১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
২য় পর্ব শুরু ……………
১৯০৭-১৯০৮—
অরবিন্দ দেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠনের চেষ্টায় কলকাতা, পুনে,বোম্বে, বরোদা সহ বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বোস এবং প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ডকে বোমা মেরে হত্যা করতে গিয়ে দুজন বৃটিশ মহিলা--ব্যারিষ্টার কেনেডির স্ত্রী এবং মেয়েকে ভুলক্রমে হত্যা করেন। অরবিন্দকেও এই বোমার মামলায় আসামি হিসেবে কারারুদ্ধ করা হয়।
কারাজীবন--এবং বিপ্লববাদ থেকে আধ্যাত্মিক
জীবনে রূপান্তর
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে এক নির্জন সলিটরি
সেলে অরবিন্দ কারাজীবন কাটাতে
লাগলেন।
এই আলিপুর বোমার মামলা একবছর চলেছিল। দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ অরবিন্দের হয়ে এই মামলা লড়েছিলেন--এবং একবছর পর ১৯০৯ সালের ৬ ই মে
অরবিন্দের কারামুক্তি ঘটে।
এই এক বছরের কারাজীবনে অরবিন্দ ঘোষের পুরো
জীবনযাপন এবং চিন্তা ধারায় এক আমূল পরিবর্তন আসে--এই পরিবর্তন কে রূপান্তর বলাই
শ্রেয়। পরবর্তী জীবনে তাঁর লেখা-"Tales from prison Life বইতে তিনি এই কারাজীবনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিছুটা উদ্ধৃতি দেবার লোভ
সামলাতে পারছি না--তাঁর নিজের মুখেই শোনা যাক—
"The year of 1908, first of May, I was seated in the Hands mataram office, when Shrijut Shyam Sundar Chakravarty handed me a telegram from Muzaffarpur --I was not aware at the time that prime suspect was none other than me and the police investigation featured me as the initiator and secret leader of young Nationalists Revolutionaries, nor did I know at that time that this day would mark the end of a chapter of my life, that these stretched before me a year's imprisonment, during which all bonds of a normal human life would be rent asunder and that for a whole year I would have to live not as part of the civilized human society ,but like a caged animal----And that my return to the field of action would not be as the familiar Aurobindo Ghosh of old but as a transformed being with a transformed character, a transformed intellect, a transformed life a transformed mind ,who would emerge from the Ashram at Slipper to continue the work on new lines. Though I have described it as imprisonment for a year, it was in effect, like a year's seclusion as in an Ashram of Hermitage."
জেলে থাকাকালীন সময়ে অরবিন্দ অনুভব করতেন যেনো স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন--তাঁর কথাতেই-বলি -- "it is a fact that, I was hearing constantly the voice of Vivekananda speaking to me, for a fortnight in the jail in my solitary meditation and felt his presence." তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে মাঝে মাঝেই লিখেছেন যে ভেতর থেকে তিনি যেন একটা ডাক শুনতে পেতেন--একটা গভীর ইনার ভয়েস তাঁকে যেন মাঝে মাঝেই ডাক পাঠাতো। ১৯০৯ সালের ৬ই মে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তিনি একসাথে দুটি
নতুন পত্রিকা প্রকাশনার কাজ শুরু করেন।
--ইংরেজিতে "কর্মযোগিন" এবং বাংলায়--"ধর্ম"।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ সমস্ত রকমের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। এইসময় ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার তাঁকে আবার তাঁর স্বাক্ষরিত প্রবন্ধ--"To My Country Man"-এর জন্য দেশদ্রোহিতার অপরাধে কারারুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল--তিনি তখন চন্দন নগরে মতিলাল রায়ের বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে বাস করতে লাগলেন। যেহেতু অরবিন্দ কে পাওয়া গেলো না সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানাও মুলতবি রইলো। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে র ৪ঠা এপ্রিল আবার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হলো কিন্তু তিনি তখন ফরাসি উপনিবেশ পন্ডিচেরী বা পুদিচ্চেরিতে চলে যাওয়ায় সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেওয়া হলো।
--পন্ডিচেরী আশ্রম-মীরা আলফাসা র
হাতে আশ্রমে র ভার--দেহাবসান (১৯১০-১৯৫০)
পন্ডিচেরীতে আসার পর শ্রী অরবিন্দ এক নতুন
আধ্যাত্মিক জীবনযাপন শুরু করলেন। প্রথম চারবছর অর্থাৎ -১৯১০-১৯১৪-তিনি এক
সেক্লূডেড যোগীর জীবন কাটালেন। তারপর ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি --আর্য-নামে একটি
মাসিক আধ্যাত্মিক ম্যাগাজিন-এর প্রকাশনা শুরু করেন। যদিও অনেক পরে এই পত্রিকাটি-র
প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়--কিন্ত তাঁর অনেক বই এর বীজ এই প্রকাশনা থেকেই অঙ্কুরিত।
যেমন –
১- Life Divine
২- The synthesis of Yoga
৩-- Essays on the Gita
৪-- The Secret of the Veda
৫-- Hymns to the Mystic Fire
৬-- The Renaissance in India
৭-- war and Self-determination
৮-- The Human Cycle
৯-- The Ideal
of Human Unity
১০-- The Future poetry
১১-- Savitri: A legend and a symbol--ইত্যাদি।
শুরু শুরুতে তাঁর শিষ্য সংখ্যা সেরকম না থাকলেও ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে
অরবিন্দ আশ্রম স্থাপনের পর তাঁর শিষ্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে এবং তিনি--শ্রী অরবিন্দ
এই নামে স্বাক্ষর করা আরম্ভ করেন।
১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষকে খন্ডিত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়,শ্রী অরবিন্দ এই পার্টিশনের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি মনে
করেন-- "The Nation will not accept the settled fact as for ever settled, or
anything more than a temporary expedition."
ঋষি অরবিন্দ দুবার নোবেল প্রাইজের জন্য নমিনেটেড
হয়েছিলেন--১৯৪৩ সালে সাহিত্যের জন্য আর ১৯৫০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার এর
জন্য--কিন্তু তাঁকে শেষ পর্যন্ত পুরষ্কার প্রদান করা হয় নি।
মীরা আ্যলফ্যাসা-এবং তাঁর স্বামী পল রিচার্ড ১৯১৪ সালে পন্ডিচেরী
যান-সেখানে মীরা অরবিন্দের শিষ্যা হিসেবে আশ্রমে যোগ দেন--১৯২৬ সালের ২৪ শে
নভেম্বর--অরবিন্দ যখন নির্জনতা বেছে নিয়ে আশ্রমের কাজ থেকে অবসর নেন তখন তিনি
মীরার উপর আশ্রমে র দায়িত্ব ভার দিয়ে যান।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর তাঁর দেহাবসান হয়। পন্ডিচেরী
আশ্রমেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ৬০,০০০ হাজারের ও বেশি মানুষ
তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন।
কথা শেষ
একটি দিব্যজীবন এর পরিসমাপ্তি হলেও তাঁর আদর্শ, ভাবধারার কোনো বিনাশ নেই। তিনি তাঁর --Life Divine বইটিতে
তাঁর বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক উপলব্ধির কথা সবিস্তারে বলে গেছেন।
উপনিষদ,গীতা এই দুই মহান ধর্ম গ্রন্থকে তিনি দিব্য আলোকে
বিশ্লেষণ করে গেছেন। ঈশা উপনিষদ তাঁর রচিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তাঁর
জীবনীকার K.R.S. Iyengar, R.S.Mugali কে
উদ্ধৃত করে বলেছেন--"Sri Aurobindo might have obtained in this Upanishada, the thought-seed
which later grew into Life Divine."
ঋষি অরবিন্দ তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনায় প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের
সমন্বয় সাধন করেছিলেন। এই সিনথেসিস এবং ইন্টিগ্রেশনই তাঁর সাধনায়,তাঁর জীবন সম্পর্কে ব্যাপক ধারণায়,তাঁর রচনায়
বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। ঋষি অরবিন্দের দার্শনিক চিন্তাধারা একজন বিদগ্ধ
অনুসরণকারী শিশির কুমার মৈত্র যথার্থই বলেছেন যে যদিও অরবিন্দ একজন ভারতীয় কিন্তু তিনি
পাশ্চাত্য দর্শন কেও ঠিকমতো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। মৈত্র এবং স্টিভ এই দুজনের
চিন্তাধারা কে সমর্থন করে R.Puliganda তাঁর --"Fundamentals of Indian philosophy"-তে বলেছেন--"Sri Aurobindo 's philosophy is an original synthesis of the Indian and
Western tradition.He integrates in a unique fashion the great social, political
and scientific achievement of the modern west with the ancient and profound
spiritual insights of Hinduism.The vision that powers the life divine of
Aurobindo is none other than the Upanishadic vision of the unity of all
existence."
ঋষি অরবিন্দের প্রভাব আধুনিক ভারতবর্ষে এতোটাই প্রগাঢ়
যে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় পক্ষের বিদগ্ধ পন্ডিতরা --যেমন শিশির কুমার
মৈত্র, অনিলবরণ রায়,ডি পি চট্টোপাধ্যায়,Nieces Eliade, Paul Brunton এবং Rene Guenon একবাক্যে স্বীকার করছেন
যে তিনি ভারতের আধুনিক এবং প্রাচীন আধ্যাত্মিক পরম্পরার -অথেনটিক প্রতীক এবং
প্রতিনিধি।
পাতার পর পাতা লিখে গেলেও এই দিব্য জীবন সম্পর্কে কিছুই বলা হয়
না--শেষ করছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নমস্কার কবিতার আরো কয়েকটি লাইন দিয়ে—
----"দেবতার
দীপ হস্তে যে আসিল ভবে
সেই রুদ্রুদূতে,বলো,কোন
রাজা কবে
পারে শাস্তি দিতে! বন্ধন শৃঙ্খল তার
চরণবন্দনা করি করে নমস্কার-
কারাগার করে অভ্যর্থনা।
ভারতের বীণা পাণি,
হে কবি তোমার মুখে রাখি দৃষ্টি তাঁর
তারে তারে দিয়েছেন বিপুল -ঝংকার--
তাই শুনি আজ
কোথা হতে ঝঞ্ঝা-সাথে সিন্ধুর গর্জন,
অন্ধবেগে নির্ঝরের উন্মত্ত নর্তন
পাষাণপিঞ্জর টুটি,বজ্র গর্জরব
ভেরীমন্দ্রে মেঘপুঞ্জ জাগায় ভৈরব।
এ উদাত্ত সংগীতের তরঙ্গ-মাঝার,
অরবিন্দ,রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।।"
লেখিকার পরিচিতি –
জন্ম-কলকাতা য় । আসামের বরাক উপত্যকায় বড় হয়ে ওঠা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
১--সাপ শিশির খায় (গল্প গ্রন্থ)
২--দেবী দহন--(কবিতা গ্রন্থ)
ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত