মনিষা কর বাগচীর
দু’টি গল্প
ভালো
থেকো তৃষা, তৃষা আজ তোমার কথা খুব মনে পড়ছে জানো? সকাল থেকে কোনো কাজেই মন লাগছে না,
খুউউউব কষ্ট । সে তুমি বুঝবে না । আর আমি চাইও না যে সেটা তুমি বোঝো ৷ ‘তুমি ভাল থেকো
৷ আর ভালো থাকবেই বা না কেন? তোমার তো এখন বড় একটা চাকরি আছে ৷ সন্তান আছে ৷ বড়লোক
স্বামী আছে ৷ তোমার নতুন স্বামী তোমাকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে । আমি চাই, সে তোমাকে
আমার থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসুক । আজ আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে ৷ এখনি বোধ হয় ঝরবে অঝোর
ধারা ৷ আজ বোধহয় প্রকৃতিও আমার দুঃখে দুঃখি হয়েছে সেও আজ চোখের জল ফেলতে চায় আমার
সাথে । তোমার কি মনে আছে এমন মেঘলা আকাশ আমার মোটেও ভালো লাগে না । মন কেমন করে । তুমি
হয়ত অনেক কথাই তুলে গেছ ৷ ভালো ৷ যে যত ভুলে যেতে পারে সে তত ভালো থাকে ৷ আমি ভুলতে
পারি না বলেই আমার এত কষ্ট, যন্ত্রণা ।
আজ
খুব মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা যেদিন দাদা তোমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেল ৷ তোমার সেকি
বুকফাটা আর্তনাদ । এখনও পর্যন্ত আমার কানে বাজে ৷ বিয়ের মাত্র আঠাশ দিন পর সে তোমাকে
একা ফেলে চলে গেল চিরতরে । দাদার মৃত্যুকে তুমি মেনে নিতে পারছিলেনা। প্রায় উন্মাদ
তুমি ৷ তোমার ( কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না ... যাই হোক কিছু দিন পর এক শুভ সংবাদ
পেলাম ৷ জানতে পারলাম তুমি মা হতে চলেছ । তোমার প্রেগনেন্ট হওয়ার খবর পেয়ে বাড়ির
সবাই টেনশনে পড়ে গেল ৷ সবাই তোমার বাচ্চাটাকে একটা বাড়তি ঝামেলা মনে করতে লাগল ৷
দাদার এই অকস্মাৎ মৃত্যুর জন্য ওরা তোমাকেই দায়ী করত ৷ তাই তখন কেউ তোমার দায়িত্বই নিতে চায়নি, তারপর আবার
তোমার বাচ্চা ... তোমার ওপর শুরু হল নানারকম অত্যাচার । আমি সহ্য করতে না পেরে একদিন
সবার সামনে দিলাম তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে । তোমার সুখের জন্য পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে
গিয়ে এই দুঃসাহসিক কাজটি আমি করে ফেলেছিলাম । বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হল
৷ মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিয়ে করে বৌকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে
। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কুলীগিরি থেকে শুরু করে হোটেলে বয়ের কাজ পর্যন্ত করেছি
। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হয়েছিল কিন্তু পরে সব ঠিক হয়ে
যায় । তুমি জন্ম দিলে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের ৷ তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সব
কষ্ট ভুলে গেলাম ৷ তাকে নিয়েই শুরু হত আমার দিন , শেষ হত আমার রাত ৷ কি সুখের ছিল
আমাদের সংসার । আমাদের সুখে ফুটত ফুল ডালে ডালে , গাইত পাখি , নদী বইত কুলু কুলু রবে
। দেখতে দেখতে সময় কোথা দিয়ে চলে গেল বুঝতেই পারিনি। তুমি আবার পড়াশোনা শুরু করলে
। একদিন W.B.C.S.
পাশ করে গেলে । আমার পরিশ্রম সফল হল । আমি আর একবার আনন্দে আত্মহারা হলাম ৷ অনেক বড়
চাকরি পেলে ৷ মেয়ে বড় হতে লাগলো । জীবনের প্রত্যেক পরীক্ষায় সে টপ করতে লাগল ৷ তাঁর
মুখের দিকে তাকিয়েই আমি আর দ্বিতীয় বেবির কথা ভাবিনি । ভেবেছিলাম আর একটা বাচ্চা
হলে আমার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা কম হয়ে যেতে পারে তাই .. … . এত সুখ আমার কপালে সইলোনা তৃষা ৷
সময়ের
সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে গেল ৷ পজিশনের সাথে সাথে তোমার রুচিও পাল্টে গেল। তোমার নতুন
বন্ধু এল তোমার জীবনে । সে তোমার বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে গেল একদিন ৷ বলো - ‘আমি সেটা
কি করে সহ্য করি? তবুও আমি মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম । ভেবেছিলাম মানুষের ভুল
হতেই পারে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ।
কিন্তু
কিছুই আর ঠিক হল না। ১৪ বছরের বিবাহিত জীবন ফেলে, আমার বেঁচে থাকার আশা, আমার একমাত্র
মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে, তুমি আমায় একা ফেলে চলে গেলে! আমি তোমাকে ও বাধা দিই নি ।
কারণ আমি তো চিরকাল তোমার সুখই চেয়েছিলাম এবং এখনও চাই তুমি সুখে থাকো ৷ দিন শেষে
রাত হয় রাত শেষে ভোর ... আমি অপেক্ষায় আছি কোনোদিন আমার রাত্রি শেষ হয়ে ভোরের সোনালী
সূর্যটা দেখতে পাবো। কোনদিন সেই সূর্যটা আমাদের জন্যে বয়ে আনবে একটা সবুজ সকাল ৷ সেই
সকালে আমার সাধিত রাজার ধন এক মানিক আমার মেয়ে পাশে থাকবে। সেই দিন পরম নিশ্চিন্তে
আমার আদরের মেয়ে তিন্নী-মার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমোবো। সেটা যদি নাও হয়
দুঃখ নেই ৷ তুমি শুধু আমার একটা কথা রেখো প্লিজ। আমার মৃত্যু সংবাদ পেলে ওকে নিয়ে
একবার এসো ৷ সম্ভব হলে আমার মুখাগ্লিটা যেন আমার মেয়েই করে ৷
ইতি- পথ ভোলা এক পথিক ।
*******************************************
মাম্পির
মা সুমনার খুব কষ্ট । পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে ঈশ্বর তাকে এখনও একটা সন্তান
দিলেন না । ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে সেই থেকে নীরবে সারাদিন সংসারের কাজ করে চলেছে
। কাজ করতে যতনা কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় ছেলে মেয়ে হয় না বলে যখন কেউ তাকে
খোঁটা দেয় । নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলা ছাড়া তার যে আর কোনো কিছুই করার থাকে না
। কোন্ মেয়ে না চায় যে তার কোল জুড়ে ছোট্ট একটা টুকটুকে বাচ্চা আসুক । প্রত্যেকটি
মেয়ে বিয়ের পর একটাই স্বপ্ন দেখে তার ভালোবাসার ধন, তার চির আকাঙ্ক্ষিত , তার মানিক
রতন কবে আসবে তার কোলে । কিন্তু বাড়ির লোকে কেউ সেটা বোঝে না । বোঝার চেষ্টাও করেনা
। বিশেষ করে সুমনার শ্বাশুড়ি, উনি তো ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু
করে দিয়েছেন । সুমনার বাবা খুব গরিব । ছোট বেলায় সুমনার মা মারা গেছেন । সে যে বাপের
বাড়িতে ফিরে যাবে সে পরিস্থিতিও তার নেই । তার স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন
তার কি হবে এই কথা ভাবলে আতঙ্কে তার হাতে পায়ে জোর থাকেনা । তাই দিনরাত সে ভগবানের
কাছে কাঁদে " হে প্রভু একটা সন্তান তুমি আমাকে দাও তোমার কাছে আর আমি কিচ্ছু চাইব
না কোনোদিন " ।
সুমনার
কাতর প্রার্থণা হয়ত ঈশ্বর শুনেছিলেন । একদিন সে বুঝতে পারল সে মা হতে চলেছে । তার
আর খুশির ঠিকানা রইল না । দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল । শেষ পর্যন্ত সুমনার জীবনে সেই
চির আকাঙ্ক্ষিত দিনটি এল । দুদিন, দুরাত মৃত্যুকে নিজের চোখে দেখল সুমনা । বারবার সে
অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল । সবাই বলছিল এ আর বাঁচবে না । গ্রামের ডাক্তার কিছুই করতে পারলেন
না । সবাই আশা ছেড়ে দিল । কিন্তু সুমনা আশা ছাড়েনি । মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে
সে । সন্তানের মুখ না দেখে সে যে মরতে পারবে না । তাই অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে সে জন্মদিল
এক কন্যা সন্তানের । জন্মের পর বাচ্চা কাঁদলোনা সবাই বলল মৃত সন্তানের জন্ম হয়েছে
। কিন্তু সুমনা বিশ্বাস করেনি সে কথা । ভগবান এতবড় অন্যায় করতে পারে না তার সাথে
। তার মনে এই বিশ্বাস ছিল । সে আর্ধেক অজ্ঞানতার মধ্যেই বাচ্চাটাকে কোলে টেনে নিয়ে
আদর করতে লাগল । মায়ের স্পর্শ পেয়ে যেন প্রাণহীন বাচ্চার ভিতরে প্রাণ ফিরে এল । একটু
পরে বাচ্চাটা কেঁদে ওঠল । সে যাত্রায় মা মেয়ে দুজনেই বেঁচে গেল । পাড়ার লোকেরা বলল,
মেয়ের জাত-তো তাই মরা বাচ্চা বেঁচে গেছে, ছেলে হলে বাঁচত না ।
যে
যাই বলুক না কেন মা তো হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছে । তার আনন্দ আর ধরে না । কিন্তু সমস্যা
হয়েছে মেয়ের বাবাকে নিয়ে এতদিন বলত বাচ্চা কেন হয় না, এখন বলছে মেয়ে কেন হল ।
মেয়ে হয়েছে বলে বাচ্চাটাকে বাবা ছুঁয়েও দেখে না । মায়ের মনে খুব কষ্ট, সে অনেক
চেষ্টা করেছে যে মেয়েটিকে তার বাবা কোলে তুলে নিক একবার তাকে দেখুক । মেয়ে তো নয়
যেন চাঁদের টুকরো । পুরো গ্রাম মেয়ের রূপের চর্চা করছে। তাতে কি হবে তার বাবাই যদি
তাকে না দেখে । সুমনার মনের কষ্ট মনেই রইল । তবে একটা দিকে সুমনার খুব আনন্দ যে তার
শ্বাশুড়ি এই নিয়ে কোনোদিন তাকে কিছু বলেনি ছেলে হোক মেয়ে হোক তাতে কি বৌমার একটা
বাচ্চা হয়েছে এই তো অনেক । মাম্পিকে কোলে করে তার ঠাম্মা নিজেকে মহারানী মনে করত ।
মনে মনে ভাবত তার রাজকুমারীর মত সুন্দর বাচ্চা পৃথিবীতে আর নেই । সংসারের সমস্ত কাজ
কর্ম ছেড়ে দিয়ে তিনি মাম্পিকে নিয়েই থাকা শুরু করলেন । মাম্পিই তার ধ্যান - জ্ঞান
।
এখন
মাম্পি একটু বড় হয়েছে । দুপুর বেলা তার মা তাকে বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে । বাড়িতে
সেদিন কেউ ছিল না । ওর বাবা বাড়ি এসে দেখে বাচ্চাটা একা রয়েছে কেউ কোথাও নেই । উনি
একটু দূরে বসে পড়লেন । আর নিজেই বলতে লাগলেন বাচ্চাটাকে একা রেখে সব গেল কোথায়। মা
দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিল ।
একটু
পরে মাম্পি খেলতে খেলতে বারান্দার কিনারে এসে গেছে পড়ে যাচ্ছে তখন ওর বাবা খুব ডাকাডাকি
শুরু করল " আরে কোথায় গেলে সব, ও তো পড়ে যাবে ” । মা দেখছে কিন্তু সারা দিচ্ছে
না । কেউ যখন এলো না তখন বাধ্য হয়ে বাবাই মাম্পিকে কোলে তুলে নিল । মা জয়ী হল । সেই
থেকে মাম্পি বাবারও আদরের ধন হল । মাম্পির মা মাম্পিকে এমন ভাবে মানুষ করেছে যে মাম্পির
মেয়ে হয়ে জন্মানোতে যারা একদিন দুঃখ করেছিল তারাই এখন মাম্পির জন্য গর্ব বোধ করতে
শুরু করলো । মাম্পির মা দেখাতে চেয়েছিল ছেলে হোক বা মেয়ে হোক মানুষের মত মানুষ করতে
পারলে সব সন্তানই সমান । ছেলের থেকে মেয়ে কোনো অংশে কম নয় । মাম্পি সেটাই প্রমাণ
করে দিয়েছে । এখন মাম্পিই তার বাবার কাছে সব থেকে বেশি প্রিয়। আজ মাম্পি মা, বাব্
কাকা, কাকিম্ ঠাকুমা, দাদ্ মামা, মামি সকলেরই নয়নের মনি ।
লেখিকার পরিচিতি -
কৈশোর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার একটি গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে দিল্লিতে আসা । ছোটবেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হত।