সবজি দেখেই জবার মেজাজ চড়চড় করে সপ্তমে উঠে যায় । থলে থেকে সবজি বার করতে করতে
তিনি চিৎকার করে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন --- তুমি আবার সেই কচু-ঘেঁচু,বেগুন,কুমড়ো নিয়ে এসেছো! বাজারে কি সবুজ সবজির আকাল পড়েছে।
পটল,ঝিঙে,ধুঁদুল,ভিন্ডী,লাউ,বরবটি,টিন্ডা ও শিমলামির্চ
ইত্যাদি কত রকমের সবুজ সবজি আছে গরমকালের ।
বৌয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে রতন সিকদার নরম গলায় বললেন --- সারা বাজার জুড়ে
সবুজ রং মাখানো সবুজ সবজির বাহার । ওই সব সবজি খেলে নির্ঘাৎ ক্যানসার । তাই আনিনি
।
আগুনে ঘী পড়ার মত স্বামীর কথায় জবা
তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন ।
ক্রোধান্বিত গলায় বললেন--- দুনিয়ার লোক সবুজ সবজি খাচ্ছে না ? আর আমরা খেলেই আমাদের ক্যানসার হবে,তাই না ! ছেলে-মেয়ে দুটি তো বেশীর ভাগ দিন বাইরে খেয়ে আসছে ।
একজন অফিসের ক্যান্টিনে,আর একজন কলেজের ক্যান্টিনে । এরকম
সবজি প্রতিদিন এলে ওরা তো ঘরের খাওয়া
ছেড়েই দেবে । রাগে গজ-গজ করতে করতে জবা বললেন--- ঘরে চিংড়ি মাছ ছিল বলে বলেছিলাম লাউ নিয়ে আসতে । লাউ চিংড়ি করব,তার কী হল ? সেটাও কী রঙে চোবানো ছিল ! রতন সিকদার মিন-মিন করে বললেন--- তা নয় । বাজারে একটাও কচি লাউ ছিল
না । ইয়া বড়-বড় সব লাউ । ইনজেকশন দিয়ে বড় করা সব লাউ । ওই
লাউ খেলে নির্ঘাৎ লিভার,কিডনী ড্যামেজ হবে ।
--- রাখো তোমার লিভার,কিডনী !
ঝংকার দিয়ে ওঠেন জবা, বললেন--- তোমার
ওই কচু,কুমড়ো,বেগুন কি এক্কেবারে ধোয়া
তুলসীপাতা ! এর উৎপাদনে কি পেস্টিসাইড,ইউরিয়া
দেওয়া হয়নি ।
রতন সিকদার কৃতিত্বের গলায় বললেন--- তাই তো বেছে-বেছে পোকা ধরা কানা বেগুনগুলো এনেছি । অন্ততঃ এতে পেস্টিসাইড নেই ।
জবা হাসবে না নিজের পোড়া কপালের জন্য কাঁদবে ভেবে পান না ।
সাবধানের মার নেই । তাই রতন সিকদার সব
কিছু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে-শুনে ও ভালভাবে পরীক্ষা করে বেছে-বেছে জিনিষ কেনেন।
যাতে খারাপ বা ভেজাল জিনিষ শরীরে না ঢোকে । এই সেদিন দূরদর্শনে দেখাচ্ছিল দুধে কী ভাবে ইউরিয়া ও
ডিটার্জেন্ট মিশিয়ে 'পিয়োর দুধ' বাজারে
বিক্রী হচ্ছে অবাধে এবং ঘী তৈরীর কারখানায় কী ভাবে মরা জন্তু-জানোয়ারের চর্বি থেকে 'পিয়োর গাওয়া ঘী' তৈরী হচ্ছে অবলীলায় । এই সব খেলে মানুষের কল-কবজা
অচল হতে বেশী দেরী লাগবে না । সেই থেকে
রতন সিকদার দুধ ও গাওয়া ঘী খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এই নিয়ে প্রায়ই স্ত্রীর সঙ্গে
তুমুল সংঘাত বাধে। বাড়িতে ঘী ঢোকে না কিন্তু দুধ বন্ধ করতে পারেননি তিনি । নিজে
মিল্ক পাউডার দিয়ে কফি খান । চা খাওয়া ছেড়েছেন, সে আর এক
কাহিনী ।
রতন সিকদারের ছোট ভাই,যতীন সিকদার বিয়ে-থা করেননি ।
ব্যাচেলার মানুষ । কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসে একজন উচ্চপদস্থ অফিসার । ছুটি-ছাটায় তিনি তাঁর এক পাঞ্জাবী বন্ধু, মঞ্জিতের বাড়িতে
ড্রিঙ্কস্ করতে যান । মঞ্জিতের
বাড়িতে তেতলার ঘরে দুই বন্ধু মিলে মনের
সুখে ড্রিঙ্কস্ করেন । একদিন যতীন লক্ষ্য করেন যে ছাদে ডাঁই
করে রাখা লোহা-লক্কড়
ও লোহার চূর্ণ । কৌতূহলবশতঃ যতীন সিকদার
মঞ্জিতকে জিজ্ঞেস করলেন --- তোমরা কী চায়ের ব্যবসা
তুলে দিয়ে লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা শুরু করেছো ? মঞ্জিত অবাক হওয়া গলায় বললেন --- কেন ? চায়ের ব্যবসা তুলে দেব কেন ? ওটা তো আমাদের
তিনপুরুষের ব্যবসা। যতীন বললেন --- তোমাদের ছাতে ডাঁই করা লোহা-লক্কড় ও লোহার চূর্ণ দেখে আমি ভাবলাম, তোমরা বুঝি চায়ের ব্যবসা তুলে দিয়ে লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা শুরু করেছো!
মঞ্জিত হাসতে-হাসতে বলেছিলেন --- চায়ের ব্যবসাতেই ওই লোহার ডাস্টগুলো প্রয়োজন হয়। চায়ের মধ্যে লোহার
ডাস্টগুলো মেশানো হয় । শুনে তো যতীনের চক্ষু চড়কগাছ । পেটে খানিকটা তরল পানীয়-র প্রভাবেই বোধহয় সরল সত্য কথাটা বেরিয়ে পড়েছিল সেদিন মঞ্জিতের মুখ থেকে ।
ঘটনাটি যতীন নিজের দাদাকে বলেছিলেন । সেই থেকে রতন সিকদার চা পানও ত্যাগ করেন ।
ইদানীং রতন সিকদারের শরীর ভাল যাচ্ছে না । সর্বদাই মাথা ঘোরে । শরীর ঝিমঝিম
করে । গ্যাস,অম্বল,চোঁয়া ঢেকুর লেগেই আছে হরদম । ডাক্তার-বদ্যি দেখানো
হচ্ছে নিয়মিত কিন্তু উন্নতির লক্ষণ নেই বললেই চলে ।
রতন সিকদার সস্ত্রীক গ্রামের বাড়িতে এসেছেন হৃত স্বাস্থ ফেরাতে । দিল্লিতে
ভেজাল খেয়ে-খেয়ে শরীরের সব কল-কবজা অচল হয়ে পড়ছিল । আগে ছেলে-মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন
প্রতিবছর গরমের ছুটিতে সপরিবারে আসতেন হবিবপুরে গ্রামের বাড়িতে । তখন বাবা-মা জীবিত
ছিলেন। বেশ কিছু বছর হল বাবা-মা দুজনেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন ।
সেই থেকে তাঁদেরও গ্রামের বাড়িতে আসা বন্ধ
হয়ে গেছে । একমাত্র মেজোভাই রথীনই সপরিবারে থাকেন
গ্রামের বাড়িতে । জমিজমা দেখাশোনা করেন । নিজের হাতে ফসল ফলান । শাক-সবজি উৎপাদন করেন ।
কতকাল পর দাদা-বৌদি এসেছেন ।
বাড়িতে যেন মচ্ছব লেগে গেছে । আর রতন
সিকদার তো আহ্লাদে আটখানা । টাটকা শাক-সবজি । পুকুরের টাটকা
মাছ । গাছ থেকে পেড়ে যত খুশী খাও ডাব-নারকোল । বাড়ির গরুর
শুদ্ধ দুধ । বাড়ির গাওয়া ঘী । সব যেন অমৃত । শরীরটাও যেন আতঙ্ক মুক্ত । কিন্তু তিন-চার দিন যেতে না যেতেই রতন সিকদারের পেটের মধ্যে গুড়গুড় গুড়ুম,ভুট-ভাট শব্দের বজ্র নিনাদ শোনা যাচ্ছিল তারপরেই
প্রচণ্ড কলরোলে জলের মত বাহ্যে তীব্র বেগে নির্গত হতে থাকে ক্রমাগত । তাঁর অবস্থা
দ্রুত খারাপের দিকে যেতে থাকে । শরীরের সব শক্তি যেন এক নিমেষে উধাও । শেষে তাঁকে
রানাঘাটের সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। তারপর দশ-বারো দিন
চলল যম ও ডাক্তারের টানাটানি,টাগ অব ওয়ার । শেষে ডাক্তারের হাত যশের কল্যাণে এবং রতন
সিকদারের কপাল গুণে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন ।
পরিশেষে অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ডাক্তার বললেন - অল্প-বিস্তর ভেজাল খাবার খেয়ে-খেয়ে আমাদের শরীরের সিস্টেম সেই অনুরূপ তৈরী হয়ে গেছে । এখন এক্কেবারে
পিয়োর শুদ্ধ খাবার থুড়ি বিজাতীয় জিনিষ যদি শরীরে ঢোকে তাহলে শরীর বিদ্রোহ করে উঠবে
এমনকি অক্কা প্রাপ্তিও ঘটতে পারে ।
লেখিকার পরিচিতি - যদিও জন্ম পলাশীপাড়া, নদীয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু তার শৈশব বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা তৃণীর’ প্রকাশ করতেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দি ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবি রাখোলিও সিনান-এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলাতে অনুবাদ করেছেন। অনুশীলন পত্রিকা, সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে প্রাপ্তি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বর ও মানুষ’ (অণুগল্প ও ছোট গল্প সংকলন)।