শারদীয় দুর্গাপুজা
তথা শারদোৎসব বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুদের
সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব। শারদোৎসব -এর সঙ্গে '
মহিমাসুর মর্দিনী ' - র অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। বাঙালি
শারদোৎসবের বার্তা তথা দেবী মহামায়া দুর্গার মধ্যে আমনের সংবাদ এই বেতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহালয়ার ভোরে জানতে পারে । ১৯২৭ সালে ২৬
আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয় । জন্মের পর থেকে আকাশবানী ,কলকাতা কেন্দ্রের কোন অনুষ্ঠান যদি বিশেষ স্মরণীয় বলে পরিচিতি লাভ করে থাকে , শ্রোতারা
নিঃসন্দেহে ' মহিষাসুর মর্দিনী' নামক
অনুষ্ঠানটির কথা উল্লেখ করবেন । বলা যায় –
অনুষ্ঠানটি বাঙালির জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ।
লাইভ ব্রডকাস্টের ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ শীর্ষক বেতার অনুষ্ঠানটি সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৯৩২ সালে। এর ভাষ্য , স্ক্রিপট ও গীত রচনায় ছিলেন বাণীকুমার , সঙ্গীত পরিচালনায় পঙ্কজ মল্লিক এবং চন্ডীপাঠে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মূলত এই ত্রয়ীর কালজয়ী সৃষ্টি, ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। ৰাণী কুমারের সুনির্মল ভাষ্য ও সুললিত গীত রচনা, পঙ্কজ মল্লিকের ভক্তি ও নিষ্ঠাপূর্ণ সঙ্গীত পরিচালনা এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সমধুর আবৃত্তি ভাষ্যপাঠ ও মহিমান্বিত চণ্ডীপাঠের এই অনুষ্ঠানটি ষড়ৈশ্বর্যে বিভূষিত হয়ে উঠছিল । অবশ্য , ‘মহিষাসুর মর্দিনী ' – র ষড়ৈস্বর্যশালিনী হওয়ার পেছনে কয়েকজন মুসলমান সঙ্গীত যন্ত্র শিল্পীসহ সমকালীন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রীদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য । প্রথম দু’বছর ( ১৯৫২ ১৯৩৩ সালে ) ‘মহিষাসুর মর্দিনী' প্রচারিত হয়েছিল ষষ্ঠীর ভোরে । সেটি ১৯৩৪ সাল থেকে মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হয়ে থাকে । এভাবে সতেরো আঠারো বছর চলার পর কিছু গোঁড়া ভক্ত শ্রোতার আপত্তির কারণে তিথি অনুসারে (অর্থাৎ ষষ্ঠীর ভোরে ) আবার মহিষাসুর মর্দিনী দু - তিন বছর প্রচারিত হয় । কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতার আপত্তির কারণে তা স্থায়ী হতে পারেনি । সেই থেকে মহিষাসুর মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে নিয়মিত প্রচারিত হয়ে আসছে । কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার বছরে (১৯৪৬ সালে) অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত না হয়ে রেকর্ড করে প্রচারিত হয়েছিল । তাছাড়া এটি প্রথম থেকেই লাইভ ব্রডকাস্ট হতো । ‘মহিষাযুর মর্দিনী’-র অন্যতম রূপকার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মৃত্যু ঘটে ১৯৯১ সালে । তার কয়েক বছর আগে থেকেই অনুষ্ঠানটি আকাশৰাণী , কলকাতা কেন্দ্র থেকে মহালয়ার ভোরে রেকর্ডের মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে ।
প্রয়াত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কালজয়ী বেতার অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ –র প্রথম অনুষ্ঠানটির (১৯৩২ ) স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে –
“ আজ মনে পড়ছে সেই প্রথম দিনটির কথা। কী করে সমস্ত অনুষ্ঠানটি একটি সুরে বাঁধা হয়ে গেল নিতান্ত আকস্মিক ভাবে, তার ইতিহাসও বড় বিচিত্র।
কথা ছিল যে আমি যখন সংস্কৃত শ্লোক সুরে আবৃত্তি করব, সেই সময়ে যন্ত্রীরা আমাকে সুর দিয়ে সাহায্য করবেন শুধু। তারপর আমি যখন বাংলা গদ্য পাঠ করে যাব, সে সময় তাঁরা পিছনে কোনও রাগ আলাপ করবেন ধীরে ধীরে আবহ সং গীত হিসাবে। রাইচাঁদ বড়াল মহাশয় । (বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সহকর্মী ) মুসলমান বাজিয়েদের সেইটি বেশ ভাল করে বুঝিয়ে দিলেন , তাঁরা সব ব্যাপারটা রীতি মতো অনুধাবন করেছেন বলে জানালেন ।
যথারীতি প্রোগ্রাম শুরু হল । আমি শ্লোকাবৃত্তি করে একটু থেমে বাংলা গদ্য আবৃত্তি আবৃত্তি আরম্ভ করলুম , আজ শুরু শারদ উৎসব , জলে স্থলে প্ররকৃতিতে আনন্দের বার্তা’। ইত্যাদি।
ওদিকে সংস্কৃত শ্লোক ও বাংলার
পার্থক্য বুঝতে না পেরে উর্দুভাষী মুসলমান বাদকবৃন্দ ঠিক আমার অনুরূপ কথার সুরে
বাজনা বাজিয়ে চললেন। আমি দেখলুম এতো মন্দ শোনাচ্ছে না – তখন সামান্য সুর রাখলুম
গদ্যে, সেটি আরও চমৎকার ভাবে মিলে গেল তাঁদের সুরের সঙ্গে – রাইচাঁদ, নৃপেন মজুমদার মহাশয় ( তৎকালীন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ) ও পঙ্কজ সবাই সবিস্ময়ে আমার ও যন্ত্রীদের দিকে চেয়ে রইলেন
যে এরা করে কী - কিন্তু ব্যপারটা ভাল লাগছিল সবারই - কিছুক্ষণ পরে বাঙালি যন্ত্রীরাও সুর ভিড়িয়ে দিলেন
। তারপরে সে সুরে ভিড়ে গেল গান - আবার আবৃত্তি। সমস্ত জিনিসটা একটা অখণ্ড সুরের প্রবাহে বইতে লাগলো
। দু - ঘন্টা ধরে পোগ্রাম মাতিয়ে তুলল তুলল
সকলকে । তারপর বেতার অফিসে কী অজস্র অভিনন্দন যে আসতে শুরু করল তা ভাষায়
বর্ণনা করা যায় না ।
নৃপেন মজুমদার মহাশয় খুশিতে ভরপুর হয়ে বলে উঠলেন , এ কারোর কৃতিত্ব নয়- সবই মায়ের খেলা ভাই - মা দুর্গা স্বয়ং যেন পিছন থেকে এসে আমাদের অনুষ্ঠানটিকে সুরে বেঁধে দিয়ে গেলেন । হিন্দু মুসলমান শিল্পীর মিলিত প্রচেষ্টায় ' মহিষাসুর মর্দিনী ' অনুষ্ঠানটি বৈচিত্র্যে ও জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থান অধিকার করল । "
‘মহিষাসুর মর্দিনী 'শীর্ষক বেতার অনুষ্ঠানটি প্রচারের কয়েক বছরের মধ্যেই সাধারণ লোকজন তাকে ' মহালয়া প্রোগ্রাম ' বলে আখ্যায়িত করতে লাগল । অনুষ্ঠনের কুশীলবদের সকলের নাম না জানলেও প্রয়াত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র - র নামটি সর্ব-সাধারণের মুখে মুখে পরিচিত হয়ে উঠল । কালক্রমে মহিষাসুর মর্দিনী ' বাঙালির শারদোৎসবের এক অভ্যাবশ্যক উপকরণে পরিণত হল । শুধু মহালয়ার প্রতে নয় , শারদোৎসবের দিনগুলোতেও মহিষাসুর মর্দিনী-র রেকর্ড শোনা, মন্দিরে মন্দিরে তা বাজানো যেন সহজাত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল । বলাই বাহুল্য – উক্ত ধারা সমান তালে এখনও বহমান ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।