প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
দ্বিতীয় পর্ব
( দুই )
অফিসের যিনি টপ বস, তিনি আই.এ.এস. অর্থাৎ দেশের বড়
কঠিন পরীক্ষায় পাস করে এই পদে বহাল হয়েছেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং অফিস ট্যাকল করার
অসাধারণ ক্ষমতা। ফলে বেশিরভাগ দপ্তরের উচ্চপদে তাঁরাই বহাল আছেন। বদলির সময় হয়ে গিয়েছে।
অফিসে কে কি কাজ করেন, কার পারফর্মেন্স কেমন, সব তাঁর নখদর্পণে। ফলে অনীকের পত্রটি
পেয়ে ডিসিশন নিতে দেরি করেন নি। প্রথমে তাদের দুজনকে আলাদা ভাবে ডেকে তাদের ক্ষোভের
কথা জেনে নিলেন । তারপরই বড়বাবুকে ডেকে তাদের কাজের পারফর্মেন্স রিপোর্ট জমা দেওয়ার
নির্দেশ দিলেন। আর এদিকে কম্পিউটার অপারেটারকে ডেকে চৌত্রিশটা কুপন বানালেন। প্রতিটা
কুপনে লেখা হয়েছে। এই ঘটনায় তার মতে দোষী কে? অনীক ধরের ব্যবহার কেমন? সনাতন দাসের
ব্যবহার কেমন? তাদের সম্পর্কে তার ধারণা কি? সেকশানে মোট ছত্রিশজন স্টাফ আছে। ঐ দুজন
বাদ দিয়ে চৌত্রিশজনকে নামের গোপন কোড নাম্বার দিয়ে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া
হল। পরদিন সেই কুপনে সম্পূর্ণ মতামত লিখে সাহেবের ঘরে একটি বাক্স আছে । তাতে জমা দিয়ে
যাবে ।
ব্যাপারটা বেশ অভিনব। এইভাবে যে বিচার হবে, কেউ কল্পনাও
করতে পারেনি। অনীক কী একটু চাপে পড়ে গেল? সবাই তার পক্ষে মত দেবে তো? অফিসে চারজন
স্টাফ আছে, কদিন আগে একটা ব্যাপারে অনীকের সঙ্গে হট টক হয়ে গিয়েছে। তাদেরকে নিয়েই
তার একটু সন্দেহ। বিট্রে করলেও করতে পারে। তবে ঐ কজন ছাড়া সকলে যে তার পক্ষে থাকবে,
সে নিশ্চিত। একটা গ্রুপ ডি কর্মচারী এতটা মাথায় উঠবে, কেউ নিশ্চয়ই চাইবে না। তবু
চুপ করে বসে থাকলে হবে না। পরদিন অফিসে এসেই প্রত্যেকের টেবিলে টেবিলে গিয়ে অনুরোধ
করল, যাতে তার পক্ষে রায় দেন। এমনকি যাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল, তাদেরকেও অনুনয়
- বিনয় করে বলল। সে আশাবাদী, রায় তার পক্ষেই যাবে। অফিসের আবহাওয়া সে - রকমই ইঙ্গিত
দিচ্ছে। এবার বোধহয় সনাতনের চাকরিটাই গেল। তার কিছু করার নেই। যেমন কর্ম তেমন ফল।
গ্রুপ ডি কর্মচারী তার আবার সিনিয়র গ্রেড ওয়ান– বড়াই করার টেরটি এবার পাবে। অনীক
যেমন সকলকে হাত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সনাতনকে সে - রকম কিছু করতে দেখা গেল না।
সে সকাল থেকেই মনমরা। অফিসে একটি বেঞ্চের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। কারো সঙ্গে একটি
কথাও বলছে না। কি ভাবছে কে জানে। অথচ অনীক বেশ আত্মবিশ্বাসী। পাশের কলিগকে সনাতন সম্পর্কে
বলল, বাছাধন এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। বড্ড লেট করে ফেলেছ,
সনাতন। একটু করুণা হচ্ছে ঠিকই, তবে তোমাকে বাঁচানোর অভিপ্রায় আমার নেই। তুমি যেমন,
একটু কড়া দাওয়াই তোমার দরকার। যেমন কুকুর, তেমন মুগুর প্রয়োজন। কার সঙ্গে লাগতে
এসেছে, একটু টের পাওয়া দরকার। বেলা তিনটের মধ্যেই সকলের ভোট দেওয়া হয়ে গেল। ভোট
ছাড়া একে আর কী বলা যাবে? গোপনে উত্তর লিখে একে একে সকলে বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল।
কেউ কারোরটা দেখতে বা জানতেও পারছে না। অত্যন্ত গোপন ব্যাপার। ভোটের ক্ষেত্রেই তো এমন
হয়, তাই না। জগতে কিছু মানুষ থাকে , নিজেকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করে। অর্থাৎ ভাবে, সে
যথেষ্ট ওজনদার আদমি। আদতে যে ঢোসকা ফাঁপা, সেই বোধজ্ঞানটাই তার নেই। এমন মানুষকে কী
বলে? উজবুক ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় কি? একই অফিসে পাশাপাশি বসে কাজ করে আসছে, তার
সম্বন্ধে অন্যের কী ধারণা, কিছুটা তো আন্দাজ করা যায়, নাকি? একমাত্র হাঁদারাম যারা,
তারাই ঠিক মালুম করতে পারে না । যেমন অনীক তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পরদিন সকলের সম্মুখে
গণনা করে যা রেজাল্ট পাওয়া গেল, তা অবাক হওয়ারই কথা। সারা অফিসে মাত্র একজন অনীকের
পক্ষে রায় দিয়েছে । আর সকলেই সনাতনের দিকে। এতটা অবশ্য ভাবা যায় নি। যারা নবাগত
, তারাও বিপক্ষে রায় দিল। শুধু তাই নয়, অনেকেই মন্তব্য করেছে, অনীকের ব্যবহার অত্যন্ত
খারাপ এবং সরকারি অফিসে চাকরি করার উপযুক্ত সে নয়। এছাড়া তার কাজের পারফর্মেন্স রিপোর্ট
পরীক্ষা করে দেখা গেল, তার কাজের মান অতি সাধারণ অর্থাৎ সেখানেও প্রশংসনীয় কাজ সে
করে দেখাতে পারে নি। অফিসে ফিসফিসানি, গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। যারা তার বিপক্ষে
ভোট দিয়েছে, তারাও থ । মাত্র একজন ছাড়া কেউ তার পাশে নেই? এই ঘটনায় যার সবচেয়ে
বেশি খুশি হওয়ার কথা, সেই সনাতন কিন্তু এখনও গোমড়া মুখেই বসে আছে। কেন ঠিক বোঝা দায়।
মুখে কোনও কথা বলছে না। একেবারে বোবা। অন্যদিকে রেজাল্ট বের হওয়ার পর অনীকের যেন বোধোদয়
হয়, অর্থাৎ অফিসে তার অবস্থান সম্বন্ধে সকলের মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তার মুখমণ্ডলই
বলে দিচ্ছে, কী বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে তার জীবনে। তারা চার বন্ধু একসঙ্গে চাকরিতে ঢুকেছে।
একসঙ্গে এর - ওর থেকে ভাগাভাগি করে রোজদিন টিফিন খায়, গল্পগুজব, কত মিলমিশ— তারাও
তার বিরুদ্ধে ভোট দিল? বিশ্বাসের ভিত কতটা পলকা, এই প্রথম টের পেল সে। বলতে গেলে এই
প্রথম তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন হল। এদিকে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তাই ঘটল। শ্রীযুক্ত
অনীক ধরকে এক বছরের জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। অন্যদিকে সনাতন দাশকে সতর্ক করা
হল। উচ্চতর কোন কর্মচারিকে নাম ধরে ডাকার অধিকার তার নেই। এর জন্য তাকে যথেষ্ট নিন্দা
করা হয় । পুনরায় যদি কখনো এমন আচরণ করে, তাকেও উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। এখানেই গল্প
শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কথামত সবকিছু তো চলে না। ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যাকে বলে অপ্রত্যাশিত।
সকলের কাছেই অকল্পনীয় ছিল ।
সনাতন দাশ হঠাৎ সাহেবের ঘরে ঢুকে সাহেবের পা দুটো
জড়িয়ে ধরল – স্যার, আপনি অনীকবাবুকে বাঁচান। অতবড় শাস্তি দেবেন না। অল্প বয়স। আমার
ছেলের থেকেও বয়স কম হবে। একটা ভুল করে ফেলেছে। এর জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন না-
স্যার।
-- পা ছাড়ো সনাতন। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে।
কিছু করার নেই।
— সবই আপনার হাতে স্যার। একটা সুযোগ অন্তত ওকে দিন।
আমি বলছি , এমন ভুল ও আর করবে না। কথা দিন স্যার। নাহলে আমি কিছুতেই পা ছাড়বো না।
— আরে , পা ছাড়ো আগে। দেখছি কী করা যায়।
- না স্যার , আগে কথা দিন, আমার জন্য এতবড় শাস্তি
ওকে দেবেন না।
অতঃপর সাহেবের আশ্বাস পেয়ে সনাতন উঠে এল। এদিকে আরেক
কাণ্ড। অনীক ধর আচমকা সনাতনের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল— সনাতনদা, তুমি আমার বাবার মতো।
আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও সনাতনদা। আরে একি করছেন? পায়ে
হাত দিয়ে নিজেকে ছোট করছেন কেন? ছিঃ ছিঃ, পা ছাড়ুন । পা ছাড়ুন তাড়াতাড়ি।
আগে কথা দাও, তুমি আমায় ক্ষমা করেছো।
-আরে একি হচ্ছে? সবাই কিন্তু দেখছে। পা ছাড়ুন তাড়াতাড়ি।
-দেখুক সবাই। আজ আমার কোন লজ্জা নেই সনাতনদা। তোমার
মত এতবড় মনের মানুষ আমাকে নতুন করে শিক্ষা দিল। আমি জীবনে এমন ভুল করব না সনাতনদা।
সনাতন অনীকবাবুকে দু হাত ধরে তুলে জাপ্টে ধরল। দুজনের চোখেই জল। টলটল করছে। আর এদিকে
অফিসের সকলে হাঁ করে দেখছে। মন শুদ্ধ হচ্ছে, পরিণত হচ্ছে । শাবাশ ।
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক
বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী
জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।
তাঁর প্রথম
গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র,
উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।
তিনটি গল্প সংকলন
ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও
সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।
Tatkhanik digital bengali online e
magazine