Advt

Advt

Mahakasher Mahishasur Badh, Feature, Jana Ajana, by Dr. Tushar Ray, Tatkhanik digital bengali online, bangla web, e magazine, মহাকাশের মহিষাসুর বধ

 ধারাবাহিক                            

প্রতি রবিবার পড়ুন । 





Mahakasher Mahishasur Badh, Feature, Jana Ajana, by Dr. Tushar Ray, Tatkhanik digital bengali online, bangla web, e magazine, মহাকাশের মহিষাসুর বধ

 

মনে পড়ে প্রায় একবছর আগে ৩রা অক্টোবর‘জানা-অজানা’য় পড়েছিলাম বেওয়ারিশ মহাকাশ-খণ্ড “বেন্নু’র কথা। এই ভয়ানক ‘বে-ওয়ারিশ মহাকাশচারীদের মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যাস্টেরয়েড’ বা গ্রহাণুপুঞ্জ অথবা ‘তারামাছ’। বড় ভয়ানক এরা ; এদের গঠন,অবশ্য হয়েছিল আমাদের আর অন্য গ্রহ,উপগ্রহ,তারামণ্ডলির সঙ্গেই।কিন্তু,মহাকাশে এদের অবস্থান এবং ‘চলাফেরা’ অন্যান্য গ্রহ,উপগ্রহ,তারাদেরদের পক্ষে মারাত্মক। এদের বাসস্থান হল বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহের মাঝের বিশাল ‘ময়দানে’। যেহেতু সৌর মণ্ডলের অংশ তাই এরাও সূর্য প্রদক্ষিণ করে আমাদের পৃথিবীরই মত। এদেরই একজন হল “বেন্নু। এ যেন মহাকাশের এক অতিকায় দৈত্য।

গ্রহাণুপুঞ্জ বা অ্যাস্টিরয়েডটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ২২ বছর আগে ১১ই সেপ্টেম্বর,১৯৯৯ সালে। “বেন্নু” হ’ল মিশরের পৌরাণিক কাহিনীর কাল্পনিক দেবতা যিনি সূর্য,পৃথিবী আর জন্মান্তরের অধীশ্বর- এই দেবতা একটি পাখির আকার-অনেকটা বড় সারস পাখির মত গড়ন-এরই নামানুসারে (‘বেন্নু’) এই গ্রহাণুপুঞ্জটির নামকরণ করা হয়েছিল। এই বিশাল  মহাকাশ-পিণ্ডটি আজ থেকে ১৩ বছর পরে ২০৩৫ এ প্রথম পৃথিবীর গায়ে ধাক্কা মারার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে বৈজ্ঞানিকরা হিসাব করে বলছেন।এর পরেও আগামী শতাব্দীতে এই ‘দানব’ ক’য়েক বার ধেয়ে আসবে পৃথিবীর দিকে, বিশেষ করে ২৪ সেপ্টেম্বর,২১৮২ তারিখে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা আছে বলে বৈজ্ঞানিকরা অনুমান করছেন। এই কারণে দেশে দেশে গবেষণা চলছে কিভাবে এই প্রবল সম্ভাবিত দুর্যোগ এড়ানো যায়। এই দুর্যোগ ভীষণ হতে পারে তার কারণ এই গ্রহাণুপুঞ্জটি খুব বিশাল না হলেও ব্যস ১৬৫০ ফুট আর ওজন ৭৮০ লক্ষ টন। এটি প্রচণ্ড গতিতে একটি লাট্টুর মত আপন অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে ৪৩৬ দিনে সূর্য প্রদক্ষিণ করে। প্রাপ্ত ছবি থেকেও এটিকে একটি প্রায় শুয়ে-পড়া একটি অতিকায় লাট্টুর মত দেখা যায়। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী ২০৩৫ এ বেন্নু পৃথিবীর ১ লক্ষ ২৩ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়বে। শুনতে ১লক্ষ কিলোমিটার হলেও এ দূরত্ব কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানের হিসাবে খুবই কম। চাঁদ আমাদের থেকে কত দূরে? তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার।তার মানে বেন্নু ওই সময়ে চাঁদের চেয়েও এক তৃতীয়াংশ কাছে চলে আসবে। আর এত বড় একটা বস্তু এত কাছে এলে,ধাক্কা না লাগলেও,তার একটা কুফল তো আমাদের গ্রহের উপর পড়বেই। বর্তমান জ্ঞান আর হিসাব অনুযায়ী বেন্নু আগামী শতাব্দীতে ২১৭৮ আর ২২৯০ এর মধ্যেও পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা। শুধু আমেরিকা,ইয়োরোপ আর রাশিয়াই নয় চীন দেশও ‘বেন্নু’কে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। চীনের বিজ্ঞান সংস্থাও ‘বেন্নু’র ধাক্কা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত-বেন্নুর সঙ্গে সংঘর্ষে আমাদের গ্রহের সাংঘাতিক ক্ষতির সম্ভাবনা নিয়ে চীনও বিশেষ চিন্তিত। কত কি হতে পারে? আমাদের গ্রহের সূর্য পরিক্রমার (৩৬৫ দিন) সময় বদলে যেতে পারে,পৃথিবীর সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলানো অবস্থার পরিবর্তন হয়ে আমাদের দিন-রাতের সময় বা ঋতুর পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে।

এখন, বেন্নু বা তার চেয়েও বড় অ্যাস্টিরয়েডের যদি পৃথিবীর সংগে ধাক্কা লাগে তাহলে কি হবে সেটা একটু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখা যাক:

এক: কয়েক লক্ষ কোটি মানুষ আর অন্য জীব কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আর পরেও কয়েক কোটি প্রাণ হারাবেন বিভিন্ন ভাবে আহত অবস্থায়।

দুই: সংঘর্ষের ফলে প্রভূত পরিমাণে ধুলো-ময়লায় আমাদের বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়ে যাবে আর দূষণ থাকবে বহু দিন-মাস যাবত; সূর্যের মুখ দেখা যাবেনা বছরের পর বছর।

তিন: স্থলভূমিতে আঘাত না করে যদি সমুদ্রে আঘাত করে তাহলে? আমাদের বায়ুমণ্ডলে জলিয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাবে অত্যধিক।তার ফলস্বরূপ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যাবে বেড়ে আর তার ফলে হবে ভূস্খলন বা ‘ল্যান্ড-স্লাইড’।

আমাদের জীবন-কালে ঘটেনি বলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না এরকম ভাবার কোন কারণ নেই। বিগত দুই শতাব্দীতেই মোট ১৮ বার পৃথিবীর সঙ্গে অ্যাস্টিরয়েড এর সংঘাত হয়েছে। এমন একটি সংঘাতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল মেক্সিকোর দক্ষিণ অঞ্চলে বিশাল বড় (২৫,৪৫০ বর্গ কিলোমিটার) চিকজুলুব (Chicxulub) ক্র্যাটার। অ্যাস্টিরয়েডটি ছিল প্রায় ১৫ কিলোমিটার লম্বা-চওড়া। বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুসারে এমন একটি সংঘাত প্রায় ৩০ কোটি  বোমা বিস্ফোরণ-জনিত ক্ষতির সমান সমান।

তাই দেশে দেশে গবেষণা চলছে কিভাবে বেন্নু এবং ওর ‘দল-বল’এর আঘাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়।

এ নিয়ে দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে কি ভাবে আমাদের পৃথিবীকে অ্যাস্টিরয়েড এর ‘আক্রমণ’ থেকে বাঁচান যায়। এই কারণেই ‘নাসা’ একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বুঝতে সঠিক কিভাবে একটি মহাকাশ-যান ছেড়ে কোন ভাসমান বস্তুকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া যায়। ভাগ্যক্রমে অপেক্ষাকৃত ছোট একজোড়া অ্যাস্টিরয়েড,“ডিমর-ফস আর ডিডিমস” এই পরীক্ষার জন্য কাজে এসে গেছে। সেই লক্ষ্যেই গতবছরের ২৪শে নভেম্বর,২০২১ তারিখে,“স্পেস-এক্স’ এর প্রবল শক্তিশালী ফ্যালকন-৯ নামক একটি রকেটে ভর করে ‘ডার্ট’ এর মহাকাশ-যান নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। নাসা ‘টুইট’ করে ডি-মরফসকে সাবধানও করেছে,“অ্যাস্টিরয়েড ডি-মরফস,আমরা আসছি-তোকে দেখে নেব”। হিসাব করে দেখা গেছে ধাক্কা মারার সময়ে অ্যাস্টিরয়েড ডি-মরফস পৃথিবীর খুব কাছে মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে থাকবে।           

আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞান সংস্থা,‘নাসা’র এই প্রকল্পটির নাম হচ্ছে ‘ডার্ট’ বা DART (Double Asteroid Reduction Test)এই প্রকল্পের কাজই হ’ল পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা অ্যাস্টিরয়েডগুলিকে বিনষ্ট করা অথবা ওদের গতিপথ বদলে দেওয়া।যেহেতু আমরা মোটর গাড়ির মত আমাদের গ্রহের গতিপথ বদলাতে পারি না,ওই বেওয়ারিশ মহাকাশ বস্তুগুলির গতিপথ সামান্য মাত্রায়ও পরিবর্তন করতে পারলে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো যেতে পারা যাবে।

এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে ‘নাসা’ বেছে নিয়েছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ কিলোমিটার দূরের একটি ‘জোড়া-গ্রহাণুপুঞ্জ’,’'ডি-মরফস' আর ‘ডিডি-মরফস’। এই যুগ্ম অ্যাস্টিরয়েড একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে যুগ্ম-ভাবে সূর্য প্রদক্ষিণ করে। আকারে এরা খুব একটা বড় নয়। একটি ফুটবল মাঠের আয়তনের ‘ডি-মরফস’ (ব্যাস ৫২৪ফুট) আর একটি কিছু বড় ২৫০০ ফুট ব্যাসের অ্যাস্টিরয়েড,“ডিডি-মরফস”কে প্রতি ১১ঘণ্টা ৫৫ মিনিটে প্রদক্ষিণ করতে করতে পৃথিবীর কক্ষপথের দিকে এগিয়ে আসছে। তাই ‘ফাইনাল’ অর্থাৎ বিশাল বড় অ্যাস্টিরয়েড ‘বেন্নু’র সাথে বোঝাপড়ার আগে ‘হিট’ বা ‘ট্রায়াল’ হিসাবে ডি-মরফস এর সংগে বোঝাপড়ার কাজই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। সাড়ে ৩৪ কোটি ডলার খরচের এই পরীক্ষামূলক প্রকল্পের নাম “ডার্ট’(DART)এই প্রকল্প অনুসারে একটি ছোট মোটর গাড়ির সমান মহাকাশ-যান প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মারবে ডি-মরিসকে যার ফলে গ্রহাণুপুঞ্জটির সূর্য প্রদক্ষিণের পথ বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।

এই পরীক্ষায় বিরাট সাফল্য লাভ করেছে বলে ‘নাসা’ জানিয়েছে: গত ২৬ সেপ্টেম্বর,২০২২ এ সন্ধ্যা ৭টা ১৪ মিনিটে (আমেরিকার পূর্ব-উপকুলের সময়) ‘ডার্ট’ মহাকাশযান গত দশ মাস মহাকাশে দৌড়ে ঘণ্টায় ২৪,০০০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে ‘ডি-মরফস’কে। বিস্তারিত ফলাফল এখনও জানা যায়নি কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের বিশ্বাস ডার্ট প্রকল্প সাফল্য লাভ করেছে এবং অ্যাস্টিরয়েড-যুগল তাদের পথ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। আগামী বছর ইয়োরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি বা “ই এস এ” এই সংঘাতের বিস্তারিত ফলাফল যাচাই করবে এবং পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মহলকে পরিপূর্ণ ‘রিপোর্ট’ দেবে।

এই সাফল্য কেবল নাসার নয়,সারা পৃথিবীর মানুষের জয় ঘোষণা করছে।

শুভ দুর্গা পূজার প্রাক্কালে (মহা সপ্তমীর শুভ দিনে) এ যেন অ্যাস্টিরয়েড রূপী মহিষাসুরকে বধ করে আমাদের পৃথিবীকে আর একবার বিপদ-মুক্ত করল মা দুর্গা রূপী মানুষের জ্ঞান ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান।

 লেখক পরিচিতি –

ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।