আজ আমি যে পূজোর গল্প শোনাবো,সেটি বহু বছরের পুরনো । এই দুর্গা পূজোর স্থান এবং আমার জন্মস্থান মিলে মিশে একাকার । বহু অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প আছে এই পুজো ঘিরে, কিছু অবিশ্বাস্যও বটে । অনেক গল্পই ইতিহাসের তলায় চাপা পড়ে গেছে । তবু তার মধ্য থেকেই যতটা টেনে আনা যায়,তারই প্রচেষ্টা । যদিও আমি আজ কলম ধরেছি তবে পুজোর সূত্রপাত প্রায় পাঁচশো বছর আগে, বলা বাহুল্য সে সময় আমরা কেউই ছিলাম না । দুর্গা মা এখানে "বড় দেবী" বলে পরিচিত । এই পূজো আর পাঁচটি পূজো থেকে একেবারেই আলাদা ।
এমন কোথাও কি কেউ শুনেছে দেবীমুর্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে কেটে জলে বিসর্জন দেওয়া হয়! এই ধরনের না না গল্প শুনলে কখনো কখনো গায়ে কাঁটা দেয় বৈকি, কখনো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় ।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দ । কুচবিহার তখন শাসন করছে কোচ রাজ বংশের রাজা বিশ্বসিংহ । পরাক্রমশালী দয়ালু প্রজাবৎসল রাজা বিশ্বসিংহ একদিন স্বপ্নে মায়ের আদেশ পেলেন । মা তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে তাঁর পূজো প্রচলন করতে বলেন। আর কি ! ধর্মপ্রাণ রাজা তলব করলেন রাজপুরোহিতকে। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল মায়ের পুজো তবে দিন ক্ষণ দেখে শুরু করা যাক । সে- ই শুরু।
জানা যায় বিশু এবং শিশু নামের দুই ভাই বড় দেবীর আরাধনা করতেন । এই বিশুই পরবর্তীকালে কুচবিহারের রাজা বিশ্ব সিংহ । তিনিই " বড় দেবীর" পুজো শুরু করেন ( মতান্তরে তাঁর সুযোগ্য পুত্র ,মহারাজা নরনারায়ণ )। রাজবাড়ীর , রাজবংশের কুলদেবী এই "বড় দেবী"। রাজার ইচ্ছে অনুসারে কুচবিহার রাজ প্রাসাদের খুব কাছেই একফালি জমির উপর তৈরি হলো বিশাল এক মন্দির, তৈরি হল মায়ের ঘর মায়ের বাসস্থান । মা ছাড়া আর কারো সেখানে প্রবেশাধিকার নেই ।
আগেই বলেছি এই "বড় দেবী" মাকে নিয়ে অনেক গল্প গাথা আছে । আর পাঁচটি মন্দিরের মতো কিন্তু নয় এই মন্দিরটি । মন্দির প্রাঙ্গণে নেই কোন বাগান , নেই কোনো পাকশালা কিংবা নেই কোন অতিথি শালা । সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের মধ্যখানে মাথা উচু করে প্রায় পাঁচশো বছর দাঁড়িয়ে আছে মন্দির । একটি মাত্র এই ঘরটির পূব এবং পশ্চিম , অর্থাৎ সামনে এবং পেছনে দেওয়াল সংলগ্ন দুটি পেল্লাই দরজা । একা দরজা খোলা অসম্ভব ।
মায়ের আরো একটি আদেশ ছিল, হয়তো বা পৃথিবীতে পাপে, ব্যাভিচারে রুষ্ট মমতাময়ী জননী সেইসময় ক্রোধের আগুনে জ্বলছিলেন । মায়ের ইচ্ছে নরবলি চাই ।
শুরু হল নরবলি । সত্যিই কেমন সিউড়ি ওঠে শরীর , ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় । বেশ ক'বছর সন্ধিপুজোর ক্ষণে নরবলি হতো । মন্দিরের ভেতরে সেই নরবলির সময় উপস্থিত থাকতো রাজ পরিবারের সদস্যরা আর পুরোহিতেরা । বাইরের জনসাধারণের সেই বলি দেখার কোন অধিকার বা সুযোগ ছিল না ।
বেশ ক'বছর নরবলি হবার পর আরেক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো । সেবার কোন ছোট শিশুকে ধরে আনা হয়েছিল মহা অষ্টমীর দিন নরবলির জন্য । সেই ছোট্ট বালক সারারাত মন্দিরেই আটকে ছিল এবং ভীত বালক সারারাত মায়ের পায়ে মাথা রেখে কেঁদেছে । তার কান্নায় মায়ের হৃদয়েও বুঝিবা দয়া দেখা দিয়েছিল। আবার স্বপ্নাদেশ হয় নরবলি বন্ধ হোক, কেবল এক ফোটা নর রক্ত হলেই চলবে । ঈশ্বরের কৃপায় বন্ধ হলো নরবলি । সেও বহু বছর আগে । মতান্তরে, প্রায় আড়াইশ বছর আগে রাজা নর নারায়ণ আইন করে এই প্রথা বন্ধ করেন ।
তবে আজও বিশেষ এক নির্দিষ্ট বংশের পুরুষই এক ফোটা রক্ত মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে নরবলির প্রথা চালু রেখেছেন । অষ্টমীর দিন আজও ( হয়তো অনেকেরই মনে সন্দেহ থাকবে , তবে সত্যি ) এই নির্দিষ্ট বংশ থেকে একজন সকালে মন্দিরে এসে স্নান , পূজো সেরে তার তর্জনী কেটে রক্ত দিয়ে যান । সেই রক্তে আজও সন্ধিপুজো হয়ে আসছে । বর্তমানে সেখানে প্রতিবছর মহিষ বলি হয় , হয় পাঠাবলি , কবুতর এবং ফল-ফলাদি । দূর-দূরান্ত থেকে লোক আজও আসে মহিষ বলি দেখার লোভে । আর সেই বলি দেখার ভয়ে আমার কোনদিন মহাষ্টমীতে "বড় দেবী"-র পুজো প্রাঙ্গণে যাওয়া হল না । মায়ের নির্দেশই হোক বা রাজার খামখেয়ালীপনায়ই হোক , আদিম এই প্রথা আমি আমি মেনে নিতে পারি নি ।
আশা রাখি আবার মায়েরা আদেশেই হোক বা রাজাদেশেই হোক নরবলির মত, মহিষ কিম্বা পাঁঠা বলির এই আদিম , পৈশাচিক খেলা বন্ধ হবে খুব শিগগিরই ।
এই দেবী মূর্তি আর পাঁচটি দুর্গা মূর্তি থেকে একেবারেই আলাদা । মায়ের স্নেহ ভরা , সুধা ভরা , মমতা ভরা মুখ এই দুর্গা মুরতিতে উধাও । লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ কেউই নেই । মায়ের মূর্তি একেবারে রক্তের মতো লাল রং , অসুরের গাত্র বর্ণ ঘন সবুজ । ডানদিকে সিংহ এবং বাম দিকে বাঘ অসুরকে খুবলে খাচ্ছে , মায়ের দুই পাশে জয়া - বিজয়া , এবং তাদের হাতে জ্বলন্ত মশাল ।
এখানে মায়ের এক হিংস্র পৈশাচিক ভীতিপ্রদ মুখমন্ডল দেখা যায় । মায়ের বিকট এই মূর্তি দেখলে বুকের ভেতর কেমন ভয়ে দুরু দুরু করে ।
অসুর বধের ঠিক সেই মুহূর্তে হয়তো মা এমনটাই চন্ডালমূর্তি ধারণ করেছিলেন । মন্দিরের নাম অনুযায়ী ওই এলাকার নাম হয়ে গেছে দেবী বাড়ি এলাকা ।
ষষ্ঠী পুজো মহা আড়ম্বরে , নানা নিয়ম নীতি র মধ্য শুরু হলেও মায়ের ভোগে থাকে কেবল পায়েস । কেবল নবমীর দিন চাল-ডাল-সবজি- বলির মাংস একসাথে করে বিশেষ আমিষ খিচুড়ি মায়ের প্রসাদে দেওয়া হয়।
মূর্তি গড়ার মধ্যেও আছে অভিনবত্ব । যেহেতু এত বড় মূর্তি ভেতরে ঢোকানো মুশকিল, তাই মন্দিরের ভেতরেই চাকা যুক্ত একটি পাটাতনের ওপর মূর্তি তৈরি হয় এবং মূর্তির কাঠামো তৈরি হয় ময়না গাছের কাঠ দিয়ে । বলা হয়, ময়না গাছ পুঁতেই রাজা এই পূজোর সূচনা করেছিলেন। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। পুজোর ক’দিন খোলা মাঠে মেলা হয়, লোকে লোকারণ্য হয় মন্দির চত্বর।
কোচবিহার জেলায় এই " বড় দেবী " মা বিসর্জন হয় সর্বাগ্রে । একেবারে কাকভোরে প্রায় অন্ধকারে গর্ভগৃহের পেছনের দরজা দিয়ে চাকা বিশিষ্ট কাঠের পাটাতন মূর্তি সমেত টেনে বার করা হয় । মন্দিরের সাথেই লালদীঘি , প্রায় ছোটখাটো একটি নদী বললেও ভুল হবে না । পবিত্র লালদীঘিতে মূর্তির নানা অংশ টুকরো টুকরো করে কেটে লাল দীঘির জলে বিসর্জন দেওয়া হয় । এত ভোরে খুব কম মানুষই উপস্থিত থাকতে পারে , আমিও একবারই মোটেই উপস্থিত ছিলাম । অদ্ভুত সেই দৃশ্য অবলোকন করেছি ।
বিসর্জনের পর মন্দিরটি দাঁড়িয়ে থাকে একা নিরালায় মাঠের ওপর । আবার কোচবিহারবাসীরর প্রতীক্ষা শুরু হয়। এক বছর , একটি বছরের পর আবার "বড়দেবী" আসবেন । , দেবী বাড়ি চত্বর ভরে উঠবে ধূপের গন্ধে , ভরে উঠবে ঢাক কাঁসরঘন্টা এবং উলুধ্বনিতে , চণ্ডীপাঠে ভরে উঠবে আকাশ বাতাস, শ্রদ্ধায় ভক্তিতে মানুষ হবে আপ্লুত ।
প্রার্থনা,প্রতিটি কুচবিহারবাসীর মাথায় থাকুক " বড় দেবী "- র আশীর্বাদ ।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।