১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
২য় পর্ব শুরু
সেই
থেকে তারি সত্যদের বাড়ীতে আছে । ওকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খেতে দেওয়া হল । শোবার
বিছানা দেওয়া হল । কদিন শুধু খেল আর ঘুমাল । বটেশ্বরবাবু ও তাঁর স্ত্রী তারি-কে খুবই
স্নেহ করেন , ভাবেন এসে যখন পড়েছে তাঁদের হাতে জ্ঞানতঃ কষ্ট দেবেন না মেয়েটাকে ।
তারি এখন সাত বছরের চিকন কালো এক মেয়ে , গায়ের কালো রঙের চাইতেও কালো চোখের তারা
আর একপিঠ কালো চুল । চেহারায় শীর্ণতার ভাব আর নেই তবু হালকা পাতলা চেহারা । স্বভাবটাও
ভালো । যে যা বলে তাই করে , খুব বাধ্য । একদিন ভোরবেলায় মা উঠেছেন , বাইরে উঠোনের
ধারে দেখেন তারি শুকতারাকে প্রণাম করছে । মা'র প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল বাপের কাছে শুনেছিল
ওর জন্মের সময়ে ওই তারাটা নাকি জ্বলজ্বল করছিল সারা আকাশে একাই , তাই ওর বাবা ওর নাম
রাখে তারা । শুনে মা বলেন , ' বাঃ , বেশ সুন্দর নাম তো তোর। আমরা তো তোর বলা তারি নামেই
ডাকি, কখনও ভেবে দেখিনি এর মানে । সত্যকে বলে দেব , স্কুলের খাতায় তোর এই ‘ তারা
’ নামটাই যেন লেখে ।
সেই
শুরু । তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি পেছনদিকে । আজ চোদ্দ বছরের তারি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী
। প্রথমদিকে একটু পিছনেই ছিল , তারপর ক্রমশ উন্নতির দিকে । খুব ভালভাবেই ও অষ্টম শ্রেণীতে
উত্তীর্ণ হয়েছে ।
(৩)
ইতিমধ্যে
খুব ধুমধাম করেই বড়ছেলে সত্যগোপালের বিয়ে হয়েছে ঝাড়গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ মেয়ে
রুপসীর সঙ্গে । ওরা পাঁচভাই এক বোন । সার্থক নাম রূপসীর – দেখতে সত্যিই খুব সুন্দর।
সোনাদি কলেজে ভর্তি হয়েছে । বাড়ীতে আনন্দের হাট । ছোড়দারও বিয়ের চেষ্টা হচ্ছে ।
সোনামনি বলে দিয়েছে ও এম.এ পড়বে, তবে বিয়ে । বাবা - মা একমাত্র মেয়ের আবদার মেনে
নিয়েছেন – ওঁদের ইচ্ছা ছিল ছেলেরা স্বেচ্ছায় যখন বেশি লেখাপড়া করল না তখন মেয়ে
যদ্দুর পড়ে পড়ুক । দিন পাল্টেছে । আজকাল মেয়েরাও লেখাপড়া শিখে ছেলেদের সাথে সমানে
পাল্লা দিচ্ছে । বটেশ্বর ঘাটার মানসিকতা যথেষ্ট আধুনিক । বাড়ীতে আনন্দের খামতি নেই
। বছর দুয়েকের মাথায় বটেশ্বরবাবু নাতির মুখ দেখলেন । কিন্তু সুখ বুঝি বেশিদিন সয়
না । নাতির মুখ দেখে আনন্দে ঝাড়গ্রাম থেকে ফিরে এসেছেন , বৌমা মাস তিনেক পরেই ফিরবে
। কিন্তু খবর আনল সত্য যে রূপসী খুব অসুস্থ , ডাক্তার দেখানোতে কোন গাফিলতি নেই , কিন্তু
অসুখটা থামছে না । কোন খাবারই হজম হয় না , সুতিকা রোগে ধরেছে । দুই বাড়ীর সবাই চিন্তিত
। ছয় মাস রোগের সাথে যুদ্ধ করে এখন খানিকটা ভাল হওয়ায় বৌমাকে আনা হল বাড়ীতে । ছয়মাসের
নাতিকে নিয়ে সবাই খুশি । বৌ বিশ্রামেই থাকে , বিছানাতেই থাকে সারাক্ষণ । শাশুড়ী অনেকবার
বলেছেন বাড়ীর মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে । কিন্তু রুপসী সেকথায় কান দেয় না । ও চায় ভাক্তার
বদ্যি এবং ওষুধবিসুখ নিয়ে , তাকে নিয়ে বাড়ীর সবাই যেন ব্যস্ত থাকুক । ফলে যা হবার
তাই হল । বছর ঘুরতে না ঘুরতে বৌ পাকাপাকি বিছানাতেই আশ্রয় নিল । নিত্যই তার কোন না
কোন ব্যাধি লেগেই আছে । বড়দার মন ভাল নেই । কিন্তু বাড়ী এসেই ছেলেকে নিয়ে খুব মাতামাতি
করে । বাচ্চা পড়ে গেছে কিনা , কান্নাকাটি করছে কিনা , সময়মত খাওয়ানো হয়েছে কিনা,
তারিকে আর সোনাকে প্রশ্ন করে করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে । তারি বড়দার ব্যাকুলতা দেখে
নিজের শৈশবের কথা ভাবে । শৈশবের যেটুকু স্মৃতি তা সবই ক্ষুধার সাথে মরণপণ সংগ্রাম
, ক্লান্ত রুগ্ন শীতার্ত বাপের করুণ কাতরানি তার মনটাকে ব্যথায় ভারাতুর করে তোলে ।
এদের কাছে শুনেছে মানুষ মরণের পর স্বর্গে যায়, তারি তাই তার স্বর্গত বাপ - মায়ের
, যে মাকে সে দেখেইনি , তাদের শান্তি কামনা করে ভোরের তারাকে নমস্কার জানায় । এখন
তারির জীবন সুখস্বপ্নে ভরপুর । ওর স্বপ্ন, ও স্কুলের পড়া সবটাই পড়বে। সে কি কম কথা
। মা বলেছে তারপর দেখেশুনে ওদের জাতের কারুর সঙ্গে তারির বিয়ে দিয়ে দেবে । তারির
জগতে তাই আর ক্ষুধা নেই । কিন্তু কপালের লিখন খণ্ডাবে কে ? গরমকালে সোনাদির ঘরের সামনে
গ্রিল ঘেরা বারান্দায় ছোট একটা চৌকিতে তারি শোয় , পাশেই একটা জলচৌকিতে তারির বইখাতা
থাকে । সেদিন রাতে তারি ঘুমে ডুবে আছে এমন সময় কার একটা হাত আচমকা তার মুখ চেপে ধরে
আর একটা হাত পাগলের মত তার সর্বাঙ্গে তোলপাড় করছে । কানের কাছে মুখ বলছে , ‘ লক্ষ্মী
তারি চেঁচাস না , দে দে আমাকে দে , তোকে আমি খুব ভালবাসি । ' বড়দা । আতঙ্কে তারি দু'হাত
ঠেলে উঠে বসেছে , ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে ‘ না বড়দা না , তুমি ঘরে যাও নইলে আমি চেঁচাব
। ' বড়দা ছেড়ে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে , ‘ পড়েছিলি পথে , মরছিলি , তুলে না আনলে কি
গতি হতো তোর ? দূর করে দেব, যদি আমার কথা না শুনিস । একটা দিন সময় দিলাম । কাল আবার
আসব, কাউকে বললে গলা টিপে মেরে ফেলব ।'- বলতে বলতে বড়দা নিজের ঘরের দিকে চলে গেল ।
তারি হতভম্ব । কি করবে, কি করা উচিৎ – সোনাদিকে ডেকে বলবে না মা - র কাছে যাবে? কোনোটাই
তারি করতে পারল না, তার দু'চোখ দিয়ে বহুদিন পরে নিঃশব্দে জলের ধারা বয়ে যেতে লাগল
। এ কোন্ বিপদ তার জীবনে এল, এও এক ক্ষুধা, তারি বয়সের সাথে সাথে কিছু বুঝেছে, আর
বাকীটা বুঝেছে বান্ধবীর কাছ থেকে । তার সহপাঠিনীদের অনেকেরই ছেলেবন্ধু আছে, তাদের সাথে
তারা ছুটির পর এ - গলি সে - গলি ঘুরে গল্প করে, তারপর বাড়ী যায়। নানান রকম সিনেমা
ও টিভি সিরিয়ালেও সে এই ক্ষুধার কথা দেখেছে । তারি নিজের জীবনের জন্য এই ধরণের কোন
চিন্তাকেই ঠাঁই দেয় না । তার মনে একটাই চিন্তা মন দিয়ে পড়াশুনা করা , মা তার জন্য
যা করার করবেন । তাছাড়া সোনাদির কাছে সে অনেক কথা শুনেছে । পৃথিবীটা বিশাল এবং উপযুক্তভাবে
নিজেকে শিক্ষিত করলে সব মানুষের কাছেই বিশাল পৃথিবীর দরজা খুলে যায় । তবে বেশি বড়
স্বপ্ন তারি দ্যাখে না , সামনের বর্তমানটাই তার কাছে বড় । আজ এ কোন্ সর্বনাশের মুখের
সামনে তারি পড়ল । যদি সত্যিই সে সোনাদিকে বা মাকে সব বলে তাহলে তারা কি তাকে বিশ্বাস
করবে ? যদি তারিকে ভুল বোঝে? এই ভাবতে ভাবতেই দিনটা কেটে গেল । কোন কিছুতেই সে মন বসাতে
পারল না । স্কুলেও ছিল আনমনা , বান্ধবীরা অনেক চেপেও কিছুই বার করতে পারল না তারির
কাছ থেকে । শেষে রাত ঘনিয়ে এল , তারি অনেক ভেবে ঠিক করল সোনাদি ঘুমিয়ে পড়লে ওর খাটের
তলায় লুকিয়ে শুয়ে যাবে , সোনাদি তারির জন্য ঘরের দরজা খুলেই শোয় কারণ শীতকালটা
তারি সোনাদির ঘরের মেঝেতেই শোয় । মধ্যরাতে তারি টের পেল বড়দার নিষ্ফল অভিসার । পরপর
সাতদিন গেল এভাবে। সেদিন আর এড়াতে পারল না তারি । সন্ধে দিতে তিনতলায় যাবার সিঁড়ির
বাঁকে বড়দা সাঁড়াশির মতো দেওয়ালের সাথে তারিকে চেপে ধরল । বাঘের মত বড়দার চোখদুটো
ধধক্ করতে লাগল। ‘সোনার ঘরে লুকিয়ে ক'দিন কাটাবি ? স্কুল থেকে তোকে তুলে নিয়ে যাব
, বাজারে একটা ঘর ঠিক করেছি । তোকে সেখানেই রাখব , রাণীর হালে থাকবি । তুই ছোটোলোকের
মেয়ে লেখাপড়া শিখে লাট - বেলাট হবি নাকি । ভয় পাস্ না । তুই আমার কাছে থাকবি কেউ
জানতে পারবে না । লোক দেখানো অনেক খুঁজব তোকে , আর কাকে কি বলতে হবে তা তোর ভাবতে হবে
না । তৈরি থাকবি । কাল স্কুল থেকে ফেরার সময় তুই আমার সাথে যাবি । রাস্তায় কোনো ঝামেলা
করবি না । মনে থাকে যেন ।
ক্রমশ
…………………
৩য়
পর্ব পড়ুন আগামী কাল
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।