবেই।

পিসির রঙ্গিন মুখটি দেখতে আমারও বড্ড ভালো লাগতো। আমিও বছরে একটি মাত্র দিন ওই  রঙ্গিন মুখটি দেখবার   জন্য মুখিয়ে থাকতাম যে!!

সময়ের স্রোতে সব কোথায় ভেসে চলে গেছে। কেবল আরসী টি রয়ে গেছে। এক বিধবার চুপি চুপি  রঙিন হয়ে ওঠার একমাত্র সাক্ষী। 

লেখিকার পরিচিতি -

জন্ম পশ্চিমবঙ্গ-র কুচবিহার শহরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতার বই ' সুখের ঠিকানা', গল্প সংকলন 'চিরন্তন'। ইংরেজি কবিতার বই 'Bouuet of Poems' বিভিন্ন পত্রিকায় লেখেন। বেশকিছু কিশোর সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। 

স্টেটস্‌ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন ।  বহু e magazine এ লেখেন ।