আমরা যদি মনে করি বিজ্ঞানের বিজয় যাত্রা নিউটনের ‘মাথায় আপেল পড়া’ থেকে শুরু হয়েছিল তাহলে আমরা ভীষণ ভুল করবো। জন্মগত ভাবে মানুষ অনুসন্ধিৎসু-সে সব সময় জিজ্ঞাসু-কি,কেন,কি করে'-র মত প্রশ্ন সর্বদা মানুষের মনকে ব্যস্ত করে রাখে। এমনই একজন মানুষ জন্মেছিলেন যীশু খ্রিষ্টের জন্মের ২৭৬ বছর আগে। নাম তাঁর এরাটোস্থেনিস। তিনিই বোধ হয় ছিলেন পৃথিবীর প্রথম গণিতজ্ঞ আর ভৌগলিক। ওঁর আগেই গ্রীক বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবী সমতল নয়-গোলাকার। সূর্যও যে গোলাকার সেই তথ্য ব্যবহার করে উনি হিসেব করে বললেন যে পৃথিবীর আকার (সাইজ) বা সারকমফিয়ারেন্স হল: ৩৯,৬৯০ কিলোমিটার! কি অসাধারণ কাজ। অনেক অনেক পরে সত্যি সত্যি মেপে দেখা গেল যে এরাটোস্থেনিসের হিসাবে মোটে ৩৪০ কিলোমিটার কম হয়েছিল। আজ আমরা জানি যে কোন গোলকের আয়তন হচ্ছে ২*পাই*তার ব্যাসার্ধ(2*Pi*R)। আমরা জানি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ হল ৬৩৭৮ কিলোমিটার আর পাই হল ৩.১৪১৫৯৯২৬৫.., হিসেব করে দেখুন কত হয়।
এ তো গেল
খ্রিষ্ট জন্মের আগে। এবার আসুন তার পরে কি হ’ল। প্রথম শতাব্দীতেই ক্লডিয়াস টলেমী
হিসেব করে বললেন সূর্য, চন্দ্র, গ্রহাদি
পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছেনা,আসলে পৃথিবীই অন্যান্যদের সঙ্গে সূর্যের
চারিদিকে ঘুরছে।
এরপর ষোড়শ শতাব্দীতে পোল্যান্ডের
বৈজ্ঞানিক নিকোলাস কোপার্নিকাস প্রমাণ করলেন সেই তথ্যের সত্যতা। আর পরবর্তী
শতাব্দীতে জোহানেস কেপলার অঙ্ক কষে প্রমাণ করে বললেন যে আমাদের পৃথিবী আর অন্যান্য
গ্রহরা বৃত্তাকারে নয় উপ-বৃত্তাকারে (Ellipse) বিভিন্ন দূরত্ব থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
আবার ওই সপ্তদশ শতাব্দীতেই গ্যালিলিয়ো
গ্যালিলি বানালেন প্রথম মহাকাশ দূরবীন-যার সাহায্যে তিনি দেখালেন মহাকাশের আরও
অনেক গ্রহ-নক্ষত্র আর তাদের স্বরূপ। উনিই তাঁর দূরবীনের সাহায্যে আমাদের দেখালেন
শনি গ্রহের চারিদিকের রহস্যজনক বলয়গুলিকে। আবার সেই দূরবীনের সাহায্যেই দেখালেন
বৃহস্পতি গ্রহের প্রথম চারটি চাঁদ বা উপগ্রহ। তাই আজও এই চারটি উপগ্রহকে বলা হয়
‘গ্যালিলিয়ান চাঁদ’। আজ,অবশ্য, আমরা
জানি বৃহস্পতির মোট ৭৯টি উপগ্রহ বা চাঁদ আছে।
তারপর এলো মহামতি নিউটনের যুগ। অষ্টাদশ
শতাব্দীর মাঝা মাঝি স্যার আইজ্যাক নিউটন আবিস্কার করলেন যুগান্তকারী গ্র্যাভিটি বা
মাধ্যাকর্ষণ আর তিনিটি অসাধারণ গতির নিয়ম বা Laws of Motion।
তারপরের দুই উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীতে
মানুষ-এর জ্ঞানের সীমা পরিসীমা যেন মহাকাশের
মতই অসীম হতে আরম্ভ হল। অসাধারণ মেধাবী ব্রিটিশ মহাকাশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং
দেখালেন যে স্পেস বা মহাকাশ সত্যি অসীম। ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম,গঠন আর
বয়স জানা থেকে শুরু করে “ব্ল্যাক হোল”-এর রহস্য
পর্যন্ত উনি তাঁর অনুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন আর পৃথিবীকে
জানালেন। ভয়ানক “মোটর নিউরন” রোগে আক্রান্ত এই মনীষী বিশেষভাবে তৈরি তাঁর চেয়ারে
বসেই ‘দেখলেন’ এই বিপুল ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত রহস্য। তিনি বললেন আমাদের এই
ব্রহ্মাণ্ডের কোনে কোনে ছেয়ে রয়েছে কয়েক কোটি ‘ব্ল্যাক-হোল’। এই ব্ল্যাক হোল গুলি
এতই বিশাল আর ঘন-বিন্যস্ত যে এক একটি ব্ল্যাক হোলের ওজন আমাদের সূর্যের ৪০ লক্ষ
গুন! এই অসাধারণ মহাকাশ বস্তুগুলির মাধ্যাকর্ষণ থেকে কারও মুক্তি নেই-এমন কি আলো
পর্যন্ত ওদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কাছে মাথা নত করে বেঁকে যায়। তাঁর প্রদর্শিত পথে
আজও বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী চলে নতুন নতুন অধ্যায় রচনা করে চলেছে।
অনেকে বলেন বিজ্ঞানের এত জয়যাত্রা
স্বত্বেও জগত-জোড়া কোভিড-১৯ মহামারীর বিষাক্ত ছোবল থেকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন
দেশই রক্ষা পেল না। এক বছরের অধিক সময় ধরে এই মহামারী সারা পৃথিবীকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
এখনও এই ২০২২এ ও এর থেকে পৃথিবী মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু জগত-জোড়া এই অতি-মারী
পঙ্গু করতে পারেনি মানুষের অদমনীয় উদ্দীপনাকে,পারেনি
রুখতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে। সারা পৃথিবী এমন ভয়ানক মহামারীর কবলিত হয়েও নতুন
শতাব্দীর তৃতীয় দশকের প্রথম বছরটি (২০২১) বিজ্ঞানের জয়যাত্রার দিক থেকে পরম
গৌরবান্বিত বছর বলে গণ্য হয়েছে।
ওই বছরের মাত্র দশটি বিশেষ বৈজ্ঞানিক
অবদানের উল্লেখ করলেই এই দাবীর সত্যতা বোঝা যাবে:
এক: আমরা জানি,৩০শে
জানুয়ারি,২০২০তারিখে
আমাদের দেশের দক্ষিণ প্রান্তে -কেরালার তিনটি স্থানে কোভিড-১৯ রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। আর এক বছরের কম সময়েই, ১৬ই
জানুয়ারি,২০২১শে
আমাদের দেশে এই রোগের প্রতিরোধক আবিষ্কার এবং টিকা-করণ শুরু হয়ে গেল। সাধারণত এই
সব রোগের টিকা বা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে এক বা একাধিক যুগ লেগে যায়। অথচ মাত্র এক
বছরের মধ্যেই এই টিকার আবিষ্কার,তৈয়ার,পরীক্ষাগারে
এবং মানুষের উপর পরীক্ষা ও মানব-শরীরে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেল। এটি পৃথিবীতে একটি
অভূতপূর্ব ঘটনা। ভুললে চলবেনা ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার ভয়ানক বসন্ত আর ‘মিজল’ বা
‘হাম’ এর টিকা আবিষ্কার করেছিলেন আর ২০০ বছরের মধ্যে সারা পৃথিবী থেকে এই মারাত্মক
রোগ নির্মূল হয়ে গেল। একই ভাবে জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন লুই
পাস্তুর-লেগে গিয়েছিল অনেক গুলো বছর। এই ভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো আর ভয়ানক রোগ
প্লেগ,মারাত্মক
কলেরা,টিটেনাস,টাইফয়েড,টি বি’র
প্রতিরোধক আবিষ্কার হয়েছিল।এক-একটি আবিষ্কারে এক এক যুগ বা তারও বেশি লেগে
গিয়েছিল।
দুই: আর
একটি প্রাণঘাতী রোগ হ’ল ম্যালেরিয়া। জেনে অবাক হবেন,পৃথিবীতে
এই রোগে বাৎসরিক মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি! আর এদের একটা বড় সংখ্যাই হ’ল শিশু ও
কিশোর। বাচ্চাদের শরীরে প্রয়োগ-যোগ্য ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার এই বছরের আর একটি
অনন্য নতুন দিশা আবিষ্কারের ঘটনা। এর ফলে অগুনিত শিশু আর ছোটরা মুক্তি পাবে এই
রোগের মারাত্মক ছোবল থেকে।
তিন: এই
বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের এক কোনে একটি ছোট গ্রহের মানুষ আমরা ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি
রহস্যের প্রায় কিছুই জানিনা-কেননা অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য জানতে গেলে যে
‘দূরদৃষ্টি’ প্রয়োজন সে ধরণের শক্তিশালী দূরবীন আমাদের নেই।
যত বড় দূরবীনই হোক পৃথিবীর উপর থেকে আর
কতদূর দেখা যায় অসীমের? বৈজ্ঞানিকেরা
ভাবলেন ,তাহলে
পৃথিবী ছেড়ে আকাশে এগিয়ে গিয়ে দূরবীন লাগালে আরও দূরে দেখা যাবে। এই উদ্দেশ্যেই ৩২
বছর আগে ২৪ শে এপ্রিল,১৯৯০তারিখে একটি বড় টেলিস্কোপ তৈরি করা
হল। ‘নাসা’র স্পেস-সাঁটল (Space Shuttle) ডিসকভারি
(Discovery)’-র পিঠে
বেঁধে এই বিপুল ক্ষমতা-সম্পন্ন, ‘হুবেল টেলিস্কোপ’কে পাঠানো হ’ল। মহাকাশের
৫৪৭ কিলোমিটার উপরে-স্থাপন করা হ’ল পৃথিবী প্রদক্ষিণের কক্ষপথে। ‘হুবেল’ টেলিস্কোপ
মহাকাশের সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার উপর থেকে মহাকাশে নজর রাখে আর প্রতি ৯৫ মিনিটে
একবার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। ‘হুবেল’ এইভাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৫ বার পৃথিবী
প্রদক্ষিণ করে সারা ব্রহ্মাণ্ডের উপর নজর রাখছে। বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড
হুবেল এর নামেই এই বেতার টেলিস্কোপ (Hubble Radio Telescope)টি’র
নামকরণ করা হয়েছিল। এই প্রবল ক্ষমতা-সম্পন্ন বেতার টেলিস্কোপ গত ৩২ বছর মহাকাশ
থেকে কাজ করে আমাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘হুবেল’ই আমাদের সাহায্য
করেছিল ব্রহ্মাণ্ডের বয়স (১৩৮০ কোটি বছর) নির্ণয়ে। ব্রহ্মাণ্ডের আয়ু-কাল আমাদের
পৃথিবীর আয়ু-কালের প্রায় তিনগুণ,তাইনা? আমাদের
সৌর-মণ্ডলের গঠন হয়েছিল,আমরা জানি, মহাকাশের
ধুলো-ময়লা আর গ্যাসের মিশ্রণের কুয়াসা যার নাম ‘সৌর-নেবুলা’ থেকে। সে ছিল ৪৫০কোটি
বছর আগে। ক্রমশ,সূর্য
থেকে নির্গত,উষ্ণ
‘সৌর-বায়ুর’ প্রভাবে সেই কুয়াশা দূর হয়ে গেলে প্রকাশিত হ’ল সৌর মণ্ডলের গ্রহ,উপগ্রহ আর
নক্ষত্ররা। কিন্তু অসীম ব্রহ্মাণ্ডের গভীরে দেখার ক্ষমতা ছিল না ‘হুবেল’ এর। এই
অক্ষমতা বৈজ্ঞানিকদের প্রতিনিয়ত অক্ষমতা বোধের কষ্ট দিত। গত ২৫ বছর ধরে তাই আরও
নতুন আর শক্তিশালী দূরবীনের জন্য কাজ চলছিল।
তারই ফলস্বরূপ গত বছর ২৫শে ডিসেম্বর(২০২১)
খ্রিস্টমাসের প্রভাতে ছাড়া হল এক বিশাল শক্তিশালী বেতার দূরবীন বা রেডিও
টেলিস্কোপ-‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’ (JWST) যাকে ছোট করে শুধু ‘ওয়েব’ও বলা হয়। এর সম্বন্ধে কিছু তথ্য আমরা
ইতিমধ্যেই জেনেছি।এই টেলিস্কোপটি এই মুহূর্তে স্থাপিত হয়েছে মহাকাশের ১৫ লক্ষ
কিলোমিটার দূরে-যার নাম L-2 পয়েন্ট-যেখানে সূর্য,চন্দ্র,পৃথিবীর
মাধ্যাকর্ষণ আর ‘ওয়েব’ এর গতির শক্তির একত্রিত ফল কাটাকুটি হয়ে যায়। সেখান থেকে
‘জেমস ওয়েব’ এর চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রথম সময় তাকে দেখতে
কেমন ছিল আর জানতে পারা যাবে তারামণ্ডল,গ্রহ,নক্ষত্র ও
উপ-গ্রহাদি কেমন করে সৃষ্টি হয়েছিল। এই রেডিও টেলিস্কোপটি মানুষের তৈরি এক
যুগান্তকারী যন্ত্র।শুনে আনন্দ পাবেন যে ‘ওয়েব’ তার কাজ শুরু করে দিয়েছে এবং
অসাধারণ এখন পর্যন্ত অজানা তথ্য পাঠাতে শুরু করে দিয়েছে।
ক্রমশ ………………………………
২য় পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার (২১.০৮.২০২২)
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।