প্রকৃতির সাথে কবির ছিল নিবিড় ভালোবাসা। ছায়া সুনিবিড়
ছোট ছোট গ্রাম তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। সকাল বেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের ছোঁয়ায়
পুলক জাগতো তাঁর মনে। গ্ৰাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ তাঁর মন ভুলায়, জোৎস্না রাতে বসন্তের
মাতাল সমীরন তাঁর মন মাতায়, শরতের হিমের পরশে জুড়োয় তাঁর দেহ, মন। তাঁর লেখায় বারেবারে
ফুটে উঠেছে নীল দিগন্ত। কবি নিজেই লেখার মধ্যে দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন শ্যামলিমাকে,
"এসো শ্যামল, সুন্দর"। সরষে ক্ষেতের গন্ধ তাঁকে আপ্লুত করে।
ছোট থেকেই কবি বড় হয়ে উঠেছেন শ্যামলিমায়। তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে
প্রকৃতির কোন অভাব ছিল না। সেখানে ছিল তাল-তমাল, আম্র কুঞ্জ, বকুল। ছিল শালিক পাখির
কিচিরমিচির, কোকিলের কুহুতান। কাঠঠোকরার অক্লান্ত ঠক্ঠক্ শব্দ ছিল। ছিল ধনেশ পাখির
এলোমেলো আষ্ফালন। তবুও কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্যে অবগাহন করবেন বলে ছুটে ছুটে যেতেন
কলকাতা শহরের বেশ কটি জায়গায়। তারই একটি দক্ষিণ কলকাতার আলিপুর। এই অঞ্চল বনানী ময়,
স্নিগ্ধ ছায়ায়, মিষ্টি বাতাসে ভরপুর।
কবির পরম বন্ধু, বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ আলিপুর আবহাওয়া
দপ্তর-এ কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন আবহাওয়াবিদ । কবির প্রকৃতি প্রেম তাঁর অজানা নয়। তাই তিনি কবিকে বারেবারে
আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আবহাওয়া দপ্তরের অতিথিশালায়। অতিথিশালার স্নিগ্ধ অরণ্য দুহাত
বাড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে।
১৯২২ সালে কবির প্রথম আলিপুর যাওয়া। তার পর ১৯২৩ সালের দুবার কবি
প্রশান্তচন্দ্রর আতিথ্য গ্রহণ করেন প্রথমে ২৩শে জানুয়ারি। সে বছরই আবার পঁ চিশে এপ্রিল আসেন। আবহাওয়া দপ্তরে
সেবার একটিমাত্র রাত কাটিয়েছেন কবি। কবি তখন চলেছেন শিলং শহরে, সেই যাত্রায় একটিমাত্র
রাত কাটান আবহাওয়া দপ্তরে। সেখানেই একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কবি যোগ দেন। প্রশান্তচন্দ্র তখন
বিবাহিত। নববধূ নির্মলকুমারীর ওপর পড়েছিল অতিথি আপ্যায়নের ভার। সেদিন প্রাঙ্গণে বসেছিল চাঁদেরহাট।
কবি নিজেও গাইলেন। প্রকৃতির প্রাঙ্গণে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেদিন এক অন্য মাত্রায়
পৌঁছে ছিল। ইচ্ছে না থাকলেও কবিকে চলে যেতে হয়েছিল।
একরাতে কবির মন ভরল না। ঠিক করলেন এবার গিয়ে সেই ছায়াঘন প্রাঙ্গণে বেশ
কিছু দিন কাটাবেন। একই বছরের ২৫শে সেপ্টেম্বর টানা তিন সপ্তাহ থেকে গেলেন। কোন দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, সাংসারিক
জটিলতার চিন্তা নয়, কেবল বিশ্রাম। কিন্তু সেই বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে সৃষ্টি হল ইতিহাস।
বিখ্যাত রক্তকরবী নাটকের জন্ম হলো এই তিন সপ্তাহে এই ভবনে , কবি নিজে যার নাম দিয়েছিলেন " হাওয়া অফিস" ।
এর পরের বছর চীন যাত্রার সময় এই হাওয়া মহল এর প্রাঙ্গণে কবির সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেই সময় এই হাওয়া অফিসে সাহিত্যিকদের
চলত আনাগোনা।
অট্টালিকায়
মোড়া খোদ কলকাতার বুকে এমন শ্যামলিমার বিন্যাস কবিকে মুগ্ধ করেছিল। অশ্বথ, শিরীষ, তাল-তমাল,কাঞ্চন,
হিজলের রূপ এবং ছায়া তাকে আপ্লুত করেছিল।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন ।