১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
২য় পর্ব শুরু …………………
চার।। ওই বছরেই (২০২১) আমাদের ‘পড়সি’ গ্রহ মঙ্গলে ‘যান-জট’ বা
‘ট্রাফিক-জাম’ শুরু হয়ে গেছে। এই প্রতিযোগিতায় অনেক দেশ মঙ্গলে নিজের নিজের অভিযান শুরু করে দিয়েছেন-এই
কোভিড-১৯ মহামারীর বছরেও তিনিটি দেশ পাঠিয়েছে তাদের যান-এই দেশগুলো হ’ল আমেরিকা,চীন ও
সৌদি-আরব। আমেরিকা আর চীনের যানগুলির কোলে রাখা হেলিকপ্টার বা মোটরযান মঙ্গলের
মাটিতে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করছে গতবছর মে মাস থেকে। আবার কয়েকটি দেশ/সংস্থা আগামী
কয়েক বছরের মধ্যেই মঙ্গলে মনুষ্য-বসতি স্থাপনের পরিকল্পনার কাঠামো তৈরি করে
ফেলেছেন।
পাঁচ: ইটি বা
এক্সট্রা-টেরিস্টিয়াল নিয়ে মানুষের ঔৎসুক্য বহু পুরানো। বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত এ
নিয়ে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি -‘ই টি’ কি আছে? এই
ব্যাপারে মহান মহাকাশ-বিজ্ঞানী,কার্ল স্যাগন এর উক্তি স্মরণ-যোগ্য,উনি
বলেছিলেন, ব্রহ্মাণ্ড
এক অসীম-অনন্ত স্থান,এই অন্ত-হীন স্থানে যদি কেবল পৃথিবী নামক
একটি ছোট গ্রহে কিছু জীবন্ত বাসিন্দাই থাকবে তাহলে সেটা হবে এই অসীম-অনন্ত স্থানের
ভয়ানক ‘অপচয়” (“The Universe is a pretty big space. If it’s
only us, it seems like an awful waste of space”)। এ
নিয়ে গত বছরের (২০২১) আগস্ট মাসে কেম্ব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমির একদল
বিজ্ঞানী গবেষণা-লব্ধ জ্ঞান থেকে একটি বিশেষ নিবন্ধে জানিয়েছেন যে সুদূর মহাকাশের
গভীরে বিশাল সমুদ্রের মত জল-বেষ্টিত এক ধরনের গ্রহ আছে (Hycean
Planets) যার থেকে ‘জীবনের’ উপস্থিতির সংকেত পাবার
প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এইসব গ্রহ আমাদের পৃথিবীর চেয়ে কম করে আড়াই-গুন বড়। যদিও
এইসব গ্রহের উপরিভাগের তাপমান প্রায় ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর এদের উপরের বায়ুচাপ
অত্যধিক তবু ওঁরা মনে করেন এই গ্রহ থেকে ‘জীবনের’ সঙ্কেত পাবার প্রবল সম্ভাবনা
আছে। ওদের বিশ্বাস ‘ওয়েব’ নিশ্চয়ই মানুষের এই অনন্ত-কালীন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে
দিতে সাহায্য করবে। একদিন হয়ত আমরা ‘ই টি’-কেও আমাদের
গ্রহে ‘আমন্ত্রণ’ জানাতে সক্ষম হ’ব।
ছয়: ‘খোদার
উপর খবরদারী’ আর কি! এই বছরেই বৈজ্ঞানিকরা মানুষের শরীরের ‘জিন’ এর পরিবর্তন এর
জন্য জীবন্ত মানুষের ধমনিতে সূঁচ ফুটিয়ে তার ‘জিন’
পরিবর্তনের পরীক্ষায় প্রায় সফলতা অর্জন করে ফেলেছেন। ‘জিন’ হ’ল যে কোন জীবের
শরীরের প্রাথমিক বস্তু-এরই দ্বারা জীবের গড়ন,চলন-বলন
আর ভবিষ্যৎ বংশধরের ‘দর্শন ও চলন-বলন’ নির্ধারিত হয়। ‘জীবের’ প্রাথমিক বস্তুকে
সংশোধন বা এডিট করতে পারলে অনেক পারিবারিক রোগ বা দৈহিক অপূর্ণতা ঠিক করে নেওয়া
সম্ভব হবে। এর আগে এই ধরণের পরীক্ষা,পরীক্ষাগারে সিরিঞ্জ
মারফৎ রক্ত নিয়েই করা হয়েছে। এই বছরেই (২০২১) প্রথম সরাসরি মানুষের দেহে সূঁচ ফুটিয়ে তার ‘জিন’ সংশোধন করার চেষ্টা হয়ে প্রায় সফলতার সিঁড়িতে পৌঁছে
গেছে। এ যে কত বড় আবিষ্কার তা আজই হয়ত আমরা বুঝতে পারছিনা, কিন্তু
অদূর ভবিষ্যতে এর ফল আমরা পেয়ে যাব।
সাত: প্রস্তর
যুগের মানুষ থেকে আধুনিক দিনের মানুষের বিবর্তন কিভাবে হ’ল এটা আমাদের মনের
চিরন্তন জিজ্ঞাসার অন্যতম। বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুসারে ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগে
মানুষের আদিম পুরুষ এই পৃথিবীতে এসেছিল-সম্ভবত আফ্রিকাতে কিছু বাঁদর
জাতীয় পশু যখন সোজা হয়ে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করল সেই দিন
থেকেই তার বিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়েছিল। নব্বই বছর আগে চীন দেশের এক
গ্রামে এক কৃষক একটি মানুষের মাথার বড় খুলি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পেয়েছিল। সেটিকে
বংশ পরম্পরায় ওরা মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। ইদানীং সেই পরিবারের একজন সেই
খুলিটিকে চীনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। বৈজ্ঞানিকরা
আশা করেন ওই খুলির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ‘মানুষে’র বিবর্তনের কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া
সম্ভব হবে।
আট: আমরা
অনেকেই ‘কোয়ান্টাম-কম্প্যুটারের’ কথা শুনেছি।এই জাতীয় প্রসেসর (Processor) আজকের
দ্রুততম কম্প্যুটারের কয়েক লক্ষ গুন দ্রুত কাজ করতে পারে। দু’হাজার উনিশে (২০১৯)
গুগুল আর ‘নাসা’ মিলিত ভাবে প্রথম একটি কোয়ান্টাম কম্প্যুটার তৈরি করে। গণনা বা
ক্যালকুলেশন করে দেখালেন যে এই কম্প্যুটারটি সেদিনের পৃথিবীর দ্রুততম কম্প্যুটার
“সাইক্যাম” এর চেয়ে ৩০ লক্ষ গুন দ্রুত কাজ করে ! এর পর বিখ্যাত কম্প্যুটার
কোম্পানি ‘আই বি এম’ (IBM) গত বছর
নভেম্বর মাসে ১২৭ কোয়ান্টাম-বিটের একটি কম্প্যুটার তৈরি করেছেন বলে জানিয়েছেন। সেটি
গুগুল এর কম্প্যুটারের চেয়েও কয়েক হাজার গুন দ্রুত কাজ করতে পারে। আই বি এম আরও
জানিয়েছে ওরা এখন ৪৩৩ কোয়ান্টাম বিটের কম্প্যুটার তৈরিতে মন দিয়েছে যা চলতি বছর (২০২২)-এ তৈরি হয়ে বেরুবে। বোঝাই যাচ্ছে তার কাজের
গতি কি ভীষণ দ্রুত হবে।
নয়: আমরা
মানুষেরা যেমন পৃথিবীর বিবর্তনের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছি তেমনি আমরাও এই গ্রহের
অন্যান্য প্রাণী আর জীব-জন্তুকে বিবর্তিত করেছি। ছবিতে নিশ্চয়ই দেখেছেন প্রকাণ্ড
দেহধারী ‘ম্যামথ’ (Mammoth) নামের
হাতির কি বিশাল শুঁড় ছিল। আমরা মানুষেরা সেই হাতিকে মেরে তার দাঁত দিয়ে ঘর
সাজিয়েছি আর ধীরে ধীরে সেই অতিকায় হাতির বংশ লোপ পেয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের হাতি
কিন্তু আজও আমাদের দেশের হাতির তুলনায় অনেক বড়। বাকি আরও অনেক জন্তুর ক্ষেত্রেও
তাই ঘটেছে। কিছু জন্তু তো এ পৃথিবী থেকেই ‘লোপ’
পেয়েছে।
দশ: মানুষের
শরীরে কেবল হৃদযন্ত্রের (Heart)-ই কোন
বিকল্প বা স্ট্যান্ড-বাই নেই। শুধু মাত্র ইয়োরোপ-আমেরিকায়ই বছরে প্রায় এক কোটি লোক
‘হার্ট-ফেল’ হয়ে মারা যান। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় হৃদযন্ত্র-দাতার (Heart
Doner) সংখ্যা অতি নগণ্য। কয়েক মাস আগেই খবরে
পড়েছেন বা টি ভি তে দেখেছেন যে আমেরিকায় একজন মানুষের দেহে তার ক্ষতিগ্রস্ত
হৃদযন্ত্র বদলে একটি শূয়রের হৃদযন্ত্র লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনে থাকতে পারে,এই জাতীয় পরীক্ষা সর্বপ্রথমে,১৯৯৭ এর ১লা জানুয়ারি আমাদের
দেশেরই ডাক্তার ডঃ ধনীরাম বড়ুয়া করেছিলেন; দুর্ভাগ্যক্রমে
রোগীটি এক সপ্তাহের বেশি বেঁচে থাকেন নি আর ডঃ বড়ুয়াকে এর জন্য জেল যেতে হয়েছিল। এই
ব্যাপারে বিজ্ঞান আর এক ধাপ এগিয়ে গেছে,তাও এই ২০২১ এই। টাইটানিয়াম
ধাতুর হৃদযন্ত্র বানানো হয়ে গেছে এবং তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এই পরীক্ষা সফল
হলে ভবিষ্যতে পৃথিবীতে অগণিত মানুষ হৃদরোগে ভুগে অকালে মারা যাবেন না।
এই
সব যুগান্তকারী ও অভিনব আবিষ্কার ও ব্যবহার মানুষের অদমনীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা আর
উদ্ভাবনী শক্তিরই পরিচয়। কি কোভিড-১৯ মারতে পেরেছে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে ?
পারেনি, নিশ্চয়ই
পারেনি।
তবুও কবির বিখ্যাত লাইনগুলিও ভুলিনাঃ
“মনে
আছে?
সিরিয়ার সেই ৩ বছরের ছেলেটির কথা—
বোমায় ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে
মরার আগে যে বলেছিল-আমি
ঈশ্বরকে সব বলে দেব”।
সে নিশ্চয়ই বলে দিয়েছিল ঈশ্বরকে।
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।