Advt

Advt

Ekush-Unish-banglar-megali-barnamala-feature-probondho-by-krishna-mishra-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-online-bangla-web-e-magazine-একুশ-উনিশ-বাংলার-মেঘালী-বর্ণমালা

Ekush-Unish-banglar-megali-barnamala-feature-probondho-by-krishna-mishra-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-online-bangla-web-e-magazine-একুশ-উনিশ-বাংলার-মেঘালী-বর্ণমালা


কোমর ছিন্ন  ফুলের কোরক  ভাঙা হীরক দ্যুতির লাল  টকটকে  ভোর একুশ  আর  একুশের  হাত ধরে ঊনিশ  শুধুই  বাজিয়ে চলে দুখিনী বাংলা  র একলা  উদাস  বীণা। মনের  ভেতরটা টনটন করে রিণরিণ বেজে  ওঠে অসহ্য  দুঃখ  অথবা সুখের  আপ্লুত  কান্নায়।একুশ, ঊনিশ  তাই তো বাংলার  যাপিত জীবনের  মেঘালী বর্ণমালা।

বুদ্ধিজীবি  শ্রী অম্লান  দত্ত  খুব  সম্ভবত  বলেছিলেন  কোথাও  যে সব ভালবাসাতেই দুঃখ  পেতে হয়।এমনকী ভাষাকেও।নিজের মুখের  ভাষাকে  ভালবেসে,দূঃখের,গৌরবের,শহীদের  মৃত্যু বরণ করতে প্রথম  দেখেছি এই  বাংলায়।বাংলার  কোমল গান্ধার  মাটি বারবার  ভিজে  গেছে  শহীদের  লাল রক্তে। এ এক আশ্চর্য  বেদনা বিধুর  ইতিহাস।সেই  ইতিহাস  পর্যালোচনা করার  আগে নিজেকে  প্রশ্ন  করি --কেন?কেন? বরাক উপত্যকার  প্রয়াত  কবি ও  আমাদের  প্রিয় অধ্যাপক  শক্তিপদ ব্রহ্মচারী তাঁর  --"আ মরি বাংলাভাষা--"প্রবন্ধে বলেছিলেন  যে ভাষা  যদি শুধু  মানুষের  ভাব প্রকাশের  কিংবা যোগাযোগ  মাধ্যম  হতো,তাহলে  হয়ত  ভাষা  নিয়ে  এই সূক্ষ্ম  অনুভূতি গড়ে উঠত না।

স্থূল জীবন-যাপনের  অতিরিক্ত  একটা বাসনা আমার  মধ্যে চিরন্তন।মানুষ  সৃষ্টি করে। আর তার  সেই  সৃষ্টি ভাষাকে কেন্দ্র  করে। আর সেই  সৃষ্ট  সাহিত্য  সংস্কৃতিকে কেন্দ্র  করেই  এক একটা জনগোষ্ঠীর  আইডেনটিটি বা পরিচিতি গড়ে ওঠে। আর এভাবেই  বাংলা ভাষাকে  ঘিরেই  বৃত্তান্ত হয়েছে বাঙালি জাতির  ইতিহাস, আশা,শিল্প  সাহিত্য। তাই  ভাষাকে বাদ  দিলে  বাঙালি জাতির  কোনও  অস্তিত্ব ই থাকে না। যদি কেউ  বলেন  তাতে  কী আসে যায়-কত ভাষাই তো বৃহৎ ভাষার  মধ্যে লুপ্ত  হয়ে  গেছে। লুপ্ত  হয়ে গেছে আমেরিকার  নেটিভ ইন্ডিয়ান  দের ভাষা--;সম্প্রতি ন্যাশনাল  জিওগ্রাফির  একটি সমীক্ষা অনুযায়ী  পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে  চৌদ্দ  টি করে ভাষা হারিয়ে  যাচ্ছে।স্বাভাবিক  ভাবে যে  ভাষার  মৃত্যু হয়  তার জন্য  বেদনা বোধ হলেও  করার  কিছুই  থাকে না। কিন্ত  যখন জোর করে, অন্যায় ভাবে  একটা  জাতির  জ্বলন্ত  ,সতেজ  ভাষাকে  মেরে  ফেলার  ষড়যন্ত্র  করা হয়,তখন  সে অন্যায় মেনে  নেওয়া যায় না। ভারতবর্ষ যখন  দ্বিখন্ডিত হয়  তখন বাংলা  এবং পাঞ্জাব  এই  দুটি  প্রদেশ  সব চাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছিল। রাজনৈতিক  দোলাচলে  খড়্গ  নেমে এলো। পূর্ব, পশ্চিম  /উত্তর, ঈশান--ভাগ হয়ে  গেল বাংলা। বাঙালি জনজাতি ও ভাগ হয়ে গেলেন-। ছিন্ন মূল হিন্দু জনজাতি রিফ্যুজি হয়ে  ভারতবর্ষের  বিভিন্ন  প্রান্তে--বিশেষ  করে পশ্চিম বঙ্গ,আসামে-।ধর্মের  ভিত্তিতে  বাঙালি মুসলমানরা  পেলেন পূর্ব  পাকিস্তান--যাকে বাঙালিরা সবসময়  পূর্ব  বাংলা ইতিহাস বলে এসেছেন। পূর্ব  পাকিস্তান  সৃষ্টির  পর থেকেই  পাকিস্তান  সরকার  ছলে-বলে কৌশলে বাংলা ভাষাকে  হটিয়ে দেবার চেষ্টা করে এসেছে।ঊর্দু হরফে লেখা  হয়েছে  বাংলার  ব ই পত্র। জোর করে  আরবি/ঊর্দু শব্দ  বসিয়ে  দেওয়া  হয়েছে কবিতায়,উপন্যাসে,শিশুদের  পাঠ্য পুস্তকে।নিষিদ্ধ  করে  দেওয়া হয়েছে পশ্চিম  বাংলার  ব ই।এমন কী রবীন্দ্রনাথ  পর্যন্ত  নিষিদ্ধ  করে দেওয়া হয়েছে।কিন্ত  বাঙালির  মুখে র ভাষা কে স্তব্ধ  করে দেওয়া এতো সহজ ছিল না।--১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে  উঠল ঝড়। ঢাকার  পল্টন মাঠের এক জনসভায়,খাজা নাসিমুদ্দিন যখন বললেন--"ঊর্দু--এবং একমাত্র  ঊর্ধ্বতন হবে পাকিস্তানের  রাষ্ট্রভাষা--তখন  সেই  অন্যায়  আগ্রাসনের  বিরুদ্ধে প্রতিবাদের  ঝড় তুলেছিলেন  তৎকালীন  পূর্ব  পাকিস্তানের  বাঙালি। ধর্মের  উপর  ভাষাকে  স্থান দিয়ে সর্ব ধর্মের  বাঙালি ইতিহাস  রচনা করে পথ মিছিলে গান গেয়ে উঠেছিলেন

--ওরা আমার  মুখের  ভাষা কাইড়া নিতে চায়--অভূতপূর্ব  আন্দোলনে ছাত্র, ছাত্রীরা  ১৪৪ ধারা অমান্য  করে বাংলা ভাষার  জয়গানে মুখর হয়ে  সত্যাগ্রহের  মিছিলে যোগ  দিয়েছিল।--সেদিন  ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি--১৯৫২ সাল সেদিন  চৈত্র মাস লাল টকটকে শিমূল,কৃষ্ণ চূড়ার  লাল রঙে বাংলা মায়ের  আঁচল রাঙিয়ে  দিয়ে শহীদের  মৃত্যু বরণ করল-সালাম,রফিক, বরকত,জব্বার  --আরও অনেক।সেই  রক্ত  বৃথা হলো না।পূর্ব  পাকিস্তানে বাংলা ভাষার  মূল প্রোথিত  হল।পরে--১৯৭১ সালে  এই  ভাষার  জন্যই জন্ম  নিল বাংলাদেশ--স্বাধীন  বাংলাদেশ---। যে দেশের  রাষ্ট্র ভাষা বাংলা--এবং বাংলা।

এই  ১৯৫২-র হাত  ধরে এলো ১৯৬১। ২১ শে ফেব্রুয়ারির  পর ১৯ শে মে। তদানীন্তন  আসাম সরকার  যখন ঘোষণা  করলেন--আসামের  সরকারি ভাষা হবে অসমীয়া এবং একমাত্র  অসমীয়া।প্রায় ৮৪% বরাকবাসীর মাতৃভাষা বাংলা।তারা এই  রাজ্য ভাষা বিলের বিরোধীতা করা সত্ত্বেও  যখন বিধান সভায় এই  অনৈতিক  রাজ্য ভাষার বিল বিধান সভায় পাস হয়ে গেল তখন বরাকউপত্যকার বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে আন্দোলনের  পথে  নামা ছাড়া আর কোন পথ রইল না।১৯৬১ সালের  ১৯ শে মে শিলচর  রেলষ্টেশন  এ এক শান্তিপূর্ণ  সত্যাগ্রহীদের  উপর  বিনা প্ররোচনায়  আসাম  পুলিশ  গুলি চালালে একজন  ১৫ বছরের  কিশোরী সহ শহীদের  মৃত্যু বরণ করলেন বরাক উপত্যকার  ১১ জন ভাষা সৈনিক।আহত হলেন আরও অনেকে।তাঁদের  রক্তের  বিনিময়ে বরাক উপত্যকার  বাঙালিরা মাতৃভাষা অধিকার  অর্জন  করলেন।সেই  ইতিহাসের  প্রেক্ষিত  এবং ইতিহাস  স্বাধীন  ভারতবর্ষের  এক লজ্জাজনক  ইতিহাস।তাই  সেই  অধ্যায় কে আসাম তথা ভারত সরকার  চিরদিন  লোকচক্ষুর  আড়ালে ই রাখতে চেয়েছে।কিন্ত  সত্য  কখনোই  চাপা থাকে না।প্রখ্যাত  কবি ও বুদ্ধিজীবি  মণীশ  ঘটক বাংলা ভাষার  প্রথম  মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্যের  প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে  লিখলেন

যে ভাষায় মাকে প্রথম  ডেকেছি ,

সে ভাষা আমার  দেবতা
কথা কইবার অধিকার
  তাতে -নেবই আমরা
নেব তা।
নেহেরু ফারুক চালিহার দল বলে
বুলেট
  না বাংলা
জান দেব তবু জবাব দেব না
করুক না যত হামলা।


১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো
  শহীদদের  প্রতি সম্মান  জানিয়ে  ২১শে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন।এই আমাদের  সমগ্র বাঙালী জাতির  গৌরব!
২০০৯ সালে বাংলাদেশ
  জাতীয় কবিতা পরিষদ  এর আমন্ত্রণে দিল্লি থেকে কবি ও সাহিত্যিক  দের ছ 'জনের একটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি চত্বরে  অনুষ্ঠিত  জাতীয় কবিতা উৎসব  এ যোগ দিতে যাই। অসাধারণ  একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি আমি। ১৮,১৯,,ও ২০ ফেব্রুয়ারি--এই  তিনদিন  ব্যাপী কবিতা উৎসবের  সূচনা হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল  ইসলাম,শিল্পাচার্য জয়নূল আবেদীন  এবং শিল্পি  কামরুল  হাসানের  সমাধিতে পুষ্প স্তবক অর্পণ করে।তারপর  আমরা সবাই  মিছিল  করে যাই কেন্দ্রীয় শহীদ  মিনারে--সেখানে পুষ্প  স্তবক  অর্পণ  করা হয়।--২১ শে ফেব্রুয়ারির  আগের রাত,অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে কাতারে কাতারে মানুষ  কে নগ্ন পায়ে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি--বাংলাদেশের  প্রত্যন্ত  প্রান্তর থেকে তারা এসেছেন শহীদ  মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন  করবেন বলে।রাত ১২ টায় তদানীন্তন  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  পুষ্প  স্তবক  অর্পণের পর জনসাধারণের  জন্য  মিনারের খুলে দেওয়া হয়।আমরাও  শহীদ  মিনারে পুষ্প  স্তবক  অর্পণ  করে ধন্য  হয়েছি!গৌরবান্বিত  হয়েছি!সেই  শ্রদ্ধা নিবেদন  চলেছে ২১ শে ফেব্রুয়ারির  সন্ধ্যা পর্যন্ত।

ব্যাকগ্রাউন্ড  মিউজিক  এ-মোদের গরব মোদের  আশা আ মরি বাংলা ভাষা এবং
আমার
  ভাইয়ের  রক্তে রাঙানো  ২১ শে ফেব্রুয়ারি
আমি কী ভুলিতে
  পারি

বেজে চলেছে!! আমার  চোখে তখন ২১ আর  ১৯ এক হয়ে মিশে গেছে।

২১ আর  ১৯ বাঙালি জীবনের  গাঢ় প্রত্যয়ের  সূর্য ওঠা,  বাঙালি জীবনের  সংস্কৃতি  শিল্প  সাহিত্যের  ধারাবাহিকতার পরম্পরা।তাই  বাঙালি চেতনায়  ২১ এবং ১৯ মিশে  যায়  গঙ্গা যমুনা  কিংবা  পদ্মা মেঘনার  গভীর  আলিঙ্গনে।


শেষ করছি কবি গোরাচাঁদ মন্ডলে র একটি কবিতার
  পংক্তি  দিয়ে

---"বন্ধু,তুমি কি খবর রেখেছ তারই
রফিক
  সালাম  বরকতদের  পরে
এসেছিল এক 'একুশে ফেব্রুয়ারি
স্বদেশ তোমার
  ভারতের  শিলচরে? একষট্টির
ঊনিশে মে তারিখেই

রেখে গেছে এক একুশে  ফেব্রুয়ারি।। 

লেখিকার পরিচিতি –

জন্ম-কলকাতায়  আসামের বরাক উপত্যকায় বড় হয়ে ওঠা 

প্রকাশিত গ্রন্থ

১--সাপ শিশির খায় (গল্প গ্রন্থ)
২--দেবী দহন--(কবিতা গ্রন্থ)

ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত

প্রকাশিত অডিও ভিডিও সিডি--দিল্লি হাটার্স এর তিন কবি   

Ekush-Unish-banglar-megali-barnamala-feature-probondho-by-krishna-mishra-bhattacharya-tatkhanik-digital-bengali-online-bangla-web-e-magazine-একুশ-উনিশ-বাংলার-মেঘালী-বর্ণমালা