Advt

Advt

Khudha, Story / Galpo, 1st Part, by Juthika Chakraborty, Tatkhanik digital bangla/ bengali online e magazine, ক্ষুধা, গল্প, ১ম পর্ব

Khudha, Story / Galpo, 1st Part, by Juthika Chakraborty, Tatkhanik digital bangla/ bengali online e magazine, ক্ষুধা, গল্প, ১ম পর্ব



পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম । চাষবাস সামান্য হয় । ভিতরদিকে বনাঞ্চলে বাস করে দেহাতি লোকেরা। ঝুড়ি বোনা , কুলো ডালা তৈরি করা , শালপাতা সংগ্রহ , এতেই ওদের দিন চালাতে হয় । বছরের অর্ধেক দিন অর্ধাহারে , বাকি অর্ধ প্রায় অনাহারেই কাটে । ওরা জাতে নীচু, দলিত । ওদের এলাকায় নলকূপ নেই , প্রাইমারি স্কুল নেই , কাজ নেই । নেই - রাজ্যে ওরা বাস করে । এই নেই রাজ্যেই জন্ম তারার । সারাদিন শুকনো পাতা , কন্দমূল , পিপড়ের ডিম সংগ্রহ করে এনে কোনোমতে বৌ - এর সাহায্যে সেই কন্দ সেদ্ধ খেয়ে ঘুমিয়েছে পরাণচাষা । 

শেষরাত্রে বৌ - এর গোঙানি শুনে ঘুম ভেঙে যায় পরাণের । তবে কি সময় হয়েছে? কিন্তু এই শেষ রাত্রে প্রতিবেশীদের কাকেই বা ডাকে? দাইবুড়ি থাকে বনের শেষে প্রায় মাইলটাক দুরে । বৌ - কে বলে পরাণ বেরিয়ে গেল দাইবুড়ির খোঁজে । কম করে আস্ত আট - আনা না দিলে দাইবুড়ি আসতে তো চাইবেই না, কিন্তু বড় ওল-টা তো আস্ত আছে, দাইবুড়িকে না হয় সেটাই দেবে – এইসব ভাবতে ভাবতে পরাণ একসময় পৌঁছল দাইবুড়ির কুড়েতে । অনেক ডাকাডাকি করাতে দাইবুড়ি বাইরে এসে শুনল বাচ্চা বিয়োনোর ডাক এসেছে । বলল, ‘নগদ আট - আনা এনেছিস? আগে দে , তবে যাব । ' অনেক কাকুতি - মিনতি করে সদ্য তুলে আনা ওলের আকৃতি আর টাটকা লাল পিপড়ের ডিমের টোপ দেওয়াতে বুড়ির মন গলল , বলল , ' চল দেখি । ' দাইকে নিয়ে বনজঙ্গল মাড়িয়ে যখন নিজের পাতার কুটিরে পৌঁছল, তখন বৌ - এর গোঙানি কাতরানিতে পরিণত হয়েছে । আকাশের অন্ধকার তখনো কাটেনি । পরাণ কাঠকুটো জ্বেলে একমাত্র হাড়ি , ঘরে যেটা সব কাজেই লাগে , তাইতেই জল গরম বসিয়ে দিল । নিজে বাইরে বেরিয়ে এল । আড়াল তো একটু দিতেই হবে । অবশেষে নবজাতকের কান্নার স্বর ভেসে এল । আনন্দই হল পরাণের , আবার সঙ্গে সঙ্গে মনটাও খারাপ হয়ে গেল । একটা বাচ্চাকেও বাঁচাতে পারেনি পরাণ । চার চারটে ছেলে মেয়ে জন্মাল , মায়ের বুকে দু'একদিন ক’ফোঁটা দুধ পেল । তারপর দুধের অভাবে দুধের শিশু নেতিয়ে গেল । ঘরের সামনেই লাইন দিয়ে তাদের মাটির তলায় শুইয়ে রেখেছে । পরাণ দু'হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকাল , দেখতে পেল ভোরের একটিমাত্র তারা অন্ধকার আকাশের বুকে ধবধব করছে । কেঁদে কেঁদে পরাণ বলতে লাগল , ' হে বোঙ্গা বাবা , আমাকে একটা ছেইলা কি মেইয়া দ্যাও , বাঁচায়ে যেন রাখতে পারি । ' দু'হাতে যখন চোখ মুছতে ব্যস্ত পরাণ, তখন বুড়ি দাই ন্যাকড়ায় জড়িয়ে একটা শিশুকন্যা পরাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল , 'কোথাও থেকে দুধ জোগাড় করে তাতে জল মিশিয়ে পাতলা করে মেয়েকে খাওয়া । ও মা-কেই খেয়ে এসেছে । ' হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে নিতে গিয়ে পরাণের হাত থেমে গেল । বৌটাও মরে গেল । হায় হায় , এ দুঃখের ক্ষুধার জগতে একজন সঙ্গী ছিল , তাও গেল । বাচ্চাটাকে পরাণের হাতে গুঁজে দিতে দিতে বুড়ি বলল , 'আমাকে পিঁপড়ের ডিম দিতে হবে না , ওটাও তুই রাখ্‌ । মেয়েটাকে পিঁপড়ের ডিমের সেদ্ধ ঝোলই দিস্ । বাঁচলে বাঁচবে , গেলে যাবে , তবে মাকেই যখন খেয়ে এসেছে তখন বেঁচেও যেতে পারে । বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সকালের প্রতীক্ষায় পরাণ বসে থাকল রক্তমাখা মৃত বৌয়ের কাছে । ভাবছিল , বিবর্ণ বৌটার শরীরেও এত রক্ত ছিল।

(২)

পায়ের বিষাক্ত ক্ষতে পরাণও একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিল । শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিল তারা । চার বছরের তারা এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে গ্রামছাড়া হয়ে বছর পাঁচেক বয়সে শহরের বটেশ্বর ঘাটার বাড়িতে পৌঁছল তারি নামে । বটেশ্বর সম্পন্ন চাষী । দুই ছেলের পর এক মেয়ে – সত্যগোপাল , নিত্যগোপাল ও সরস্বতী । শহরে একটা মুদির দোকান থাকলেও চাষবাসই ওনার আসল কাজ । দুই ছেলে মাধ্যমিক পাশ করার পর বড় ছেলে বায়না ধরল একটা হিমঘর করার । অনেক বোঝানোর পর বাপ যখন বুঝল ভালই আয় হবে তখন আর আপত্তি করেননি । ছোট ছেলেও কিছুদিন পর বাবার সাহায্যে চালকল খুলল । দিন মন্দ চলে না। ছোট মেয়ে কিন্তু অন্যরকম , বলে দাদারা মুখ্যু হয়ে থাকলে কি হবে , আমি কিন্তু কলেজে পড়ব। ছোড়দা একটু গম্ভীর হলেও বড়দার সঙ্গে বোনের খুব ভাব । যত মনের কথা বড়দাকে বলা চাই – যাবতীয় বায়না বড়দার কাছেই । এরকমই গল্প - আড্ডার সময় হঠাৎ তারি বলে বসল , ' হ্যাঁ গো, বড়দা, মুকেও একটু পড়ালিখা শিখাও না । আমি তো দিদির বই থেকে কবে থেকেই অল্প অল্প পড়ি । শিখতেও পারি একটু একটু । বড়দার তো চক্ষু চড়কগাছ ! মাদুর পেতে বারান্দায় শুয়ে ছিল, সোজা উঠে বসল । বোন সোনাও বলে উঠল, ' হ্যাঁ গো দাদা তারি ভালই পড়তে পারে, লিখতেও পারে । পড়াও না ওকে । আজকাল জানো তো, স্কুলে আদিবাসী ও তফশিলি জাতি ও অনুন্নত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের জন্য সরকার থেকে আর্থিক সাহায্য দেয় প্রতি বছরে । বড়দা, সত্যগোপাল বলল , ' দাঁড়া দাঁড়া , তারি যে পড়তে পারে, লিখতে পারে সেটা শুনেই তো তাজ্জব হয়ে গেছি । বাড়িতে তো কাজের লোকের অভাব নেই , দুটো ডালভাতেরও অভাব হবে না । তারি, তোকে আর কোন কাজ করতে হবে না , কালই তোকে নিয়ে প্রাইমারী স্কুলে যাব । যে ক্লাসের উপযুক্ত সেই ক্লাসে ভর্তি করে দেব । ' তারি আনন্দে দিশাহারা হয়ে ছুটে চলে এল মায়ের কাছে, পিছন থেকে মা'র গলা জড়িয়ে ধরে বলল , ' বল তো আমার কি হবে ? ’ ‘ কি আবার হবে , দুটো শিং গজাবে কি মাথায় ? ' রুদ্ধশ্বাসে তারি বলল , ' আমি কাল স্কুলে ভর্তি হব মা , বড়দা আর সোনাদি বলেছে ।

' হ্যাঁ , ' মা ' । সোনামনি , বড়দা , ছোড়দার মতো তারিও ওদের মাঝে ‘ মা ’ বলে ডাকে । বাপের কাছে নিজের জন্মকাহিনী , ক্ষুধা আর কান্নার অনেক কথাই শুনেছে । জীবনের প্রথম চারটি বছর বাপের সাথে ক্ষুধার বিরুদ্ধে কি লড়াইটাই না লড়েছে ! বুনো ফল, ওল , কন্দ পিপড়ের ডিম সবই বাপের সাথে ভাগ করে খেয়েছে । কিন্তু তাতেও ওইটুকুনি একটা শিশুর পেটও ভরত না । রাতে শুয়ে নিঃশব্দে কাঁদত । এ নিদারুণ রুক্ষ পৃথিবী কি ওই ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না শুনতে পেত ? হয়ত পেত । তাই যেদিন বাপটাকে সবাই শ্মশানে নিয়ে গেল, প্রায় উলঙ্গ একটা শিশুকন্যা যখন আকুল হয়ে পথের ধারে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল, তখন সাইকেল চেপে সত্যগোপাল চাষী লোক যোগাড়ের জন্য গ্রামের দিকে এসেছিল । বাচ্চাটাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে সাইকেল থামিয়ে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, ' এ্যাই মেয়ে তুই কাঁদছিস কেন? বাড়ী হারিয়ে ফেলেছিস? তোর বাবার নাম বল, দিয়ে আসব তোদের বাড়ী খুঁজে।’ তারি আবার নতুন করে রুগ্ন শীর্ণ শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাহাকার করে কেঁদে উঠল । অবশেষে কান্নার দমক কমলে আস্তে আস্তে বলল সব কথা । আজ দু’দিন ও কিছু খেতে পায়নি, পায়ের ঘা পচে একমাত্র সম্বল বাপটাও আজ মরে গেল । এখন একা একা ও কি করবে? সত্যগোপাল সব শুনে বলল, ‘ গ্রামের কোন বাড়ীতে নিয়ে গেলে থাকতে দেবে তোকে , সেরকম বাড়ী থাকলে বল্ আমি রেখে আসব । ’ তারি চোখ মুছে মাথা নেড়ে ‘ না ’ বলে কাঁদতে লাগল । সত্য বলল , ' তাহলে চল আমাদের বাড়ী । শহরে । মা - বাবা ভাইবোন সবাই তোকে ভালবাসবে , খেতে দেবে , তোর কোন কাজ করতে হবে না । অপরাহ্নের ম্লান আলোর দিকে তাকিয়ে আসন্ন অন্ধ রাত্রির কথা ভেবে তারি সাইকেলের পেছনে উঠে বসল , শক্ত হাতে ধরে থাকল সাইকেলের পিছনটাকে , জীবনের এই শেষ আশ্বাস আর হারাতে চায় না বলে ।

 

ক্রমশ …………………

২য় পর্ব পড়ুন আগামী কাল

লেখিকার পরিচিতি 

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।