Advt

Advt

Bodhoday, Story / Galpo, 1st Part, by Nityaranjan Debnath, Tatkhanik digital bengali online e magazine, বোধোদয়, গল্প

Bodhoday, Story / Galpo, 1st Part, by Nityaranjan Debnath, Tatkhanik digital bengali online e magazine, বোধোদয়, গল্প

 

সনাতন দাশ। অফিসের গ্রুপ ডি পোস্টে চাকরি করে। পদমর্যাদার দিক থেকে একেবারে শেষ ধাপ বলা যায়। অর্থাৎ খুবই নীচু পোস্ট। অবশ্য তাতে তার দুঃখ নেই। লেখাপড়া করেনি, দুঃখ করে করবেটা কি? এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে যে একটা সরকারি চাকরি করছে, এটাই তার কাছে অনেক। ক্লাস সেভেনে উঠে আর স্কুলমুখী হয়নি। সাত ক্লাস বিদ্যে দিয়ে সে বউ, বাচ্চা নিয়ে দুটো ডালভাত খেতে পারছে, এটাই তার কাছে, সাত জন্মের ভাগ্য। এতে তার আফশোষ নেই। তবে দুঃখ একটা আছে। অন্তরের ব্যথা কাউকে বলতেও পারে না। মাঝেমধ্যে নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হয়। অফিসে ওর ফাইল দেওয়া - নেওয়া কাজ। কখনো সখনো সাহেবদের জল, চা - টাও এনে দিতে হয়। এতে তার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু কিছু স্টাফ আছে, সবে দু'তিন বছর চাকরি হয়েছে, বলতে গেলে সনাতনের ছেলের বয়সি, তারা তাকে অবলীলায় নাম ধরে ডাকে— এ্যাই সনাতন, ঐ ফাইলটা দাও। কেউ কেউ আবার তুই - তোকারিও করে। তখনই বুকে ছ্যাঁৎ করে লাগে। 

ত্রিশ বছরের উপর চাকরি হয়ে গেল। আর তিন বছর বাদে অবসর নেবে। এখনও যদি ছোকরা কেরানিবাবুরা নাম ধরে ডাকে, ভালো লাগে? আগে এমনটা ছিল না। সবাই সম্মান দিয়ে কথা বলত। বড়দের আলাদা কথা, কিন্তু বয়সে ছোট হলেও সবাই দাদা বলেই ডাকতো, সনাতনদা। ইদানীং দু - তিন বছর হলো যে ছেলেগুলো চাকরিতে ঢুকেছে, তাদের ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। তুইতোকারি করে নাম ধরে ডাকবে। সম্মান দেওয়া দূরে থাক, মানুষ বলেই গণ্য করে না। একবার সনাতনও উচিত শিক্ষা দিয়ে ছেড়েছে। যে যেমন, তার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করাই দরকার । অনীকবাবু। বছর দুই আগে চাকরিতে ঢুকেছে। চব্বিশ - পঁচিশ বছর বয়স হবে। কথায় কথায়— এ্যাই সনাতন, ঐ ফাইলটা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। আগে ফাইলটা দিয়ে যা, তারপর অন্য কাজ করবি। সহবত বলে কিছু শেখায়নি বাবা, মা। কী আর বলবে। সনাতনও তক্কে তক্কে ছিল। সুযোগটা একদিন এসে গেল। সাহেব অনীকবাবুকে তলব করেছে। সনাতন গিয়ে বলল, এ্যাই অনীক, তোকে বড়সাহেব ডাকছে, তাড়াতাড়ি যা। অনীকবাবু অবাক। সনাতন ওকে নাম ধরে ডাকছে! তার উপর আবার তুই তোকারি করে কথা! এত বড় সাহস !

কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে সাহেবের ঘরে ঢুকে গেল। ভাবখানা এমন, তোমার হচ্ছে। আগে ঘুরে আসি সাহেবের ঘর থেকে। সনাতনও তার জন্য প্রস্তুত। ও - ও আজ ছেড়ে কথা কইবে না। যা হওয়ার হবে, অন্যায় তো বলছে না। ওরও অভিজ্ঞতাও কম নেই। চাকরি করতে করতে বুড়ো হয়ে গেল। দশ মিনিট পরেই অনীকবাবু সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখেই বোঝা যায়, রাগে ফুঁসছে। সনাতন তখন বড়বাবুর টেবিলের পাশে একটি বেঞ্চেতে বসে। মন শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। যেন কিছুই হয়নি। অনীক চেয়ারে বসেই চেঁচিয়ে উঠল, এ্যাই সনাতন, এদিকে আয়। সনাতন শুনতে পায়নি এমন ভাব করে বড়বাবুর সঙ্গে মামুলি কথা কইছে। এদিকে সনাতনের কোন হেলদোল নেই দেখে অনীক ক্ষেপে আগুন। ওকে ডাকছে , তবু সে না শোনার ভান করে খেজুড়ে গপ্পো করে যাচ্ছে। বড়বাবুর মত লোকগুলো এদের আস্কারা দিয়ে দিয়ে এমন মাথায় তুলেছে। কাকে কী বলবে? একটা গ্রুপ ডি কর্মচারির সঙ্গে এমনভাবে কেউ গপ্পো করে? গলার স্বর দ্বিগুণ বাড়িয়ে আবার চিৎকার করল, এ্যাই সনাতন, তোকে যে ডাকছি শুনতে পাশ না নাকি?

সনাতন বলল, ওরে তুই যে ডেকেছিস, শুনতে পেয়েছি । বড়বাবুর সঙ্গে দুটো জরুরি কথা কইছি। কথাটা শেষ করেই যাচ্ছি। অনীক আর চেয়ারে বসে থাকতে পারল না। তার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। চেয়ার থেকে উঠে একেবারে বড়বাবুর সম্মুখে এসে দাঁড়াল।

— এসব কী হচ্ছে বড়বাবু ? একটা ফোর্থ ক্লাস গ্রুপ ডি কর্মচারী আমাকে নাম ধরে ডাকছে? এত সাহস পায় কোথা থেকে? তার উপর আবার তুই - তোকারি করে কথা বলছে? আপনাদের জন্যই এরা এত মাথায় উঠে গেছে।

বড়বাবু হতবাক। এর মধ্যে কী হলো আবার?

সনাতন বলল, তুই যেমন আমাকে নাম ধরে ডাকিস, আমিও তেমনি তোকে নাম ধরে ডাকছি। এতে অসুবিধের কী হলো?

- দেখেছেন বড়বাবু? চোখের সামনে দেখলেন তো?

- অসুবিধে কি হলো,

-তোর মাথায় ঢুকবে নারে গর্দভ। এই জন্যই তো তুই গ্রুপ ডি। স্ট্যাটাস সম্বন্ধে তোর কোনও জ্ঞান আছে যে বুঝবি?

সনাতন বলল, তুই তো লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। ফোর্থ গ্রেড ক্লার্ক। আর আমি হলাম গিয়ে সিনিয়র গ্রেড ওয়ান গ্রুপ ডি। আর বয়সেও তোর বাপের থেকে বড় হবো। তুই যদি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারিস, আমি ডাকতে পারবো না! আমি ডাকলেই অপরাধ?

ব্যাপারটা এতক্ষণে বড়বাবুর বোধগম্য হলো। সত্যিই তো, সনাতনের মত একজন বয়স্ক মানুষকে একটা বাচ্চা ছেলে যদি নাম ধরে ডাকে, মেনে নেওয়া কষ্টকর।

অনীক বলল, দেখেছেন? দেখেছেন বড়বাবু, আপনার মুখের সামনে কথা কইছে?

বড়বাবু বললেন, শান্ত হও অনীক। হঠাৎ কী হলো, আমি সনাতনের সঙ্গে আলোচনা করে বলবো।

অনীক বলল, সনাতনের সঙ্গে আবার কী আলোচনা? ব্যাপারটা আপনাকে আজই ফয়সালা করতে হবে। না হলে আমি ছাড়বো না বলে দিলাম। ইতিমধ্যে সেকসানের প্রায় সকল স্টাফ বড়বাবুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। ব্যাপারটা অনেকে বেশ উপভোগও করছেন। তবে দুটো শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মতবাদ দুটো। এক শ্রেণী ভাবছেন, সনাতন ঠিক কাজ করেছে। নতুন ছোকরাগুলোকে মোক্ষম দিয়েছে। আর , নিজে সম্মান দিলে তবে তো সম্মান পাবি। যারা বড় - ছোট মান্যগণ্য করে না , তারা আবার নিজের সম্মান আশা করে কী করে? ফুঁকফাক অনবরত বিড়ি - সিগারেট টেনে যাবে, পাশের চেয়ারের ভদ্রলোকের যে অসুবিধা হচ্ছে, কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সিনিয়ার আপার ডিভিশান ক্লার্ক, তার থেকে বয়সে কত বড়, বার বার মানা করা সত্ত্বেও গ্রাহ্যই করে না। ঠিক কাজ করেছে সনাতন।

আরেক শ্রেণী আছে , তারা অনীকের দলে। বিশেষ করে যে - সব ছেলেছোকরারা চাকরিতে নবাগত। অবশ্য সবাই নয়, দু - চারজন নবাগতর মধ্যেও কয়েকজন আছে নম্র, ভদ্র। তারা বরাবর সনাতনদা বলেই ডাকে। নাম ধরে ডাকার কথা ভাবতেই পারে না। অফিসের অন্যান্যদেরও সম্মান দিয়ে কথা বলে। আশেপাশে বড়বাবুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। কিন্তু কারো মুখে টু শব্দটি নেই। প্রকাশ্যে কেউ কারো পক্ষ নিয়ে কথা বলার অসুবিধা আছে। সরকারি অফিস তো, যা কলকাঠি নাড়ে গোপনে, আড়াল – আবডালে-এ - ওর নামে কুৎসা করার লোকের অভাব নেই। সামনে স্পিকটি নট। তবে বেশির ভাগই সনাতনের পক্ষে। এর মধ্যে নাবগতদের থেকে একজন বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ বড়বাবু , এর একটা বিহিত করা দরকার। অফিসের একটা ডেকোরাম আছে, ডিসিপ্লিন বলে একটা ব্যাপার আছে। একজন গ্রুপ ডি কর্মচারী যদি এমন ব্যবহার করে, তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত। আপনার ইমিডিয়েট ড্রাস্টিক এ্যাকশান নেওয়া দরকার, না হলে এরা মাথায় উঠে যাচ্ছে।

একজন সিনিয়র স্টাফ বলে উঠলেন, আগে দেখতে হবে অন্যায়টা কে করেছে? তারপর শাস্তির কথা ভাবতে হবে। আরেকজন বলল, সরকারি কন্ডাক্ট রুলে যে শাস্তির বিধান দেওয়া আছে, তাই হবে। প্রয়োজনে চাকরি থেকে বরখাস্তও হয়ে যেতে পারে। বড়বাবু বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাঁর বিচারের অপেক্ষায় সকলে প্রতীক্ষারত। বিচার যথাযথ হওয়া দরকার ।

বড়বাবু ভাবছেন, সরকারি অফিস। তিনি কেন ঝামেলায় যাবেন? অফিসের টপ বস যিনি আছেন, তিনিই যা করার করবেন। বড়বাবু বললেন, অনীক, তুমি একটা লিখিত দাও। লিখিত না পেলে আমি কোন পদক্ষেপ নিতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ , লিখিত দরকার। অফিসিয়াল রেকর্ড না থাকলে কিছু করা যায় না। অনীক খসখস করে সনাতনের বিরুদ্ধে দেড় পাতা লিখে ফেলল। হেড অফ অফিসকে এ্যাডড্রেস করে জমা দিয়ে দিল। বড়বাবু এবার নিশ্চিন্ত। লেখাটা দেখে একটা সই করে, বড়সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। যা করার তিনিই করবেন ।

ক্রমশ ………………

আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন ।

লেখক পরিচিতি: 

জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।

তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট,  দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর  ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।

তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। 

Tatkhanik digital bengali online e magazine


Bodhoday, Story / Galpo, 1st Part, by Nityaranjan Debnath, Tatkhanik digital bengali online e magazine, বোধোদয়, গল্প