আমার এক লেখক বন্ধু প্রায়শই দুঃখ করে বলেন, ‘আমার লেখা প্রুফ রিডার ছাড়া আর কেউ পড়েনা।’ আমি ঠাট্টা করেই বলি,‘আমি আপনার থেকে ভাগ্যবান, আমার লেখা প্রুফ রিডার ছাড়াও
একজন পড়েন,তিনি আমার স্ত্রী। সিরিয়াল দেখে দেখে বোর হয়ে গেলে
বইয়ের র্যাকে আমার বইয়ে হাত দেন উনি।’
বেশ কিছুদিন ইংরেজিতে লেখালেখি করে বছর ছয়েক আগে
বাংলায় আবার গল্প উপন্যাস লিখতে শুরু করলে দুটো জিনিষ লক্ষ করেছিলাম। এক,বাংলায়
পত্র-পত্রিকার সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে আর দুই, পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা এখন বেশি। কলকাতায় প্রকাশকের সংখ্যাও আগের তুলনায়
অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় বই ছাপানো এখন অনেক সহজ যদিও ছোট, নতুন প্রকাশকরা অনেকেই লেখকদের কাছ থেকে কম বেশি কিছু টাকা নিয়েই বই ছাপার
কাজে নামেন। ফেসবুক খুললে দেখা যাবে বিগত বইমেলায় খ্যাত এবং স্বল্পখ্যাত অনেক
লেখকেরই একাধিক, এমনকি তিন চারটি করে বই প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাবতই মনে
প্রশ্ন জাগে এত বইয়ের পাঠক কোথায়?
এবছর বইমেলায় গিয়ে দেখলাম আনন্দ, দে’জ, মিত্র ও ঘোষ এবং আরও দু’একটি স্বনামধন্য প্রকাশনার
স্টলের সামনে ক্রেতাদের ভিড়, লাইন দিয়ে বই কিনছেন কলকাতা এবং মফস্সল থেকে আসা
জনতা। এরা প্রধানত কিছু নামি লেখকের সদ্য প্রকাশিত গল্পের বই কিংবা উপন্যাস কেনার
জন্যই ভিড় করেন বইয়ের স্টলে। কিন্তু বইমেলায় অন্যান্য স্টলগুলোতে তত ভিড় নেই। কিছু
ক্রেতা বই কেনার থেকেও বই দেখা বা উইন্ডোশপিং করে যাচ্ছেন এমনটাও নজরে পড়ে। আবার
বইপ্রেমি বয়স্ক বা মধ্যবয়স্ক মানুষ সঠিক খবর নিয়ে সঠিক বইয়ের স্টলে গিয়ে নিজের
পছন্দের বইটি কিনে নিচ্ছেন এটাও লক্ষ করার মত। লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রশস্ত চত্বরে অবশ্য প্রতিদিনই ভিড় ছিল। এই প্রাঙ্গণ পরিচিত
এবং অপরিচিত লেখকদের মিলনস্থল বললে ভুল হবেনা। বিক্রিবাটাও এখানে ভালই হয়ে থাকে।
বইয়ের স্টলে ভিড় থাকুক কিংবা নাই থাকুক বইমেলার পিছন
দিকে যে বিশাল ফুড কোর্ট বসেছিল তাতে তিল ধরণের স্থান খালি ছিলনা। চপ, কাটলেট, ফিশ ফ্রাই, মাটন কষা আর বিরিয়ানি খাবার
জন্য প্রায় কাড়াকাড়ি মারামারি লেগে যায় ওখানে। লক্ষ করলে দেখা যায় খাবার লাইনের এই
লোকদের অনেকের হাতেই বই নেই, অর্থাৎ মেলা প্রাঙ্গণে বইয়ের স্টলে ঘোরাঘুরি করে সময়
নষ্ট না করে সরাসরি ফুডকোর্টে রকমারি খাবারের অন্বেষণ করা বেশি লাভদায়ক মনে করেন
অনেকেই। প্রবেশমূল্যহীন মেলায় খোলা মঞ্চে নাচ গান দেখা এবং খাওয়ার আনন্দ নেবার
উদ্দেশ্যেই এরা এসে যান প্রতিবছর। কাজেই অনুমান করা যায় যে বইমেলায় বই বিক্রির যে
হিসেবটা পাওয়া যায় ( এ বছর ২৭ কোটি) তার সিংহভাগ আসে বড় প্রকাশকদের স্টলে নামি
লেখকদের বই, কিছু পাঠ্যপুস্তক এবং ধর্মীয় বইয়ের বিক্রি থেকে।
কলকাতা বই মেলার আগে এখন পশ্চিমবাংলার প্রায় প্রতিটি জেলায় বইমেলার আয়োজন করা হয়ে
থাকে, কাজেই ওই মেলাগুলোতেও কিছু বই বিক্রি হয়ে থাকে।
কিন্তু যে প্রশ্নটা দিয়ে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম
সেটা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। বাংলায় এখন যে পরিমান বই ছাপা হয় তার পাঠক কোথায়? প্রত্যেক প্রকাশকই চান লেখক তাঁর নিজের বইটি বিক্রির ব্যাপারে সহযোগিতা করুন, কাজেই অনামি লেখক দু’ভাবে নিজের বই বিক্রির কাজে নেমে পড়েন। এক, ফেসবুক এবং অন্যান্য সোসাল মিডিয়াতে বইটিকে প্রচার করা আর দুই, নিজের পরিচিত গন্ডির মধ্যে ‘পুশ সেল’ করা। ফেসবুকে বই-এর ছবি দিলে প্রচুর ‘লাইক’, ‘অভিনন্দন’ এবং ‘শুভেচ্ছা’ আসতে থাকে, ঘণিষ্ঠ দু’চারজন বইটি কিনবেন
এমন প্রতিশ্রুতিও দেন যদিও সেই প্রতিশ্রুতি তাঁরা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেন কিনা সে
বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে দু’একজন সুদীর্ঘ ‘পাঠ-প্রতিক্রিয়া’ ফেসবুকে দিলে বোঝা
যায় যে বইটি তাঁরা সত্যিই পড়ে নিয়েছেন। লেখকের পরিচিতির পরিধি বড় হলে কিংবা কোন
বাঙালি প্রতিষ্ঠানের( কালীবাড়ি, পত্রিকা গোষ্ঠি ইত্যাদি) সঙ্গে যুক্ত থাকলে পঞ্চাশ থেকে একশো কপি বই
বিক্রি করার সুযোগ মেলে। সব মিলিয়ে কোন নতুন লেখক যদি একশো থেকে দেড়শ’ কপি বই
বিক্রি করতে পারেন তবে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেন। ভুত-প্রেত, অলৌকিক, থ্রিলার কিংবা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা বইয়ের কাটতি
এর থেকে কিছু বেশি হতে পারে আর কবিতার বই হলে পঞ্চাশ কপি বিক্রি করা বেশ কষ্টকর
হয়ে দাঁড়ায়। সব মিলিয়ে অনামি লেখকের বই দুশো কপি বিক্রি হলে বেস্ট সেলারের আখ্যা
পায় বইটি এবং পুর্নমুদ্রণ-এর কথা চিন্তা করেন প্রকাশক।
ইংরেজিতে
বই লেখা এবং প্রকাশ করার কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকায় বাংলা বইয়ের সঙ্গে ইংরেজি বই
প্রকাশনার একটা তুলনামুলক বিচার করার চেষ্টা করা যেতে পারে এখানে। শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা এরকম নামি লেখক ছেড়ে দিলে
অন্যান্য লেখকদের বই সাধারণত তিনশো কপির বেশি ছাপা হয়না। ইংরেজিতে কোন নতুন লেখকের
প্রথম বইটি কমপক্ষে এক হাজার কপি ছাপা হয়ে থাকে কেননা ভারতের প্রত্যেক প্রদেশেই
ইংরেজি বইয়ের কিছু পাঠক রয়েছেন। ব্রিটেনে এই সংখ্যাটা তিন হাজার। এই সঙ্গে এ
কথাটাও মনে রাখা দরকার যে ইংরেজিতে স্বাধীন বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাব্লিশারের সংখ্যা
এখন খুব কম কারণ তিন দশক আগে থেকেই ছোট, স্বাধীন প্রকাশকরা বড়
প্রকাশকদের ছত্রচ্ছায়ায় আসতে শুরু করায় এখন বস্তুত ইংরেজি প্রকাশনার জগত পেঙ্গুইন, হ্যাচেট এবং হার্পার কলিন্স-এর মত বিশাল, আন্তর্জাতিক সংস্থার
অন্তর্ভুক্ত। এসব নামি প্রকাশনা সরাসরি কোন নতুন লেখকের কাছ থেকে বই নেননা কারণ
তাদের বই নেবার পিছনে মূলত দুটি কারণ থাকে – এক, লেখকের বই-এর গুনগত মান, দুই, বইটি বাজারে ভাল( অর্থাৎ তিন হাজার কিংবা তার বেশি) বিক্রি হবার সম্ভাবনা।
নতুন লেখকের বই নির্বাচন করার জন্য বাজারে রয়েছে বহু লিটেরারি এজেন্ট যাদের কাজ
নতুন লেখকদের পান্ডুলিপি পড়ে বইটি উপরোক্ত দুটি মানদন্ডে উত্তীর্ণ কিনা তা ভালভাবে
যাচাই করা। অর্থাৎ এজেন্টরা প্রকৃতপক্ষে প্রকাশকের হয়ে প্রকাশিতব্য বইয়ের শর্ট
লিস্টিং করার দায়িত্ব নেন। প্রকাশক সব সময় লিটেরেরি এজেন্টের রেকমেন্ডেশন মেনে
নেবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই কারণ প্রতিটি প্রকাশনার কমিশনিং এডিটর থাকেন যিনি বইটি
পড়ে সিদ্ধান্ত নেন বইটি শেষ পর্যন্ত নেওয়া হবে কিনা। এই দুই ছাঁকনির মধ্য দিয়ে
একটি বইকে যখন প্রকাশক বেছে নেন তখন লেখককে কন্ট্রাক্ট সই করিয়ে যে টাকাটা দেওয়া
হয় তাকে বলা হয় এ্যাডভান্স টুয়ার্ডস রয়্যালটি। লেখকের বই ভাল বিক্রি নাহলেও এই
রয়ালটি ফেরত দিতে হয়না লেখককে। আর বই বিক্রি হলে ভবিষ্যতে প্রকাশক যে অর্থ উপার্জন
করবেন সেটা এই এ্যাডভান্স রয়্যালটিকে ছাড়িয়ে গেলে তবেই লেখকের দশ পার্সেন্ট রয়ালটি
প্রাপ্য হবে। ইংরেজি বই প্রকাশনার পদ্ধতি বিস্তারে বলা শুধু এটুকু বোঝাতে যে নতুন
লেখকের ইংরেজিতে বই প্রকাশ করা খুব সহজ নয় আর একারণেই লেখকের সংখ্যা পাঠকের সংখ্যা
থেকে বেশি হয়ে যাবার মত উদ্ভট পরিস্থিতির সম্ভাবনা নেই। সম্ভবত এই কারণেই ইংরেজিতে
‘সেলফ পাব্লিশিং’ ইদানীং একটি বড় ব্যবসা হতে চলেছে। বাজারে এখন বেশ কিছু প্রকাশক
এসেছেন যাঁরা প্যাকেজ ভিত্তিতে লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেন। দু’চারজন
প্রকাশক ‘হাইব্রিড পাব্লিকেশন’ নামে আরেকটি জিনিষ বাজারে চালু করেছেন যার সহজ অর্থ
লেখক এবং প্রকাশক প্রকাশনার আধাআধি খরচ বহন করবেন। তবে বই বিক্রির মূল দায়িত্ব
থাকবে লেখকের উপর, শুধু আইএসবিএন লাগিয়ে আমাজন ফ্লিপকার্টে বই কেনার
ব্যবস্থা করে দেবেন প্রকাশক।
বাংলা প্রকাশনা জগতে নিয়ম কানুনের কেউ ধার ধারেননা।
বড় দু’চারটি প্রকাশনা লেখককে তাঁর রয়্যালটি দিয়ে থাকে, বাকিরা বেমালুম বইয়ের উপার্জন হলপ করে নেয়। তিনশো কপি বই ছাপিয়ে একশো বলে
লেখককে ধোকা দেবার ঘটনা অনেক লেখকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে।
বই প্রকাশনার উপর যখন কোন প্রতিবন্ধকতা আনা সম্ভব নয়, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে পাঠকের সংখ্যা কীভাবে বাড়ান সম্ভব।এক সময়
পত্র-পত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা পড়ে বই কিনতে যেতেন পাঠক, এখন পুস্তক সমালোচনা নেহাতই একটা দায়সারা গোছের ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেছে। বইয়ের
সুচিন্তিত দীর্ঘ সমালোচনা এখন খুব কম ছাপা হয়, বেশির ভাগই পাঁচ সাত লাইনের
উল্লেখ মাত্র যাতে বইয়ের ঘটনার সারাংশ এবং মুখ্য একটি দুটি চরিত্রের নাম দেওয়া
থাকে। ফেসবুকের ‘পাঠ প্রতিক্রিয়া’ অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধুকৃত্য মাত্র যা ফেরত দিতে
হয় লেখককে তার সমালোচক বন্ধুর বইটি বেরোলে একটি প্রশংসামূলক পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়ে।
ভাল লেখা সব দেশে সব কালেই বাজে নিকৃষ্ট লেখার তুলনায়
কম হয়ে থাকে। সময়ের বিচারে খারাপ লেখা আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকে আর পঞ্চাশ কিংবা একশো
বছর পেরিয়ে যাবার পরেও ভাল লেখা ফিরে আসে, নাহলে আজকের পাঠক সোমেন চন্দ
কিংবা জগদীশ গুপ্ত-র বই কিনতে আগ্রহ দেখাতেননা। কাজেই পাঠক কমছে এ কথা জেনেও লেখক
লিখে যাবেন কারণ লেখনী স্তব্ধ হয়ে গেলে তাঁর জীবন অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। আজ যাঁর বই
বাজারে বিক্রি হয়না তিন দশক বা চার দশক পরে হয়ত তাঁর বই বিক্রি হবে, ভুলে যাওয়া লেখককে নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন আগামি দিনের পাঠক। এই আশা এবং
বিশ্বাস নিয়েই লেখা চালিয়ে যেতে হবে লেখককে।
- - -
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় দুটি উপন্যাস এবং দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন নলিনাক্ষ। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।