১ম অধ্যায়পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
২য় অধ্যায় শুরু ……………
এই ত হল চাঁদের ভীষণতা। এবার দেখা যাক চাঁদের উপকারিতা-অর্থাৎ চাঁদ না
থাকলে কি হতো ?
আগেই জেনেছি যে পৃথিবী যেমন চাঁদকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা টেনে রেখেছে,চাঁদও তেমনি তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে পৃথিবীকে আকর্ষণ করে রেখেছে। ঠাকুরমার
গল্পটা মনে করুন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যদি চাঁদ না থাকতো
অথবা কোনদিন চাঁদ পৃথিবীর আকর্ষণ ছেড়ে অন্য কোন গ্রহের আকর্ষণে দূরে সরে যায় বা
ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তার ফল কি হবে পৃথিবীতে?
ভয়ানক ব্যাপার হবে আমাদের পৃথিবীতে। এর ফলাফল হবে সমুদ্রের জলের উপর,হবে আমাদের আবহাওয়ার উপর,আমাদের ঋতুর উপর,আমাদের
রাত্রিগুলো হবে ভয়ানক অন্ধকারে ভরা এমনকি আমাদের দিন-রাত্রির সময় হবে ২৪ ঘণ্টার
অনেক কম। ব্যাপারটা একটু ভাল করে বিচার করা যাক:
আমরা জানি চাঁদ আমাদের থেকে ৩৮৪,৪০০কিলোমিটার দূরে রয়েছে। এই দূরত্বে থেকে আমাদের পৃথিবীর উপর যে
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রয়োগ করছে তার ফল কি কি হচ্ছে?
আমাদের সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হচ্ছে-চাঁদ না থাকলে এখনকার জোয়ার-ভাটার
এক-তৃতীয়াংশই হতে পারবে।তার কি ফল হবে তা বুঝতেই পারেন-অনেক ছোট নদী শুকিয়ে কাঠ
হয়ে থাকবে।
চাঁদ থাকায় আমাদের পৃথিবীর আহ্নিক(আপন অক্ষের উপর ঘোরা) গতি আর বার্ষিক গতি
(সূর্যের চারিদিকে ঘোরা) একই রয়েছে কেননা চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ এই গতি নিয়ন্ত্রণ
করছে।চাঁদের অভাবে পৃথিবী অনিয়মিত/অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এখনকার থেকে
জোরে ঘুরবে-তার ফল কি হবে?আমাদের
দিন-রাত হবে অনেক ছোট: ৬থেকে ১২ ঘণ্টা। আর আমাদের বছর হবে ১০০০ দিনে!আর কি হবে? কোন গ্রহণ হবে
না।কেননা আমরা জানি গ্রহণ কেন হয়।জানিনা? চাঁদের ছায়া
পৃথিবীর উপরে পড়েই ত সূর্যগ্রহণ আর পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়লেই ত হয়
চন্দ্রগ্রহণ।তাই না?তাই চাঁদ না
থাকলে কোন গ্রহণই হবেনা। তাতে কি ক্ষতি?আমাদের অনেক বৈজ্ঞানিক মাপ-যোপের কাজ করা সম্ভব হবেনা-দিনের
আলোয়।সূর্য-গ্রহণের সময় অনেক বৈজ্ঞানিক মাপ-যোপ করা সম্ভব।
আমরা জানি পৃথিবীর অক্ষ আপন কক্ষপথের সমতলের সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলে আছে-আর এই
ভাবেই সে সূর্য প্রদক্ষিণ করে,যার ফলে আমাদের পৃথিবীতে শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা,বসন্ত,শরত,হেমন্ত এই সব ঋতু দেখতে পাওয়া যায়।চাঁদ না থাকলে পৃথিবী এই সাড়ে ২৩ ডিগ্রি
হেলে থাকবে না-হয় বেশি হেলে থাকবে না হয় মোটেই হেলে থাকবেনা। তার ফলে সময় মত ঋতু
পরিবর্তন না হয়ে অনিয়মিত ভাবে ভীষণ খারাপ আবহাওয়া হতে থাকবে।ভেবে দেখুন যদি বছরের
৩৬৫ দিন একই ভাবে প্রচণ্ড গরম বা প্রচণ্ড শীত হয় তাহলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে
উঠবে না?
আর কি হবে? রাতের আকাশ
হবে মিশমিশে কালো।আমাদের আকাশে চাঁদ সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল বস্তু। তার পরেই হ’ল
আমাদের পড়শি-ভেনাস বা শুক্র গ্রহ।কিন্তু এই শুক্র গ্রহ থেকেও ২০০০ গুণ উজ্জ্বল হল
আমাদের চাঁদ। অতএব চাঁদ-হীন আকাশ কেমন হবে বুঝতেই পারছেন। তাই বলছি শনির ৮২টি বা
বৃহস্পতির ৭৯টি চাঁদ কত উজ্জ্বল জানিনা কিন্তু আমাদের পৃথিবীর একমাত্র চাঁদ শুধু
আকাশ নয় আমাদের জীবনও অনেক অনেক উজ্জ্বল করে রেখেছে।
সেই ১৯৬৯এর জুলাই থেকে শুরু করে আরও কত অ্যাপোলো মিশন চাঁদে নামলো অথবা খুব
কাছ দিয়ে উড়ে গেল।বারো জন মানুষ ত চাঁদের উপর বেড়িয়ে এলো।শেষ অ্যাপোলো-১৭ মিশন চাঁদে নেমেছিল ৭ই
ডিসেম্বর,১৯৭২এ। বারো
দিন চাঁদের মাটিতে ৭.৬ কিলোমিটার(দীর্ঘতম)স্থান চষে বেড়াল আর ফেরার পথে নিয়ে এলো
১১৫কিলোগ্রাম ধুলো-মাটি আর পাথর।এত বেশি দিন আর কোন অ্যাপোলো মিশন চাঁদে কাটাই নি
বা চাঁদের উপর ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেনি অথবা এত বেশি মাত্রায় চাঁদের মাটি-পাথর নিয়ে
আসেনি। সম্ভবত আগামী ৫০ বছরের চন্দ্র অভিযান বিরতির কথা মনে রেখেই।
এর পরই অ্যাপোলো মিশন বন্ধ হয়ে গেল নানা কারণে-বিশেষ করে অর্থাভাব আর
অতিরিক্ত সাবধানতার মূল্য মাথায় রেখেই।
আধা-শতকের পরে আবার এই বছরের (২০২২) আগস্ট মাসে ‘নাসা’ নতুন উদ্যমে চন্দ্র
অভিযানে নেমেছে। একটি অতি শক্তিশালী ৩০-তলা উঁচু রকেটের সাহায্যে। এই নতুন মিশনের
নাম দেওয়া হয়েছে-‘আর্টেমিস’।গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর চাঁদের দেবী,‘আর্টেমিস’ যিনি আবার ‘অ্যাপোলো’র যমজ বোন,তাঁর নাম অনুসারেই এই নতুন মিশনটির নামকরণ করা হয়েছে। মোট ৫টি আর্টেমিস
মিশন চলবে আগামী কয়েক বছর ধরে যেমন চলেছিল অ্যাপোলো মিশনগুলি।
প্রথম মিশন আর্টেমিস-১ গত মাসেই(আগস্ট,২০২২)চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা ছিল কিন্তু শেষ মূহুর্তে কিছু
ইঞ্জিন সংক্রান্ত গণ্ডগোলের জন্য আবার নতুন করে যাত্রার প্রস্তুতি চলছে।সম্ভবত এই
মাসেই যাত্রা করবে চাঁদের উদ্দেশ্যে। “ওরিয়ন” নামক ‘স্পেস ক্যাপসুল’ চাঁদের ১০০
কিলোমিটার উপর থেকে প্রদক্ষিণ করবে।প্রায় দেড়-মাসের মত সময় এইভাবে প্রদক্ষিণ করে
স্পেস-ক্যাপস্যুলটি প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার স্যান্ডিয়াগোর উপকূলে নেমে
আসবে।এরপর আর্টেমিস-২ মিশন যাবে চাঁদ ছাড়িয়ে মহাকাশের আরও অনেক গভীরে যেখানে কোন
মানুষ আজ পর্যন্ত যায়নি।‘ওরিয়ন’ নানের মহাকাশ যানে চারজন ‘নভচর’ থাকবেন। এই মিশনের
সাহায্যে ‘নাসা’ আরও জানতে চায় মানুষ অন্তরিক্ষের কত গভীরে যেতে পারে। আরও পরীক্ষা
করতে চায় ‘জি পি এস’ সঞ্চার প্রণালীর বাইরে গিয়ে নাসার নিজস্ব মহাকাশ সঞ্চার
প্রণালীর সাহায্যে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বানিয়ে রাখতে পারে কিনা। আসলে এই মিশনটিকে
মঙ্গল বা অন্য গ্রহে যাবার প্রস্তুতি বলে মনে করার কারণ রয়েছে। মনে রাখতে হবে চাঁদ
ত ঘরের কাছের গন্তব্য কিন্তু মঙ্গল? সাড়ে ২২ কোটি
কিলোমিটার দূরের গ্রহ।এরপরের অভিযান,‘আর্টেমিস-৩’ মহাকাশ-চারী যাত্রী নিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে।
যাত্রীদের মধ্যে থাকবে একজন মহিলা আর একজন অ-শ্বেত মহাকাশচারী। বৈজ্ঞানিকদের
বিশ্বাস চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে বিশাল বরফের জগত আছে। এক সপ্তাহ-ব্যাপী ওই
নভ-চরেরা ওই অঞ্চলে তথ্য সংগ্রহ আর গবেষণা করবে। এই মিশনের সময় হবে সম্ভবত ২০২৫ এ।
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে আর্টেমিস মিশনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞান কোন দিকে
মোড় নিতে বদ্ধপরিকর: আর চাঁদের গলি মহল্লায় ঘুরে বেড়ানো নয় এবার অভিযান সত্যিকারের
মহাকাশের গভীর প্রদেশে।
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায়
স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে
“অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম।
জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল
নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা।
কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে
পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও
মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ
করে আনন্দ পান।