শীতের শুরুতে
প্রত্যেক বছরই আমি এক কিলো চ্যাবনপ্রাশ কিনি। দোকানের মালিক হাঁক দেয় ‘ওরে ঝন্টু মধুর
ছোট শিশিটাও এগিয়ে দে।‘ এক কিলো চ্যাবনপ্রাশ কিনলে পঞ্চাশ
গ্রাম মধুর শিশি ফ্রি। আমি মৃদু প্রতিবাদ করি, ‘কিন্তু
আমারতো এত অল্প মধুতে কাজ হবেনা, পাঁচশো গ্রাম মধুর শিশি চাই
আমার।‘ দোকানি বলে ‘ তা নেবেন, কিন্তু এটাতো কোম্পানি ফ্রিতে দিচ্ছে আপনাকে, প্যাকেজে
যখন আছে, কেন ছাড়বেন?’ অতএব এক কিলো
চ্যাবনপ্রাশের সঙ্গে পঞ্চাশ গ্রাম মধু ঘরে এল যা হয়ত তিন চার চামচের বেশি হবেনা।
ঠিক একইভাবে দুশো পঞ্চাশ গ্রামের কোলগেটের বড় প্যাকেট কিনলে সঙ্গে একটি টুথব্রাশ
ফ্রি, ওটা প্যাকেজেরই অঙ্গ। ওটাকে বাদ দিয়ে টুথপেস্টের বড়
প্যাকেট আনতে পারবেননা আপনি।
ইংরেজিতে প্যাকেজ
শব্দটির আভিধানিক ব্যাখ্যা ‘ A set of items that must be bought or accepted
together’। সস্তায় দেশ-বিদেশ ঘুরতে হলে আপনাকে ট্রাভেল কোম্পানির প্যাকেজ টুরে যেতে
হবে কারণ ওরাই যাতায়াত, খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত সস্তায় করে দেবে।প্যাকেজ টুরে যাঁরা
গেছেন তাঁরা জানেন ওতে এমন দু’চারটি ফ্যামিলি থাকবে যারা কোন ফোর্ট, মিউজিয়াম বা
লেক দেখতে গেলে গাইডের দেওয়া সময় থেকে অন্তত আধ ঘণ্টা পরে গাড়িতে ফিরবেন এবং তা
নিয়ে আপত্তি জানালে আপনাকে উল্টো দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বেননা। ওরা আপনার
প্যাকেজের সঙ্গী, ওদের না নিয়ে বাস ছাড়বেনা।
আমাদের জীবনে
সব চাইতে বড় প্যাকেজ হচ্ছে পরিবার। স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা মিলিয়ে এই যে
প্যাকেজটি তার স্থায়িত্ব অন্যান্য সব প্যাকেজের তুলনায় অনেক বেশি। পঞ্চাশ গ্রামের
সেই মধু বা কোলগেটের সঙ্গে পাওয়া নিম্নমানের টুথব্রাশের মেয়াদ অল্পদিনের। ইচ্ছে
হলে ওগুলো ব্যবহার না করে ফেলে দিতে পারেন, বা বাড়ির কাজের লোককে দান করে দায়মুক্ত
হতে পারেন। প্যাকেজ ট্যুরের সেই লেট লতিফ দম্পতিও সাতদিনের সফর শেষে রেল স্টেশন বা
এয়ারপোর্টে টা-টা করে বিদায় নিলে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত পারেন, কিন্তু
ঈশ্বরের ইচ্ছায়, ঘটকের তৎপরতায় কিংবা ওয়েবসাইটের কেরামতিতে দু’জন গাঁটছড়া বেঁধে যে
প্যাকেজ তৈরি করল এবং কয়েক বছরে সে প্যাকেজের যে সম্প্রসারণ ঘটল (বা ভ্যালু
এ্যাডিশন হল) ছেলে মেয়ে জন্মালে তা অক্ষত থাকবে বহুকাল। ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার
পর মনে হয় অরিজিনাল প্যাকেজ ভেঙে এবার নতুন প্যাকেজ তৈরি হল। কিন্তু বিয়ের পর
স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হলে ডিভোর্স হয়ে মেয়ে ফিরে আসে আবার সেই পুরনো
প্যাকেজেই, সঙ্গে একটি বাচ্চাও থাকে প্রায়শই। মা-বাবার চিন্তা বাড়ে, মাথার চুল
তাড়াতাড়ি পেকে যায় আর পুজো-আচ্চা, শান্তি স্বস্ত্যয়ন করে নড়বড়ে প্যাকেজকে মেরামত
করার ব্যর্থ চেষ্টায় সময় অপচয় করেন তাঁরা।
ফ্যামিলি
প্যাকেজে ছেলে হচ্ছে সেই এক কিলোর চ্যাবনপ্রাশ যা কিনতে আমরা সবসময়ই আগ্রহী আর
মেয়ে হচ্ছে সেই পঞ্চাশ গ্রামের মধুর কৌটো বা বাজে টুথব্রাশ যা অযত্নে ঘরের এককোণে
পড়ে থাকে বেশির ভাগ সময়। আমরা পরিবারিক এই প্যাকেজকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সুযোগ পেলেই পাড়াপড়শি,
আত্মীয়স্বজনদের জানিয়ে দিই, ‘ আমার ছেলেতো সোনার টুকরো, বৌটাই যত নষ্টের গোড়া।
খালি শাড়ি গয়না, ঘোরাফেরা, বাইরে খাওয়া আর সুযোগ পেলেই বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকা।‘
পাড়াপড়শিরা ঘন
ঘন মাথা নেড়ে সমর্থন জানান বক্তাকে কারণ যাদের ছেলে নেই তারাও দেখবেন জামাই-এর
খুঁত ধরতে সাহস পাননা, খুঁত মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ির, ননদ-ভাজের। চ্যাবনপ্রাশের
উপযোগিতা সবাই জানেন, পঞ্চাশ গ্রামের মধুর প্রয়োজনীয়তা সন্তানধারণ পর্যন্ত, তা-ও
অনেক ক্ষেত্রে ছেলের বউ মেয়ে প্রসব করলে সেটা বন্ধ্যাত্বের বরাবর মনে করেন ছেলের
বাবা-মা।
প্যাকেজ ভাল
হোক আর মন্দ হোক আপনাকে সিলেক্টিভ হলে চলবেনা। চ্যাবনপ্রাশ খাবেনতো মধুর ছোট
ডিব্বাটি আপনাকে ঘরে আনতে হবে। একটি পরিবারের সঙ্গে যদি আপনি সম্পর্ক রাখতে চান
তবে তার মধ্যে কে ভাল আর কে মন্দ ভাবলে চলবেনা, দু’জনকেই আপনাকে সাগ্রহে গ্রহণ
করতে হবে। আর এই কাজটি করলে আপনি অনেক সময় দেখবেন চ্যবনপ্রাশের বড় ডিব্বার থেকে ওই
ছোট মধুর কৌটোটি হয়ত বেশি উপকারি এবং প্রয়োজনীয়। টুথপেস্টের বড় টিউবের অর্ধেকটাই
হয়ত ফাঁপা, লোক ঠকানোর কায়দা আর প্যাকেজে পাওয়া সেই অবহেলিত টুথব্রাশটাই হয়ত
তিনমাস আপনার দন্তধাবনের উৎকৃষ্ট সহায়ক হয়ে থাকবে।
- - -
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা
কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের
বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই
ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর
কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প
প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ,
আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও
কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। দিল্লি থেকে
প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।