লেখকের আগের লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ধূমকেতু সম্বন্ধে আমাদের মনে যাই ধারণা থাকুক না কেন এরা কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানে ভীষণ কাজের জিনিষ। আমাদের প্রায় সকলেই একটি ধূমকেতু সম্বন্ধে মোটামুটি জ্ঞান আছে-সেটি হল ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এড-মণ্ড হেলির আবিষ্কৃত ‘হেলির ধূমকেতু’ (Halley’s Comet)।ধূমকেতুটি ১৬৮২ সালে আবিষ্কার ও গত-প্রকৃতি রেকর্ড করেছিলেন এডমন্ড হেলি আর ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে এটি আবার ফিরে আসবে ১৭৫৮। হেলির ধূমকেতুটি কিন্তু খুব ছোট নয়।আকারে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এর ব্যাসার্ধ।
এড-মণ্ড হেলি ঐতিহাসিক তথ্য ঘেঁটে বের করেছিলেন
যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২৩৯ বছর আগে থেকে এই ধূমকেতুটি প্রতি ৭৫ থেকে ৭৯ বছরে
সৌরমণ্ডলে ফিরে ফিরে আসে।ইদানীং ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন বিজ্ঞান সংস্থা (ESA)ও
একথা তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সত্যি বলে প্রমাণ করেছে। সে
হিসাবে এই ধূমকেতুটি ৪৬৬ বি সি তেও এসেছিল পৃথিবীর সন্নিকটে,গ্রীক
পৌরাণিক নথিপত্রেও এর উল্লেখ পাওয়া গেছে। হেলি,১৬৮২ তে এই
ধূমকেতুটিকে আবিষ্কার করে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে হিসেব অনুসারে ১৭৫৮তে
ধূমকেতুটি আবার পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে। আর দেখা গেল সত্যি সত্যি ওই সময়ে ধূমকেতুটি পৃথিবীর আকাশে এসে
হাজির হয়েছিল। কিন্তু এডমণ্ড হেলি তা দেখে
যেতে পারেন নি কেননা ১৭৪২এ উনি দেহত্যাগ করেছিলেন।ওঁর মৃত্যুর পর ওঁকে সম্মান
জানাতে ওই ধূমকেতুটির নামকরণ করা হল ‘হেলির ধূমকেতু’ বা ‘Halley’s
Comet’। এইভভাবে এই ধূমকেতুটি ঠিক ঠিক দেখা গিয়েছিল ১৫৩১,১৬০৭,১৬৮২, ১৭৫৮,১৮৩৫,১৯১০,১৯৮৬
তে।আবার দেখা যাবে ২৬শে জুলাই ২০৬১ থেকে।এই ধূমকেতুটি সম্বন্ধে বেশ কিছু
ঘটনা/দুর্ঘটনার কাকতালীয় সম্বন্ধ থাকলেও এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া
কঠিন। মার্ক টোয়েন এর জীবনীকার যদিও লিখেছেন যে উনি(মার্ক টোয়েন) নাকি বলে ছিলেন,“এসেছি(জন্মেছিলেন)ওর
সাথে ১৮৩৫ এ ,যাবোও ওর
সাথে” (“I came with Halley in 1835. it is
coming again next year (1910) and I expect to go with it”)। মার্ক টোয়েন সত্যিই ২১ এপ্রিল ১৯১০এ
দেহত্যাগ করেছিলেন।সে যাই হোক, হেলির
ধূমকেতুই একমাত্র ধূমকেতু যাকে এক মনুষ্য জীবনে দুবার দেখা সম্ভব।
ইদানীং একটি বিশেষ ধূমকেতু নিয়ে বিশেষ
আলোচনা,পর্যালোচনা
চলছে।এই ‘অতিথি’ ধূমকেতুটি এই প্রথম আসছে আমাদের আকাশে।আগামী মাসের(ফেব্রুয়ারি,২০২৩) ২
তারিখে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসবে।এই বিশেষ ধূমকেতুটি অপূর্ব সুন্দর ‘রাজকীয়
সবুজ’ রঙের আভা বিকিরণ করতে দেখা যাবে উত্তর-পশ্চিম আকাশে, সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে
থেকে। একে আমাদের সৌরমণ্ডলের অতিথি বলা চলে। কেননা এ বহু দূর থেকে বহু যুগের পর
আসছে আমাদের সৌরমণ্ডলে। ধূমকেতুরা ত রোজ রোজ আমাদের আকাশে দেখা যায় না,আর এদের
দেখে ভয় পাবারও কোন কারণ নেই।এরাও আমাদের পৃথিবীর মতই এক মহাকাশ ‘প্রাণী’।খালি
তফাৎ হল এরা আমাদের পৃথিবী বা সৌরমণ্ডলের অন্য গ্রহ,উপ-গ্রহদের
মত সূর্য প্রদক্ষিণ করে না। এদের পথ হল ‘পরাবৃত্তা’কার
বা প্যারাবলিক। তাই এরা একবার সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলির পাশ কাটিয়ে গভীর মহাকাশে ‘ডুবে’
যায়।এই ধূমকেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে: C/2022 E (ZTF)। এ
আকারে খুব একটা ছোট নয়,ব্যাস প্রায় ১ কিলোমিটার।এই ধূমকেতুটি এই
প্রথম দেখা যাবে আমাদের আকাশে কারণ এর আগে একে পৃথিবীর আকাশে দেখা গিয়েছিল ৫০,০০০বছর
আগে,পুরানো
প্রস্তর যুগে।এর ‘পিরিয়ড’ বা পুনরাগমনের সময় বিরাট অর্থাৎ ৫০ হাজার বছর; অর্থাৎ ৫০,০০০বছর পরে
এটির আবার ফিরে আসার সম্ভবনা। রাজকীয় ‘সবুজ রঙে’র এই ধূমকেতু’টির সূর্যের সবচেয়ে
কাছের (পেরিহেলিওন) দূরত্ব হল ০. ৯১৪ AU অর্থাৎ
০.৯১৪ কে গুণ করতে হবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব (১৫ কোটি কিলোমিটার) দিয়ে।গত
বৃহস্পতিবার, ১২ই
জানুয়ারি থেকে খুব ভোরে (সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে) এ দৃশ্যমান হচ্ছে আমাদের
আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় দিগন্ত রেখার কাছে।রাজকীয় সবুজ আভার এই ধূমকেতুটি
আমাদের সবচেয়ে কাছে আসবে ২রা ফেব্রুয়ারির(২০২৩) ভোরে। তখন অল্প দামী দূরবীন বা
সাধারণ বায়নাকুলারের সাহায্যেও একে দেখা যাবে, বলে
‘নাসা’ জানিয়েছে। কয়েক মাস আগে,গত বছর (২০২২ )মার্চ মাসে এটি আবিষ্কৃত
হয়েছিল;তখন
অবশ্য একে খালি চোখে দেখা সম্ভব ছিল না।তারপর থেকেই বৈজ্ঞানিকেরা একে লক্ষ্য করছে
খুব মনোযোগ দিয়ে। ফেব্রুয়ারির (২০২৩) ২ তারিখে এ আসবে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে
৪.১৬কোটি কিলোমিটার দূরে। পঞ্চাশ হাজার বছরে এই ধূমকেতুটি এই প্রথম পৃথিবী থেকে
দেখা যাবে;কারণ
একে ত আগে কখনও পৃথিবীর এত কাছে আসেনি আর এর আগে যখন দেখা গিয়েছিল তখন আমাদের
পৃথিবীতে ‘প্রস্তর যুগ’ চলছিল। অতএব খুব অসুবিধা না থাকলে
এবার একে দেখার সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। কেননা একে আবার দেখা যাবার জন্য ৫০ হাজার
বছর অপেক্ষা করতে হবে।
এবার ধূমকেতুদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে
দু-এক কথা জেনে নিই:
ধূমকেতুরা সাধারণত আমাদের সৌরমণ্ডলের
বাইরে থেকে আসে,এদের
গঠন হয়েছিল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির কালে পড়ে থাকা ‘ধুলো-ময়লা’ থেকে।আর এদের যাত্রা পথও
বৃত্তাকার বা উপ-বৃত্তকার নয়। তাই বৈজ্ঞানিকরা বিশ্বাস করেন যে এদের পরীক্ষা করলে
ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য আরও একটু স্পষ্ট হবে। এদের যাত্রা পথকে বলা হয়
‘প্যারাবলিক’ বা পরাবৃত্তাকার অর্থাৎ এরা এই পরাবৃত্তাকার পথে একবার সৌরমণ্ডল
পরিক্রমণ করে গভীর মহাকাশে চলে যায়। তাই এদের প্রত্যাবর্তন কালও প্রায় অনন্ত। এরা
হল দীর্ঘ পথ-গামী ধূমকেতু।এই রকম আর একটি ধূমকেতু আছে যার নাম হেলি-বপ (Hale-Bopp) ধূমকেতু যার
প্রত্যাবর্তন সময় হল ২৩৯৯ বছর।স্বভাবতই এর
গতিপথও বিশাল।ধূমকেতুদের মধ্যে
কেউ কেউ আবার ফিরে আসে আবার কারও কারও মহাকাশ পরিক্রমার পথ এতই বিশাল যে ফিরে আসতে
কয়েক লক্ষ বা কয়েক কোটি বছর লেগে যায়; আর
প্রতিবার সূর্যের কাছ দিয়ে যাবার সময় এদের শরীরের উপরকার খুচরো আর ‘ঝুর-ঝুরে বরফের
আবরণ কিছু গলে গিয়ে আকারে পরিবর্তিত হতে থাকে। এইভাবে কয়েকবার সূর্য বা সূর্যের মত
‘তারা’র কাছ ঘেঁষে যাওয়া আসার পর অনেক ধূমকেতু মৃতপায় হয়ে কেবল মহাকাশের ধুলো-ময়লা
হিসাবেই পড়ে থাকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে ধূমকেতুর সঙ্গে কি
পৃথিবীর ‘ধাক্কা’ লাগা সম্ভব?
উত্তর হল,হ্যাঁ
৩০০মিটার পর্যন্ত ব্যাসের একটি ধূমকেতু প্রতি ৫০০ বছরে একবার আমাদের পৃথিবীকে
ধাক্কা মেরেছে।আর
১৬০০ মিটার পর্যন্ত ব্যাসের ধূমকেতুর ধাক্কার ঘটনা ঘটে ৬ হাজার বছরে একবার।তাতে
পৃথিবীর বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়না।
আগেই বলেছি ধূমকেতু কিভাবে গড়ে উঠে-এই
ব্রহ্মাণ্ড যখন গড়ে উঠে তখন যে সব ছোট-বড় পাথর,গ্যাস,ধূলি-কণা
মহাকাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুরে বেড়াত তারাই মাধ্যাকর্ষণের ফলে একত্রিত হয়ে তৈরি হয়েছিল
ধূমকেতু।তাই ধূমকেতুকে গবেষণা করে হয়ত একদিন আমাদের এই সৌরমণ্ডল গঠনের সঠিক পদ্ধতি
আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারা যাবে-এটাই বৈজ্ঞানিকদের প্রত্যাশা। আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান সংস্থা NASA(National Aeronautics and
Space Administration)’র “ষ্টারডাষ্ট” এবং “ডীপ ইমপ্যাক্ট” নামক
দুই ‘মিশন’ মারফৎ মহাকাশযান খুব কাছ দিয়ে উড়ে ধূমকেতুর অন্তঃস্থল পর্যবেক্ষণ ও
গ্যাস আর ধুলোর কণা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। সেই সব ধূমকেতু-কণা নিয়ে
আমেরিকা সহ অনেক দেশে গভীর গবেষণায় রত আছেন অনেক বৈজ্ঞানিক।কিন্তু
কেন এই বিশেষ গবেষণা ? সৌরমণ্ডল
বা ব্রহ্মাণ্ডের গঠন প্রণালী সম্বন্ধে আরও সঠিক জ্ঞান লাভের জন্য।
আবার একটি প্রশ্ন:
ব্রহ্মাণ্ডে
মোট কত ধূমকেতু আছে? বৈজ্ঞানিকদের
মতে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৪৫৮৪ টি ধূমকেতুর অবস্থান জানা আছে,তবে
ওঁদেরই মতে মোট ধূমকেতু ‘গুষ্ঠির’ মধ্যে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।ওদের মতে এই বিশ্ব
ব্রহ্মাণ্ডে ১ লক্ষ কোটির মত ধূমকেতু ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লেখকের পরের লেখাটি প্রকাশিত হবে আগামী রবিবার
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।