উত্তরের অক্ষাংশের দেশগুলিতে কষ্টদায়ক,দীর্ঘমেয়াদি
আর রুক্ষ শীত ঋতুর অবসানে প্রকৃতিতে আসে সৌন্দর্য আর কমনীয়তা। আসে ঋতুরাজ বসন্ত
তার মোহময় কমনীয়তা আর ফুল-ফলের ডালি সাজিয়ে। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের
মনেও জাগে আনন্দের হিল্লোল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি শীতের ঘোমটার আড়ালে লুকোবার আগে
প্রকৃতি আর এক অভিনব খেয়ালে হেমন্তের সবুজ পাতা ঝরে বিবর্ণ,কদর্য
হবার আগে অপরূপ সাজে সেজে এক মোহময় রূপ ধারণ করে-যেন সারা প্রকৃতি এক মোহিনী রূপে
কোন এক সোচ্চার অভিসারে চলেছে। এই অভিসারের
অভিযান শুরু হয়ে যায় উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই। আর দক্ষিণ গোলার্ধে
শুরু হয় এপ্রিলের শেষে। বছরের দুই থেকে আড়াই মাস ব্যাপী চলে প্রকৃতির এই চমকপ্রদ
অভিসার। উত্তর আমেরিকা মহাদেশে (ক্যানাডাকে নিয়ে) এর
নাম “ফল-কালার” আর
ইউরোপে একে বলে,“অটাম
ফোলিয়েজ”।এই
‘ফল কালারে’র সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙগুলি হ’ল লাল,হলুদ,বেগুনি,কমলা,গোলাপি আর
বাদামী। অবশ্য,কিছু
গাছ আছে যাদের পাতা সারা বছরেই সবুজ থাকে-যেমন পাইন জাতিয় কিছু গাছ। এরা
সূর্য-কিরণের অপ্রতুলতা বা দিবাভাগের কম হওয়ার ব্যাপারটা খুব সহজ উপায়ে এড়িয়ে যায়।
একটু পরেই সেকথায় আসবো।
আমেরিকা,ক্যানাডা,ইউরোপ,চীন,জাপান,কোরিয়া,অস্ট্রেলিয়া
এই সব দেশে প্রকৃতির এই অভিনব সাজ ‘ফল কলার’ বা ‘ অটম ফোলিয়েজ’ নামে জানা যায়। আমেরিকা আর ক্যানাডাতে এই
ফল কালার দেখার জন্য দলে দলে পর্যটক প্রতি বছর ভিড় করে। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে
বিখ্যাত ‘ফল-কালার’ দেখার স্থান হল
দুটি স্টেট ‘টেনেসি’ আর ‘উত্তর ক্যারোলিনার’ সংযোগ স্থানে অবস্থিত ‘গ্রেট
স্মোকিং মাউন্টেইন’ (Great Smoky Mountains) অঞ্চল।
আমাদের এই গ্রীষ্ম-প্রধান দেশেরও কিছু কিছু অঞ্চলেও প্রকৃতির এই বিচিত্র ‘হোলী’
খেলা দেখা যায়। উত্তরে কাশ্মীর,উত্তরাখণ্ড ছাড়াও মহিষুর,গুজরাট
এমন কি,অবাক
হবেন, কেরলাতেও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রকৃতির এই মোহিনী রূপ দেখতে পাওয়া যায়।
কাব্য সাহিত্য তো অনেক হল,এবার একটু বিজ্ঞানের চোখ নিয়ে দেখা যাক
বছরের একটি বিশেষ সময়ে প্রকৃতির এই ‘হোলী’ খেলা কি ভাবে ঘটে:
গাছের পাতার যে সবুজ রঙ আমরা দেখি তা আসলে
‘ক্লোরোফিল’ নামক রসায়নিক পদার্থ। এই ক্লোরোফিলই সূর্য-কিরণ,কার্বন-ডাই-অক্সাইড
আর জলের সাহায্যে গাছের খাবার,শর্করা বা চিনি উৎপাদন করে। আর এই
ক্লোরোফিলই রামধনুর বাকি ছ’টি রঙকে চাপা দিয়ে নিজের গাড় সবুজ রঙ দান করে গাছের পাতাকে।
শীতের প্রাক্কালে হেমন্তে যখন দিনের ভাগ কম হতে থাকে আর রাতের ভাগ বাড়তে থাকে তখন
গাছের পাতা পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যালোক না পেয়ে শর্করার উৎপাদনও কম হতে থাকে। ওদিকে দিন-রাতের
তাপমাত্রার ব্যবধানও বাড়তে থাকে-দিনে কম গরম আর রাতে হালকা শীত। এই প্রাকৃতিক কারণে
গাছের পাতা থেকে যে খাদ্য শিরা-উপশিরা মারফৎ গাছের শাখা-প্রশাখায় সঞ্চারিত হয় তা
বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। এই সময় পাতার ডাঁটায় ছিপির মত একটি ‘আগল’ বা ‘গেট’ তৈরি হয়ে
পাতার খাবার সঞ্চারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্লোরোফিল না পেয়ে
পাতায় অবস্থিত অন্যান্য রঙ প্রাধান্য পেয়ে যায়। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে যখন পাতার
রঙ অন্য রঙের,লাল,হলুদ,বেগুনী
হয়ে গেছে কিন্তু শিরা-উপশিরার রঙ তখনও হালকা সবুজ থাকে।এই হল সাধারণ ভাষায় ‘ফল-কালারে’র
বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।
এবার
দেখা যাক ‘সদা-সবুজ’ বা ‘এভার গ্রিন’ গাছগুলোর পাতা কি করে সারা বছর সবুজ থাকে?
এই জাতীয় গাছগুলি তাদের পাতাগুলোকে মাদুর বা চাটাইয়ের মত গুটিয়ে শক্ত ‘কোন’ বা
কাঁটার মত তৈরি করে নেয়,যার ফলে পাতার মোট উন্মুক্ত অংশের আয়তন
ভীষণ সীমিত হয়ে যায়। এই কোন বা কাঁটার মত পাতাগুলো থেকে অতি সামান্যই জল আওবহাওয়ায়
বেরিয়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা
হিসাবে এরা পাতার উপরে একধরণের ‘গ্রিজ’ বা তৈলাক্ত পদার্থ ‘ছড়িয়ে’ দেয় যার ফলে
পাতা থেকে জলের ‘অপচয়’ একেবারেই কমে যায়। সেই কারণেই সারা বছর এইসব গাছের খাবার
তৈরির প্রয়োজনীয় ক্লোরোফিল,কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর জল প্রভূত পরিমাণে
থাকার ফলে এরা সারা বছরেই সবুজ থাকতে পারে। তবে এরা কিন্তু ‘জনম-ভোর’ সবুজ
থাকেনা; প্রতি
বছরেই কিছু অংশ পাতা হাল্কা হলুদ রঙ হয়ে ঝরে পড়ে যায়। ওদের
স্থানে আবার নতুন সবুজ পাতা গজায়।
প্রায়ই শুনতে পাবেন
‘এ
বছরে ভাল ফল কালার হবেনা’,ইত্যাদি। কারণটা
হ’লঃ
ভাল ‘ফল-কালারে’র জন্য দুটি জিনিষ বিশেষ প্রয়োজন: প্রাক-হেমন্তে পর্যাপ্ত
বৃষ্টিপাত এবং পরে দিনের বেলায় শুকনো আর উষ্ণ তাপমান-যুক্ত সূর্যকিরণ আর রাত্রিবেলা হাল্কা শীত। ক্যানাডার দক্ষিণ অঞ্চল আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্মোকি
মাউন্টেন অঞ্চলে ঠিক এই ধরণের আবহাওয়া পাওয়া যায় বছরের ওই সময়টাতে,এরই ফল
স্বরূপ প্রতি বছর এই সময়টাতে প্রকৃতির রূপের বর্ণাঢ্য দেখতে পাওয়া যায়।
সময় তো প্রায় হয়ে এলো;প্রকৃতির এই অপরূপ মোহিনী মূর্তি দেখতে হলে ব্যাগ গুছাতে আরম্ভ করে দিন।
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।