লেখকের আগের লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
এই পৃথিবীতে
কত কি যে জানার আছে তা ভাবলে অবাকের সীমা ছাড়িয়ে যায়।অথচ যাঁরা এসব প্রথম
জেনেছিলেন আর আমাদের জানিয়েছিলেন তাদের লেগেছিল কত কাল। আজ এরকম কিছু জানার কথা
স্মরণ করব।
মহাকর্ষ বা
মাধ্যাকর্ষণ
মহান
বৈজ্ঞানিক নিউটনের মাথায় গাছ থেকে আপেল পড়ার গল্প কে না পড়ছে?আসলে মাথায় আপেল হয়ত
পড়েনি।আসলে যখন কেম্ব্রিজে পড়া-শুনো করছিলেন তখন বড় বড় শহরে প্লেগ মহামারী শুরু
হলে উনি গ্রামের দিকে পালিয়েছিলেন,সেই সময়
একদিন লনে বসে ভাবছিলেন,এমন সময়
জোরালো হাওয়ায় গাছ থেকে একটি পাকা আপেল মাটিতে পড়ল।নিউটন ভাবতে লাগলেন এমন কেন হল?শুকনো পাতা অথবা কাপাস
তুলো ত মাটিতে না পড়ে হাওয়ায় ভেসে দূরে চলে যায়,এমন কি গাছের উপরেও উড়ে
চলে যায়।আপেলটা কেন নিচে পড়ে গেল? চব্বিশ-পঁচিশ
বছরের যুবক আইজাক নিউটনকে ঘটনাটা ভাবিয়ে তুলল। ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত হল মহাকর্ষ বা
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।এই শক্তির বলেই আপেলটি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ধেয়ে এলো।এই হল
সোজা-সাপটা ভাষায় গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ-শক্তি।সেই সুদূর ১৬৬৬ খৃস্টাব্দেই
নিউটন আবিষ্কার করলেন মাধ্যাকর্ষণ অথবা থিওরি অফ গ্র্যাভিটেশন। অবশ্য, বললেই ত ব্যাপারটা
দুনিয়ার বৈজ্ঞানিক মহল স্বীকার করে নেবে না।ব্যাপারটা হাতে নাতে প্রমাণ করে দিতে
নিউটনের ১৮ বছর লেগে গিয়েছিল।শেষে ১৬৮৪ তে উনি হাতে নাতে প্রমাণ করে দিলেন যে
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বা মহাকর্ষ সর্বত্র বিদ্যমান।এই তথ্য অনুসারে প্রত্যেক বস্তুই
অন্য বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে।পৃথিবী যেমন আপেলটিকে আকর্ষণ করে তেমনি
আপেলটিও পৃথিবীকে আকর্ষণ করে।এইভাবে এই ইউনিভার্স বা ব্রহ্মাণ্ডে সকল বস্তুই একে
অন্যকে আকর্ষণ করছে।চাঁদ যেমন পৃথিবীকে আকর্ষণ করে(সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা হয়) তেমনি
পৃথিবীও চাঁদকে আকর্ষণ করছে,তাই ত চাঁদ
ছিটকে মহাকাশে চলে যেতে পারে না।এই বিশাল শক্তি ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র কম-বেশি
বিরাজমান।তা নাহলে এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে অসংখ্য গ্রহ,তারা,নক্ষত্র আর গ্রহানুকণার
ঠোকাঠুকি লেগে যেতো না?তাই যখন আমরা
বলি আমার ওজন ৬২ কিলোগ্রাম সেটা আসলে কত জোরে আমি পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত
হচ্ছি।তারমানে এই যে মহাকাশের শূন্যতায় কোন জিনিষের ওজন শূন্য হয়ে যায় কিন্তু সেই বস্তুর
শরীরের উপাদানের কিছু কমবেশি হচ্ছে না খালি মাধ্যাকর্ষণ নেই বলেই তার ওজন শূন্য
হয়ে মহাকাশে ভাসে। এইভাবেই গ্র্যাভিটি এই ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতা বানিয়ে
রাখছে-ঠোকাঠুকি না লাগিয়ে আপন আপন কক্ষপথে ঘুরে চলেছে অনন্তকাল ধরে।
হিমালয় আর
এভারেস্ট শৃঙ্গ
আমরা জানি
আমাদের দেশের উত্তরের প্রহরী হিমালয় বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বত আর এভারেস্ট
সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। কিন্তু আসলে টা সম্পূর্ণ সত্যি নয়।হাওয়াই দ্বীপের ‘মওনা কী’(Mauna Kea) একটি সামুদ্রিক
পাহাড়। সমুদ্র(প্রশান্ত মহাসাগর)-তল
থেকে যদি এর উচ্চতা মাপা যায় তাহলে মোট উচ্চতা এভারেস্টকে ৫০০ ফুটের উপর ছাড়িয়ে যায়! কারণ সমুদ্রতল থেকে জলের সমতল পর্যন্তই
এর উচ্চতা ১৫,৭৪৮ ফুট আর
সমুদ্র-জলের উপর থেকে এটি আরও ১৩,৭৭৯ ফুট
উঁচু। হিসাব করে দেখুন এভারেস্টের চেয়ে ৫০২ ফুট বেশি হল কিনা। আর পশ্চিম প্রশান্ত
মহাসাগরে অবস্থিত চ্যালেঞ্জার ডিপ এর কথা ত আমরা আগেই পড়েছি- ৩৬,০৮৯ ফুট; হিমালয়কে ওতে সম্পূর্ণ
লুকিয়ে ফেলা যায়। আর হিমালয়ের বিস্তার? মোটে ১৫,২০০ কিলোমিটার।মোটে
বললাম এই কারণে যে অ্যাটলান্টিক সমুদ্রের নিচে মাঝ বরাবর উত্তর-দক্ষিণে যে বিশাল
পর্বত শ্রেণী আছে,যাকে বলা হয়
‘মিড-আটলান্টিক রিজ’(MAR:Mid
Atlantic Ridge) তার দৈর্ঘ্য হল ৪০,০০০ কিলোমিটার!!
গরম জলের
স্রোত ‘গালফ স্ট্রিম’(Gulf
Streem) এর কথা আমরা শুনেছি। লবণাক্ত সমুদ্রের মাঝে এই গরম আর
মিষ্টি জলের ‘নদী’ আটলান্টিক মহাসাগরের জলের প্রায় দেড়শ ফুট মাঝখান দিয়ে ঘণ্টায় ৮
কিলোমিটার বেগে পুব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলে কয়েক হাজার কিলোমিটার। কি অবাক কাণ্ড, লবণাক্ত সমুদ্র জলের
মাঝখানে মিষ্টি-জলের নদী ! কারণ দুটি জলের ঘনত্ব বিভেদ। ঠিক একই কারণে কখনও কখনও
আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরের মিলন স্থানে দুই সমুদ্রের মিলন-রেখা স্পষ্ট হয়ে
ওঠে।
জর্ডান আর
ইজরায়েলের মাঝে এমন একটি ‘সমুদ্র’ আছে যার নাম “ডেড সি”, আমরা সবাই নাম
শুনেছি।এটি আসলে একটি সমুদ্রই নয়-একটি মাঝারী আকারের হৃদ মাত্র-পৃথিবীর সবচেয়ে
নিচের হৃদ। লম্বা-চওড়ায় মাত্র ৮২ কিলোমিটার বাই ১৮ কিলোমিটার।এর অবস্থান গড়
সমুদ্র-সমতলের(Mean Sea
Level) ১৩০০ ফুট নিচে। এর জল এতই নোনতা যে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী
এর জলে বাঁচতে পারে না। তাই এর নাম ডেড সি।আর এই গাঢ় নোনতা জলে গা
ভাসিয়ে যে কেউ(সাঁতার জানার প্রয়োজন নেই) বসে বসে বই পড়তে পারে।ডুবে যাবার ভয় থাকে
না।
মাত্র ৬০
লক্ষ বছর আগে ভূমধ্য মহাসাগর ছিল একটি মরুভূমি। হ্যাঁ একটি বিশাল মরুভূমি। কোন
প্রাকৃতিক কারণে জিব্রাল্টার প্রণালির মুখে বিশাল পাথরের দেয়াল সরে গিয়ে
অ্যাটলান্টিকের জল এসে ভরে গেল সেই মরুভূমি, হয়ে গেল
আজকের ভূমধ্যসাগর। আর ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল আরবের মরুভূমিতে।প্রায় ৫০০০ বছরের আগে এই
অঞ্চল ছিল ‘হরা-ভরা’ গ্রাম আর আলোকিত শহর।
আমরা সবাই
জানি পৃথিবী তার অক্ষের চারিদিকে ঘুরছে প্রচণ্ড গতিতে।আর একই সঙ্গে বিশাল গতিতে
সূর্য প্রদক্ষিণ করছে। কত জোরে? যথাক্রমে
১৬০০ কিলোমিটার আর ১,০৭,২০৮ কিলোমিটার প্রতি
ঘণ্টায়! বুঝতে পারা যায় ? প্রথম গতির ফলে পাই দিন
আর রাত্রি আর দ্বিতীয় গতির ফলস্বরূপ দেখি বছরের বারোটা মাস।এ সব জানতে
বৈজ্ঞানিকদের কত কত শত বছর অনলস পরিশ্রম করতে হয়েছে।
আমাদের এই
পৃথিবীর শতকরা ৭১ ভাগ হল জল,আমরা সবাই
জানি।কিন্তু আমরা এও ত জানি যে সৌর নেবুলা থেকে যখন সূর্য,পৃথিবী আর অন্য গ্রহরা
সৃষ্টি হয়েছিল তখন আমাদের এই পৃথিবী ছিল ভীষণ উত্তপ্ত আগুনের গোলা সমান। তখন ত কোন জল তরল
অবস্থায় থাকা সম্ভব ছিল না। তাহলে পরবর্তীকালে এত জল এলো কোথা থেকে? ভাবার মত প্রশ্ন। বছরের
পর বছর গবেষণার পর এখন বৈজ্ঞানিকদের সর্ব-সম্মত অভিমত হল, আমাদের গ্রহে জল এসেছিল
মহাকাশ আর মহা-ব্রহ্মাণ্ড থেকে-ধূমকেতু আর অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহকণার মাধ্যমে।কি
অসাধারণ জ্ঞান।
সমুদ্র আমরা
প্রায় সবাই দেখেছি-সে ঘরের কাছের বঙ্গোপসাগর/আরব সাগর হোক কিম্বা ঘর থেকে দূরের
আর্কটিক সাগর
অথবা অ্যান্টার্কটিক সাগর হোক। সাগরের ঢেউ ও ত দেখেছি।কিন্তু এই ঢেউ কত সাঙ্ঘাতিক
জোরে চলতে পারে সেটার হয়ত আমাদের সম্যক জ্ঞান নেই। সময় সময়ে এই সমুদ্র-ঢেউ ঘণ্টায়
৮০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ধেয়ে আসতে পারে।এই গতি আধুনিক জেট-প্লেনের গতির সমান!
হ্যাঁ, একটুও বাড়িয়ে বলছিনা।সন ১৯৪৬ এ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের উপকুলে এক
বিশাল সুনামি আঘাত করেছিল।সেই সুনামির ঢেউ ৪ ঘণ্টায় ৩৬০০ কিলোমিটার ধেয়ে গিয়ে আঘাত
করেছিল হাওয়াই এর ‘হিলো’ নামক উপকুলের শহরে। তাহলে ঘণ্টায় গতি কত হল ? এই দুর্যোগে ‘হিলো’তেই ১৭৩
জন মানুষের প্রাণ-নাশ হয়েছিল। ঢেউ এর সর্বোচ্চ উচ্চতা হয়েছিল ৪৫ ফুট।
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।