Advt

Advt

Bara Debi, Aaj o Nararakte hoye asoche sandhi pujo, Feature, by Nandita Saha, Tatkhanik digital bengali online, bangla web, e magazine, বড় দেবী

 

Bara Debi, Aaj o Nararakte hoye asoche sandhi pujo, Feature, by Nandita Saha, Tatkhanik digital bengali online, bangla web, e magazine, বড় দেবী



আজ আমি যে পূজোর গল্প শোনাবো,সেটি বহু বছরের পুরনো এই দুর্গা পূজোর স্থান এবং আমার জন্মস্থান মিলে মিশে একাকার বহু অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প আছে এই পুজো ঘিরে, কিছু অবিশ্বাস্যও বটে অনেক গল্পই ইতিহাসের তলায় চাপা পড়ে গেছে তবু তার মধ্য থেকেই যতটা টেনে আনা যায়,তারই প্রচেষ্টা যদিও আমি আজ কলম ধরেছি তবে পুজোর সূত্রপাত প্রায় পাঁচশো বছর আগে, বলা বাহুল্য সে সময় আমরা কেউই ছিলাম না দুর্গা মা এখানে "বড় দেবী" বলে পরিচিত এই পূজো আর পাঁচটি পূজো থেকে একেবারেই আলাদা

এমন কোথাও কি কেউ শুনেছে দেবীমুর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে কেটে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়! এই ধরনের না না গল্প শুনলে কখনো কখনো গায়ে কাঁটা দেয় বৈকি, কখনো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়

১৬০০ খ্রিস্টাব্দ কুচবিহার তখন শাসন করছে কোচ রাজ বংশের রাজা বিশ্বসিংহ পরাক্রমশালী দয়ালু প্রজাবৎসল রাজা বিশ্বসিংহ একদিন স্বপ্নে মায়ের আদেশ পেলেন মা তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে তাঁর পূজো প্রচলন করতে বলেন আর কি ! ধর্মপ্রাণ রাজা তলব করলেন রাজপুরোহিতকে  অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল মায়ের পুজো তবে দিন ক্ষণ দেখে শুরু করা যাক সে- শুরু 

জানা যায় বিশু এবং শিশু নামের দুই ভাই বড় দেবীর আরাধনা করতেন এই বিশুই  পরবর্তীকালে কুচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহ তিনিই " বড় দেবীর" পুজো শুরু করেন ( মতান্তরে তাঁর সুযোগ্য পুত্র ,মহারাজা নরনারায়ণ ) রাজবাড়ীর , রাজবংশের কুলদেবী এই "বড় দেবী"   রাজার ইচ্ছে অনুসারে কুচবিহার রাজ প্রাসাদের  খুব কাছেই একফালি জমির উপর তৈরি হলো বিশাল এক মন্দির,  তৈরি হল মায়ের ঘর মায়ের বাসস্থান মা ছাড়া আর কারো সেখানে প্রবেশাধিকার নেই  

আগেই বলেছি এই "বড় দেবী" মাকে নিয়ে অনেক গল্প গাথা আছে আর পাঁচটি মন্দিরের মতো কিন্তু নয় এই মন্দিরটি   মন্দির প্রাঙ্গণে নেই কোন বাগান , নেই কোনো পাকশালা কিংবা নেই কোন অতিথি শালা সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের মধ্যখানে মাথা উচু করে প্রায় পাঁচশো বছর দাঁড়িয়ে আছে মন্দির একটি মাত্র এই ঘরটির  পূব এবং পশ্চিম , অর্থাৎ সামনে এবং পেছনে দেওয়াল সংলগ্ন দুটি পেল্লাই দরজা   একা দরজা খোলা অসম্ভব  

মায়ের আরো একটি আদেশ ছিল, হয়তো বা পৃথিবীতে পাপে, ব্যাভিচারে  রুষ্ট  মমতাময়ী জননী সেইসময় ক্রোধের আগুনে জ্বলছিলেন  মায়ের ইচ্ছে নরবলি চাই   শুরু হল নরবলি সত্যিই কেমন সিউড়ি ওঠে শরীর , ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় বেশ 'বছর সন্ধিপুজোর ক্ষণে নরবলি হতো মন্দিরের ভেতরে সেই নরবলির সময় উপস্থিত থাকতো রাজ পরিবারের সদস্যরা আর পুরোহিতেরা  বাইরের জনসাধারণের সেই বলি দেখার কোন অধিকার বা সুযোগ ছিল না  

বেশ 'বছর নরবলি হবার পর আরেক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো সেবার কোন ছোট শিশুকে ধরে আনা হয়েছিল মহা অষ্টমীর দিন নরবলির জন্য   সেই ছোট্ট বালক সারারাত মন্দিরেই আটকে ছিল এবং ভীত বালক সারারাত মায়ের পায়ে মাথা রেখে কেঁদেছে তার কান্নায় মায়ের হৃদয়ে বুঝিবা দয়া দেখা দিয়েছিল আবার স্বপ্নাদেশ হয় নরবলি বন্ধ হোক, কেবল এক ফোটা নর রক্ত হলেই চলবে  ঈশ্বরের কৃপায় বন্ধ হলো নরবলি সেও বহু বছর আগে মতান্তরে, প্রায় আড়াইশ বছর আগে রাজা নর নারায়ণ আইন করে এই প্রথা বন্ধ করেন  

তবে আজও বিশেষ এক নির্দিষ্ট বংশের পুরুষই  এক ফোটা রক্ত মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে নরবলির প্রথা চালু রেখেছেন অষ্টমীর দিন আজও ( হয়তো অনেকেরই মনে সন্দেহ থাকবে , তবে সত্যি ) এই নির্দিষ্ট বংশ থেকে একজন সকালে মন্দিরে এসে স্নান , পূজো সেরে তার তর্জনী কেটে রক্ত দিয়ে যান সেই রক্তে আজও সন্ধিপুজো হয়ে আসছে বর্তমানে সেখানে প্রতিবছর মহিষ বলি হয় , হয় পাঠাবলি , কবুতর এবং ফল-ফলাদি দূর-দূরান্ত থেকে লোক আজও আসে  মহিষ বলি দেখার লোভে   আর সেই বলি দেখার ভয়ে আমার কোনদিন মহাষ্টমীতে "বড় দেবী"- পুজো প্রাঙ্গণে যাওয়া হল না   মায়ের নির্দেশই হোক বা রাজার খামখেয়ালীপনায়ই হোক , আদিম এই প্রথা আমি আমি মেনে নিতে পারি নি  

আশা রাখি আবার মায়েরা আদেশেই হোক বা রাজাদেশেই হোক নরবলির মত, মহিষ কিম্বা পাঁঠা বলির এই আদিম , পৈশাচিক খেলা বন্ধ হবে খুব শিগগিরই

এই দেবী মূর্তি আর পাঁচটি দুর্গা মূর্তি থেকে একেবারেই আলাদা   মায়ের স্নেহ ভরা , সুধা ভরা , মমতা ভরা মুখ এই দুর্গা মুরতিতে উধাও লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ কেউই নেই  মায়ের মূর্তি একেবারে রক্তের মতো লাল রং , অসুরের গাত্র বর্ণ ঘন সবুজ ডানদিকে সিংহ এবং বাম দিকে বাঘ অসুরকে খুবলে খাচ্ছে , মায়ের দুই পাশে জয়া - বিজয়া , এবং তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল  


মন্দিরের সামনে লেখিকা

এখানে মায়ের এক হিংস্র পৈশাচিক ভীতিপ্রদ মুখমন্ডল দেখা যায় মায়ের বিকট এই মূর্তি দেখলে বুকের ভেতর কেমন ভয়ে দুরু দুরু করে   অসুর বধের ঠিক  সেই মুহূর্তে হয়তো মা এমনটাই চন্ডালমূর্তি ধারণ করেছিলেন  মন্দিরের নাম অনুযায়ী ওই এলাকার নাম হয়ে গেছে দেবী বাড়ি এলাকা

ষষ্ঠী পুজো  মহা আড়ম্বরে , নানা নিয়ম নীতি মধ্য শুরু হলেও মায়ের ভোগে থাকে কেবল পায়েস কেবল নবমীর দিন চাল-ডাল-সবজি- বলির মাংস একসাথে করে বিশেষ আমিষ খিচুড়ি মায়ের প্রসাদে দেওয়া হয় 

মূর্তি গড়ার মধ্যেও আছে অভিনবত্ব  যেহেতু এত বড় মূর্তি ভেতরে ঢোকানো মুশকিল, তাই মন্দিরের ভেতরেই চাকা যুক্ত একটি পাটাতনের ওপর মূর্তি তৈরি হয় এবং মূর্তির কাঠামো তৈরি হয় ময়না গাছের কাঠ দিয়ে বলা হয়, ময়না গাছ পুঁতেই রাজা এই পূজোর সূচনা করেছিলেন সেই প্রথা আজও চলে আসছে পুজোর দিন  খোলা মাঠে মেলা  হয়, লোকে লোকারণ্য হয় মন্দির চত্বর 

কোচবিহার জেলায় এই " বড় দেবী " মা বিসর্জন হয় সর্বাগ্রে একেবারে কাকভোরে প্রায় অন্ধকারে গর্ভগৃহের পেছনের দরজা দিয়ে চাকা বিশিষ্ট কাঠের পাটাতন মূর্তি সমেত টেনে বার করা হয় মন্দিরের সাথেই লালদীঘি , প্রায় ছোটখাটো একটি নদী বললেও ভুল হবে না পবিত্র লালদীঘিতে মূর্তির নানা অংশ টুকরো টুকরো করে কেটে লাল দীঘির জলে বিসর্জন দেওয়া হয় এত ভোরে খুব কম মানুষই উপস্থিত থাকতে পারে , আমিও একবারই মোটেই উপস্থিত ছিলাম অদ্ভুত সেই দৃশ্য অবলোকন করেছি  

বিসর্জনের পর মন্দিরটি দাঁড়িয়ে থাকে একা নিরালায় মাঠের ওপর আবার কোচবিহারবাসীরর প্রতীক্ষা শুরু হয় এক বছর , একটি বছরের পর আবার "বড়দেবী" আসবেন , দেবী বাড়ি চত্বর ভরে উঠবে ধূপের গন্ধে , ভরে উঠবে ঢাক কাঁসরঘন্টা এবং উলুধ্বনিতে , চণ্ডীপাঠে ভরে উঠবে আকাশ বাতাস, শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মানুষ হবে আপ্লুত  

প্রার্থনা,প্রতিটি কুচবিহারবাসীর মাথায় থাকুক " বড় দেবী "-  আশীর্বাদ

লেখিকার পরিচিতি -

জন্ম পশ্চিমবঙ্গ-র কুচবিহার শহরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতার বই ' সুখের ঠিকানা', গল্প সংকলন 'চিরন্তন'। ইংরেজি কবিতার বই 'Bouuet of Poems' বিভিন্ন পত্রিকায় লেখেন। বেশকিছু কিশোর সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। 

স্টেটস্‌ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন ।  বহু e magazine এ লেখেন ।