ভোলা গোগ্রাসে থালার
খাবারটা শেষ করেই জল খেয়ে নিল। কারণ এই সংক্ষিপ্ত সময়ে ও যে খাবারগুলো মুখে
ঢুকিয়েছে সেটা তো সঠিকভাবে চিবিয়ে খায় নি। শুধুমাত্র খাবারগুলো হাতে নিয়ে মুখে
পুরেছে এবং গিলেছে মাত্র ।
ওর মা বার বার বলছে
- "ধীরে খা ভোলা, ধীরে খা। একটু দেরী হলে কিছু হবে না।"
কিন্তু ওর যে আর তর
সয় না ।
ভোলা কর্পোরশনের এক
সাধারন কর্মচারী। বাড়ী থেকে অনেক কষ্টে নেতা-মন্ত্রী ধরে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছে
তবুও ওর মন কেন যেন ছটফট করে। কি যেন একটা খিদে ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আসলে ও
স্কুল-জীবন থেকেই লেখালেখি, নাটক, আবৃত্তি, অভিনয়ের প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব
করতো । কিন্তু ও যে পরিবেশে মানুষ হয়েছে সেখানে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বললেই লোকে
হাসবে, ওকে উপহাস করবে । তবুও ভোলা স্কুল- জীবন থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে খাতাতে ছড়া
লিখতো, কবিতা লিখতো, ছবি আঁকতো। লেখাগুলো হতো ছন্দ মিলিয়ে – যেমন কাদার সাথে ছন্দ
মিলিয়ে হতো সাদা আর জামার সাথে মামা। কলেজে পৌঁছে লেখায় ওর এক পরিবর্তন এল -
ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের লেখাগুলো দেখাতেই ওরা ওর প্রশংসা করতে লাগলো এবং পরামর্শ দিল
লেখাগুলো ছাপাবার জন্য। কিন্তু লজ্জা, সংকোচ ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল।
তবুও ভোলা নিজেই
নিজের সাথে যুদ্ধ চালাচ্ছিল এই লজ্জা আর সংকোচের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য।
কিন্তু কীভাবে লেখকদের সাথে, পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে, প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ
করবে ও বুঝে উঠতে পারছিল না। ও কোনোদিন স্বচক্ষে কোনও লেখককে দেখেনি, সম্পাদককে
দেখেনি, প্রকাশককে তো দেখেইনি। আর নিজের লেখা ছাপার জন্য ও লোককে অনুরোধ করবে এমন
দুঃসাহস ভোলা কোনোদিনই সঞ্চয় করতে পারেনি ।
একদিন হঠাৎ এক
অবসর-প্রাপ্ত সহকর্মী শ্যাম-বাবুর সাথে এক সন্ধ্যায় রাস্তায় দেখা। তারপর তিনি তার
এক বন্ধু-স্থানীয় আর এক ভদ্রলোকের সাথে ভোলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম তার বারীন-দা।
একদিন - দুইদিন করে ধীরে ধীরে নিয়মিত শ্যাম-বাবুর সাথে বারীন-দার অফিসে যাতায়াত
শুরু হলো ভোলার। ভোলা জানতে পারলো এই ভদ্রলোক লেখক ও প্রকাশক। ভদ্রলোক একদিন নিজের
লেখা একটি বই ওর হাতে ধরিয়ে দিল। ভোলা তো অবাক। একজন লেখক নিজের হাতে ওকে নিজের
লেখা বই উপহার দিচ্ছে! ও যেন আকাশ হাতে পেল । তারপর থেকে অফিস থেকে বাড়ীতে ফিরেই
মাকে বলতো - কি কি সবজি আনতে হবে বলো। চা খেয়েই বাজারের ব্যাগ আর সাইকেল নিয়ে ও
বেরিয়ে পড়তো বারীন-দার অফিসের দিকে। একদিন একান্তে - যখন আশে পাশে কেউ ছিল না -
শ্যাম-বাবুও না - তখন একটা ঢোঁক গিলে বলেই ফেললো বারীন-দাকে - "দাদা, আমিও
একটু-আধটু লিখি , যদি একটু দেখেন ......"
ভোলার কথাটা বারীন-দা বোধহয় "ফুলটস বল" ভেবে ধরে নিয়েছিলেন। বলটাকে ব্যাট দিয়ে সোজা ওভার বাউন্ডারি মেরে বললেন - "ও সব তুমি নীতিশ-বাবু আর মহেন্দ্র-বাবুকে দেখিও ।"
আর কিছু বলার মতো কথা
ভোলার কাছে ছিল না । সেদিনের মতো ফিরে এসেছিলো ও । কিন্তু একবার যখন ও আশার কিরণ
দেখেছে তখন কিছুতেই হাল ছাড়তে সে রাজী নয় । ওখানেই ধীরে ধীরে ও চিনতে পারলো নীতিশ
রায়, মহেন্দ্র চৌধুরীর মতো সাংস্কৃতিক জগতের কুশীলবদের । ও বুঝতে পারলো বারীন-দার
অফিসটা আসলে সাংস্কৃতিক জগতের একটা মঞ্চ।
হঠাৎ একদিন মহেন্দ্র-বাবু বললেন -
"তুমি লেখো। তোমার হবে।"
ভোলা বাকরুদ্ধ । কি
বলবে! ও তো মহেন্দ্র-বাবুকে কোনোদিন বলে নাই যে ও লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। নীতিশ
বাবুও একদিন আশ্বাস দিয়ে বললেন - "লিখতে থাকো।"
ভোলা তখন হাসবে না
কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। মনে হচ্ছিল রাতের আকাশটা যেন অজস্র তারায় তারায়
ভরে গেছে ।
এরপর বেশ কয়েকবার
মহেন্দ্র-বাবু আর নীতিশ-বাবুর সহযোগিতায় বিভিন্ন পত্রিকায় ভোলার কবিতা, ছড়া
প্রকাশিত হয়েছে ।
আগামীকাল বারীন-দার
প্রকাশনায় প্রথম মাসিক পত্রিকায় ভোলার প্রথম অনুগল্প প্রকাশিত হবে। বেশ কয়েকদিন
ধরেই পত্রিকা প্রকাশনার তোড়জোড় চলছিল। মহেন্দ্র-বাবু উৎসাহ দিয়ে বলেছেন -
"ভোলা, তোমাকেই আমরা হাইলাইট করবো।" বাড়ীতে এসে ভোলা মাকে সেই কথা
বলেছিল। ওর মা এসব কিছু বোঝেন না। চুপ করে ছেলের কথা শোনেন । ছেলের খুশিতে উনি
খুশি। ধীরে ধীরে পত্রিকার অফিস-ঘর, টেবিল, চেয়ার, লাইট, কম্পিউটার, প্রিন্টার,
কম্পিউটার-চালক - সব এলো এবং অবশেষে ছাপাখানা থেকে পত্রিকা ছেপে বের হলো। ভোলার মন
এই কয়দিন পত্রিকার অফিসেই পড়েছিল ।
আজ বারীন-দা ভোলাকে
ফোন করে বলেছে - "ভোলা এখুনি আসতে হবে । প্রেসের ছাপা কাগজগুলো এবার মিলিয়ে
মিলিয়ে সাজিয়ে স্টেপল করতে হবে।"
ফোন পাবার পর ভোলার
অস্থির অবস্থা। বারীন-দা ওকে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছে। ওকে তাই এখুনি ছুটতে
হবে।
বাঁধভাঙ্গা আনন্দে
ভোলা জোরে জোরে সাইকেল চালাতে লাগলো । বাড়ীর সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে ও ডানদিকের
পথটা ধরলো। ডানদিকে বাঁক নিতেই ও দেখতে পেল এক বিস্তীর্ণ শস্য-শ্যামলা ধান খেত,
সুনীল আকাশ আর আকাশে ভাসছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। ও দেখতে পেল ওই মেঘেদের
সাথে ভেসে ভেসে ও পত্রিকার অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে - এগিয়ে যাচ্ছে এক নতুন
পৃথিবীর দিকে।
লেখক পরিচিতি –
ধনঞ্জয় পাল চাকুরীজীবি। শিলিগুড়ি নিবাসী। সংস্কৃতিমনস্ক, সাহিত্যপ্রেমী । বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখালিখি করেন। সাহিত্য নিয়ে থাকতেই বেশি ভালবাসেন।
Tatkhanik digital bengali online e magazine