শরতের সুনীল গগনে সাদা মেঘের সমারোহে আর শিউলী ফুলের সুরভিতে প্রকৃতি আমোদিত। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপের মধ্যেই দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন । ভক্ত উপলব্ধি করছেন, মর্ত্যলোকে বসে স্বর্গীয় ভুমানন্দকে উপভোগের ।
বিশ্বব্রহ্মাও এক মহাশক্তির লীলাক্ষেত্র ; আর নিরন্তর চলছে সে শক্তির বৈচিত্র্যময় কার্যকারিতা। ব্রহ্মাণ্ডের সেই অনন্ত শক্তিকে একাধারে সন্নিবেশিত দেখবার বাসনায়, সেই অসীম নিরাকার ব্রহ্মশক্তিকে নাম রূপের মধ্যে প্রত্যক্ষ করতে আর্য ঋষিদের ধ্যানলব্ধ দেবী দুর্গার এ মৃন্ময়ী মূর্তি। বিশ্বচরাচরের নিয়ন্ত্রী শক্তি সৃজন , পালন ও সংহারশক্তি একাধারে ঘনীভূত হয়ে দেবী দুর্গার মধ্যে রূপলাভ করেছে । অসীম , অরূপ এখানে সীমার মাঝে , রূপের মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠেছে । এই প্রতীক বা সাকারের সোপান বেয়েই সাধক মৃন্ময়ীর মাঝে চিন্ময়ীকে উপলব্ধি করে থাকেন । অর্থাৎ অজ্ঞানতার শেষ অবগুণ্ঠন ছিন্ন করে পরম সত্তার একাত্মতার উপলব্ধিই হোল তার একমাত্র ধর্মসাধনা । এই বিশ্বজগতের অসংখ্য খণ্ডিত সত্তার মধ্যে অখণ্ড পরম সত্তার অস্তিত্ব ও অভেদত্ত্বের অনুভূতিই তার জীবনের আদর্শ ও সর্বোত্তম ধর্ম । আর এই ধর্ম সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন :
মানুষের মাঝে সে দেবত্ব রয়েছে তার বিকাশ সাধনই হোল ধর্ম ।
অর্থাৎ ধর্ম হোল সেই নীতি যা পশুকে মানুষের স্তরে এবং
মানুষকে
দেবতার স্তরে উন্নীত করে ।
স্বামীজীর মতে , প্রত্যেক মানুষই মূলত এক দিব্যসত্তার আধার এবং প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এই দিব্য সত্তার উদ্বোধন ও বিকাশ সাধনই হোল সর্বোত্তম ধর্ম ।
ধর্ম চিন্তা মানব সমাজে প্রায় সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে । এ চিন্তাধারা বৈচিত্র্যময় জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রয়োজন প্রথম অনুভূত হয় । এ অনুশাসন বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা - প্রসূত। মানুষ সাধারণভাবে জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে এবং জাগতিক বিপদের মধ্যে নিরাপত্তা লাভের আশায় ধর্মের আশ্রয় নেয় । সে অনেক পার্থিব সুখ - সম্পদ সৃষ্টির স্বপ্ন দেখে , দেহ মুখে লিপ্ত হয় । তবুও তাঁর সাধ মিটছেনা । সে অনুভব করছে কেবল সুখ- সামগ্রী অন্বেষণ তাকে অস্থির করে তুলছে । ভাবছে , শুধু জৈবিক স্তরে থেকে জীবনে পরিতৃপ্তি আসবেনা । তাই ধর্মের দিকে আর একটি ঝুঁকল । জীবনে পরিতৃপ্তি প্রয়োজন । যদিও মানুষ শুরুতে সুখ - সম্পদ সংগ্রহ করতে যেয়ে স্রষ্টার চিন্তা কিছু করেছিল । অবশ্য তা ছিল খুবই স্থুল দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ । এটা ছিল পার্থিব সুযোগের মধ্যে একটু যেন অপার্থিব চিন্তার ইঙ্গিত । এই অপার্থিব চিন্তাকে সে রূপ দিতে চাইলে নানা রকম সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে । পার্থিব ভোগ - সুখ এবং ধর্মানুষ্ঠান মিশে গিয়ে সামাজিক জীবনে একটা ধর্মীয় ভাব সঞ্চারিত হলো । ধর্ম প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হতে এর মূল্য কম নয়। এরপর ক্রমশ পরিমার্জিত হতে লাগল ধর্মচিন্তা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান । অনুভব করেছে পার্থিব সুখ ও সম্পদ সৃষ্টি একমাত্র জীবনের লক্ষ্য নয় ; এর বাইরে কিছু একটা আছে, যা তাকে জীবনে পরিপূর্ণতা দেবে । আর এটাই হচ্ছে মানুষের অধ্যাত্ম চেতনা । বৈদিকযুগ থেকে আরম্ভ করে আধুনিক কালের ধর্মচিন্তায় বিবর্তন লক্ষণীয় । এই বিবর্তনের মধ্যে মানুষ ক্রমশ অনুভব করল পার্থিব জীবন প্রবাহের মধ্যে অপার্থিব জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধি গভীরভাবে । ধর্ম- অর্থ - কাম - মোক্ষ এই চতুবর্গ সম্পদের কথা উপলব্ধি মরমে মরমে । মুখ্য সম্পদটি তার মোক্ষ , মুক্তি । এই মুক্তির আশাই তাকে ধর্মে প্রবৃত্ত করল অধিকতর এবং সে স্রষ্টাকে বুঝতে চাইল । স্রষ্টা চিহ্নিত হলেন ব্রহ্ম , ঈশ্বর , ভগবান আরও অনেক নামে । ধর্মচিন্তায় এ নামগুলি বিশেষ স্থান লাভ করল।
ধর্মীয় বিচিত্র চিন্তা ধারায় এ ব্রহ্ম , ঈশ্বর বা ভগবান কখনও সাকার ও গুণান্বিত এবং কখনও বা নিরাকার ও গুণহীন। প্রশ্ন সাধারণভাবে
জাগে গুণহীন কি করে গুণ-সম্পন্ন হবেন? আবার গুণসম্পন্নই যদি
হন, তাহলে নির্গোত্মকভাবের কি প্রয়োজন ? সাধকের মনে ভাই সংশয় । এই সংশয়ের উপশম হওয়া বাঞ্ছনীয় । নিঃসংশয় চিত্ত
হতে হলে কিছু ধর্মীয় ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে হবে । বহু সাধকের
সাধনার বিচিত্র ধারা এ ইতিহাসে সমন্বিত হয়েছে । এই বৈচিত্র্য ধারা বুঝতে মুক্তি ও অনুভূতির প্রয়োজন
। যুক্তি এ সত্য আবিষ্কারে প্রাথমিক সোপান হতে পারে ,
কিন্তু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত । তিনি যদি নিরাকার হন , তাহলে বিচার এবং যুক্তির মধ্য দিয়ে তাঁকে বুঝতে হবে । শাস্ত্র এঁকে ,
"নেতি, নেতি " , বলেছেন , অর্থাৎ এ নন ,এ নন। এভাবে তাঁকে জানা শক্ত । আর সাকার হলে তাঁকে
বুঝতে অনেকখানি সহজ হবে , কারণ তিনি ইন্দ্রিয় গোচর ।
শাস্ত্র আবার বলেছেন , তিনি উভয়ই । সাধকের সাধনার বৈচিত্র্যে তিনি কিভাবে প্রতিভাত হন তাই লক্ষনীয়।
সাধকের সাধনার বৈচিত্র্যে সেই একই পরম বস্তুর সাধনায় লিপ্ত রয়েছেন । ব্রহ্ম থেকে শুরু করে মায়া উপহিত ব্রহ্মে অর্থাৎ মায়াশ্রিত ঈশ্বরাআরাধনাই এঁদের প্রতিপাদ্য । শ্রীরামকৃষ্ণ এই পরম তত্ত্বটিকে
সহজ করে বলেছেন ঃ ‘তোমরা যাঁকে ব্রহ্ম বল, আমি তাঁকে ব্রহ্মময়ী বলি’। অর্থাৎ ব্রহ্মশক্তি । এই ব্রহ্মশক্তি হচ্ছেন হৈমবতী উমা।
শক্তি সাধনায় এই দেবী উমাই প্রাধান্য লাভ করেছেন । কালে ইনিই
বিভিন্ন দেবীর আসন লাভ করেন । ইনিই আদ্যাশক্তি । সাধকের সাধনায় ইনি দেবী
দুর্গারূপে আবির্ভূতা হয়েছেন । মেধস মুনি রাজা সুরথ, শ্রীরামচন্দ্র
প্রমুখ এঁরই আরাধনায় সিভিলাষ করেছিলেন । শরৎকালে দেবীপূজা এঁরই উপাসনা । ভক্ত
সাধকগণ এই সর্বশক্তিময়ী মহাদেবীর আরাধনায় ব্রতী । এই মহাশক্তি এক এবং অদ্বিতীয়া । ব্রহ্মময়ী , মহেশ্বর - মহেশ্বরী , ঈশ্বর - ঈশ্বরী এসবই সেই
ব্রহ্মা - মায়া অর্থাৎ ব্রহ্ম অভিব্যক্তি শক্তিরই একটা একত্বের সুর ঘোষিত হচ্ছে সর্বদা । বস্তুত এসব বহুভাবে একই পরম সত্তা ব্রহ্মেরই উপাসনা , বহু ঈশ্বরের উপাসনা নয় ।
দুর্গাপূজা মহাশক্তির সাধনা । জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার জন্যে
শক্তি লাভই এ সাধনার মূল উদ্দেশ্য । পুরাকালে দেবতারাও দেবী দুর্গার কৃপায়
স্বর্গরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন । আর এই দেবী দুর্গা বিভিন্ন শক্তি মহাশক্তিতে
রূপান্তরিত হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন । প্রয়োজন ছিল দেবগণের মহাশক্তি আরাধনার, প্রয়োজন ছিল রাজা সুরথের মহামায়ার আরাধনার,
প্রয়োজন ছিল রামচন্দ্রের ভগবতী দুর্গার প্রসন্নতা অর্জনের । কিন্তু সে প্রয়োজন
আজও শেষ হয়নি। আজও অসুর আছে পৃথিবীতে । সমাজবিরোধী অশুভ
শক্তিসমূহের প্রবল প্রতাপে বিপর্যস্ত আজ আমাদের সমাজ জীবন
। দুর্নীতি ও অনাচার ছড়িয়ে গেছে সমাজদেহের রক্তে রক্তে।
সমস্যা সঙ্কুল হয়েছে জন – জীবন। দুঃখ দুর্গতি আমাদের সীমাহীন । এ মহাসঙ্কটে
আজ আবার প্রয়োজন মহাশক্তির আবির্ভাব । শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবী এ প্রসঙ্গে নিজেই
বলেছেন ....
ইথুং যদা যদা বাধা দানবোথা ভবিষ্যতি।
তদা তদাৰতীর্য্যাহং
করিষাম্যরিসংক্ষয়ম্।।
( ১১/৫১ )
অর্থাৎ , যখন যখন দানবকৃত ব্যাঘাত উপস্থিত হবে , তত্তং কালেই আমি অবতীর্ণা হয়ে শত্রুকুলের বিনাশ সাধন করব ।
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। (৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।