বিয়ের আগেই আমার
চুল পাকতে শুরু করেছিল। বিয়ে করতে গেলে কনের বাড়ির লোকেরা, বিশেষত
আমার দুই শালি এবং ওদের পাড়াপড়শিরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে আসর মাটি না করে দেয়
সেজন্য আমার বন্ধু তপন খুব যত্ন করে ছোট চিমটে দিয়ে মাত্র গোটা পঞ্চাশেক পাকা চুল
টেনে বের করে আমার মান সন্মান রক্ষা করল বিয়ের আসরে। কিন্তু বিয়ের দু’মাসের মধ্যে যখন সেই পাকা চুলগুলো আবার ফিরে এল সঙ্গে আরও কিছু নতুন পাকা
চুল নিয়ে, আমার নববিবাহিতা পত্নী শীলার চোখ কপালে উঠল। ‘
তোমার মাথায় এত পাকা চুল আছে জানলে তোমার গলায় আমি মালা দিতামনা,’
সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিল শীলা। শীলার মাথায় গর্ব করার মত ঘন লম্বা চুল
নেই, কিন্তু যা আছে তা বেশ কালোই। পাতলা, ফর্সা ছোটখাট চেহারার মেয়ে শীলা, সুন্দরি না হলেও
সুশ্রী বলা চলে।
বিয়ের পরে ওর আর আমার দিকের আত্মীয়দের বাড়ি থেকে খাবার নিমন্ত্রণ আসতে লাগল।
খাওয়া দাওয়া চিরকালই আমার খুব পছন্দ আর আমি বেশ ভাল করেই জানি নিমন্ত্রণের এই
সুনামি কয়েক মাসের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে কাজেই ওগুলোকে সানন্দে গ্রহণ করাই
বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু শীলা বেঁকে বসল। ‘ তুমি
এই মাথাভর্তি পাকা চুল নিয়ে গেলে আমাকে খোঁটা দেবে সবাই,’ শীলা
বলল আমার চুলের মধ্যে ওর লম্বা আঙুল চালিয়ে দিয়ে। ‘ দু’চারটে হলে চিমটে দিয়ে তুলে দিতাম, এতো দেখছি কাঁচার
থেকে পাকা বেশি। মদটদ খেতে নাকি খুব বিয়ের আগে? শুনেছি ওসব
ছাইপাশ খেলে তাড়াতাড়ি চুল পেকে যায়।’
আমি বললাম, ‘ দিনে গোটা পাঁচেক সিগারেট খাবার পয়সা জোটেনা, মদ খাব
কোত্থেকে। সরকারি চাকরি পাওয়ার আগে মার্কেটিং লাইনে ছিলাম, রোদ্দুরে
খুব ঘোরাঘুরি করতাম, তাতেই . . .’
শীলার অত সময় নেই
আমার সাতকাহন শোনার। বলল, ‘ ডাই করতে হবে তোমার চুল। ভাল
কোম্পানির কলপ নিয়ে এস, সঙ্গে ব্রাশ আর প্লাস্টিকের বাটি।
এসব কাজতো দিনে করা যাবেনা, পাড়াপড়শি দেখে ফেললে আমার খিল্লি
ওড়াবে। মাঝরাত্তিরে বসতে হবে তোমাকে নিয়ে।‘
বিয়ের পরে পরে
ভালবাসা একটু জোরদার থাকে, কাজেই মাঝরাত্তিরে খুব সযত্নে শীলা
আমার মাথায় কলপ লাগিয়ে দিল, তারপর একঘণ্টা বসিয়ে রেখে
শ্যাম্পু করে মাথায় এক বালতি জল ঢেলে কাজ শেষ করল। কালো চুল নিয়ে দু’মাস চুটিয়ে নেমন্তন্ন খেয়ে বেরালাম আমরা দু’জন। ও
ভালো ভালো অনেকগুলো শাড়ি পেল আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে, আমি
পেলাম অঢেল আশীর্বাদ আর নানারকম উপদেশ। তিন মাস পরেই কলপ উঠে গিয়ে আগের থেকেও বেশি
সাদা চুল বেরিয়ে পড়ল। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম আমি আর চুলে কালি মাখবনা, নেমন্তন্ন পেলেওনা। শীলার মুখ ভার হল, পাকা চুল বুড়ো
মানুষের সঙ্গে প্রেম করতে কার ভালো লাগে? প্রথম দিকে রাস্তায়
বেরোলে ও আমার বেশ কিছুটা পিছনে হাঁটত যাতে কেউ সন্দেহ না করে বসে যে ওর সঙ্গে
আমার কোন সম্বন্ধ আছে। কিন্তু বাস বা মেট্রোতে উঠলে ও আমার বার্ধক্যের সুযোগ নিতে
ছাড়তনা। লেডিজ সিটে বসার যায়গা না পেলে শীলা আমার সঙ্গে সিনিয়ার সিটিজেনের সিটের
দিকে এগিয়ে যেত। আমাকে দেখেই অল্প বয়সি ছেলে বা মেয়ে উঠে দাঁড়াত আর সেই সুযোগে
শীলাও আমার পাশেই বসে পড়ত। কিন্তু বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা স্থিতিতে অনেক সময় বিপাকে
পড়তে হত আমাকে। শীলার প্রথম ডেলিভারির সময় ডাক্তার বললেন,‘ওর
হাসব্যান্ড কোথায়? ওকে ডাকুন। আন্ডারটেকিং সই করতে হবে ওকে।‘
আমি যখন জানালাম আমিই হাসব্যান্ড তখন উনি হা করে আমার দিকে তাকিয়ে
রইলেন।
দেখতে দেখতে
আমাদের বিয়ের অম্ল-মধুর ত্রিশটা বছর পার হয়ে এলাম। আমার এখন সব চুলই শনের নুড়ি, আর
শীলার চুল সব এখনও কাঁচা। আর শুধু তাই নয় আমাদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচ বছর
আগেই কিন্তু ও এখনও সেই আগের মতই পাতলা রয়ে গেছে। এ যেন সেই অস্কার ওয়াইল্ড-এর
ডোরিয়ান গ্রে যার বয়স এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল বাজার হাটে শীলাকে নিয়ে বেরোলে
দোকানের কর্মচারিরা আমাকে আর কাকু বা আংকলজি বলেনা, দাদাজি
বলে আর ওকে বেহেনজি বলে। শীলা তাতে খুশি হয়, আমিও খুশি হই
কেননা কচি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে অল্প বয়সি কর্মচারিরা আগ্রহী হয়ে ওঠে আর আমি যাতে
নাতনিকে তাড়া না দিই তাই আমাকে চা বিস্কুট ধরিয়ে দেয়। চা খেয়ে আমি বাইরে গিয়ে
একখানা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিই আর ভাবি শীলা যদি এরকম থেকে যায় তাহলে ওকে নিয়ে
আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমি চলে গেলে ও কোন অল্প বয়সী ছেলেকে বিয়ে করে নিতে
পারবে। এসব ভেবেই আমি আজকাল ওকে একটু সাজপোষাকের দিকে নজর দিতে বলি, ভাল কোম্পানির স্নো পাউডার কিনে দিই। ও বলে, ‘ আবার
এসব ছাই ভষ্ম আন কেন আমার জন্য? আমি কি আর কচি খুকি আছি?’
আমি ওর মসৃণ গালে
হাত বুলিয়ে বলি, ‘ তুমি কচিই ছিলে, কচিই থাকবে আর সেজন্যই এসব তোমার এখনও দরকার।‘
শীলা হাসে, আমিও
হাসি। ও কী ভেবে হাসে আমি জানিনা, আর আমি কেন হাসি সেটাও ও
জানেনা।
- - -
লেখক পরিচিতি -
জন্ম এবং শিক্ষা
কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ
দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।
ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি
থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ
প্রকাশিত হয়েছে। দেশ,আনন্দবাজার,সাপ্তাহিক
বর্তমান, নবকল্লোল,কালি ও কলম (বাংলাদেশ)
এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।
Tatkhanik digital bengali online e magazine