তারা মাছ
আকাশে যেমন তারারা মিট মিট করে জ্বলে,
তেমনি নীল সাগরের জলেও বহু তারা আছে। সাগরের তারাদের কিন্তু আলোর রোশনাই নেই। সেই তারারা হল তারা
মাছ। ইংরেজিতে তাদের স্টার ফিস বা সী স্টার বলা হয়। দেখতে ঠিক আকাশের তারার মতই,
তাই এই নাম। এই তারা মাছ কিন্তু আসলে মাছও নয়, এরা মাছের শ্রেণীতে পড়ে না।
বিজ্ঞানের ভাষায় এদের বলা হয় ‘একিনোডার্মাটা’ (Echinodermata)। তারা মাছ দেখতে অনেকটা গোল চাকতির মতো। এদের পিঠ কাঁটায়
ভর্তি থাকে। তবে কাঁটাগুলো যেমন লম্বা নয়, তেমনি শক্ত বা ধারালোও নয়। হাত দিলে
শুধু এর খসখসে ভাবটা টের পাওয়া যায়। এদের শরীর থেকে কয়েকটি আঙ্গুলের মত ডানা
বেরিয়ে জীবটিকে তারার আকৃতি দিয়েছে। শরীরের আসল অংশটা কিন্তু ঠিক মাঝখানে। ওখানেই
ওদের মুখ, আর ভেতরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। স্পঞ্জের মত শরীরের চারপাশে
আঙ্গুলের মত যা বেরিয়ে থাকে ওগুলোকে তারা মাছের হাত এবং পা দু’টোই বলা যেতে পারে
আবার লেজ বললেও ভুল হবে না। হাত, পা, লেজ যা-ই বলা হোক না কেন, ওগুলো থেকেই কিন্তু
আবার বেরিয়েছে খুব সরু সরু সত্যিকারের পা। এসব পায়ের সাহায্যে তারা মাছেরা জলের
নীচে শক্ত বালির ওপর তাড়াতাড়ি করে হেঁটে যেতে পারে। জলে শরীর ও পা ছড়িয়ে মনের সুখে
এরা এদিক ওদিক ঘুরে সাঁতার কাটতে পারে।
তবে বেশী নড়াচড়া এরা পছন্দ করে না। জলের নীচে কোন একটা পাথর বা শেওলা জমা
ডাল-পালা পেলেই হল, সেসবের গায়ে আটকে পরে থাকে। একদম নড়াচড়া করেনা। এদের
জাতস্বভাটাই এরকম, বসে বসে সময় পার করে দেওয়া। তারা মাছেরা এইভাবে বসে অনেকদিন
কাটিয়ে দিতে পারে। সমুদ্রের স্রোত বা ঢেউ-এর ধাক্কা না খেলে হয়তো সারা জীবনই এক
জায়গায় বসেই কাটিয়ে দিত।
বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন রঙের তারা
মাছ হয়। কোনটা টকটকে লাল, কোনটা হলুদ, কোনটা সবুজ, কোনটা বাদামী ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারা মাছের আঙ্গুলের চারপাশে ছোট ছোট সুতোর মত ঝালরও আছে ।
এদের দেখতে খুব গোবেচারা বলে মনে হলে কি
হবে, এদের নেহাত নিরীহ জীব ভেবে ভুল করলে চলবে না। ছোট ছোট সামুদ্রিক প্রাণীদের
কাছে এরা কিন্তু রাক্ষসের মত ভয়ঙ্কর। এদের খিদেও খুব বেশী পায়। আঙ্গুলের মত শরীরের
চারপাশে ছড়ানো হাত কিংবা পা কিংবা লেজগুলোই হচ্ছে এদের শিকার ধরার অস্ত্র। শিকার
কাছে এলেই আঙ্গুলগুলো তেড়ে যায় আর সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরে শিকারকে মুখের কাছে টেনে
নেয়। প্রচণ্ড শক্তি এসব আঙ্গুলের। এসব আঙ্গুলের সাহায্যে ওরা চাপ দিয়ে শামুক কিংবা
ঝিনুকের খোলা পর্যন্ত ফাটিয়ে ফেলে তার ভেতরের জিনিষ বের করে আনতে পারে। শামুক,
কাঁকড়া, ঝিনুক হল এদের প্রিয় খাবার।
তারা মাছ সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত
স্বভাবের কথা শোনা যায়। জলের মধ্যে এরা নাকি শত অত্যাচার সহ্য করতে পারলেও, ডাঙায়
তুলে আনলে নাকি নিমিষেই মেজাজ বিগড়ে যায়। কোন কোন তারা মাছ নাকি তখন স্বেচ্ছায় আত্মাহুতির
পথ বেছে নেয়। অনেকটা টিকটিকির লেজ খাসার মত, এরা ও নিজের শরীর থেকে হাত-পাগুলো
খসিয়ে ফেলে বাঁচার সাধ-আশা ত্যাগ করে। ভাবলেই অবাক লাগে তাই না? কিন্তু সব তারা
মাছেরই এক রকম স্বভাব নয়। বঙ্গোপসাগরে যে সব তারা মাছ আছে তারা কিন্তু শরীর থেকে
হাত-পা খসিয়ে মৃত্যুর পথ বেছে নেয় না। তবে সাগরের ঢেউয়ের প্রবল তোড়ে ডাঙায় উঠে
আসার সাথে সাথেই দ্রুত মৃত্যু বরণ করে।
তারা মাছ অন্যান্য মাছের মতই একসাথে
অনেক ডিম পাড়ে। এসব ডিম ফুটে ঝাঁকে ঝাঁকে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চারাও চলে ঝাঁক বেঁধে।
শুধু ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেই তারা মাছের বংশ বৃদ্ধি পায় না, এদের বংশ বাড়ে
অন্যভাবেও। জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে জালে তারা মাছ উঠলে কিন্তু মোটেই খুশি হয় না।
তারা মাছ কেউ মাছের মত খায় না বলে জেলেদের কাছে এদের কোন কদর নেই। বরং জালে তারা
মাছ উঠলে জেলেরা রেগে ওদের টুকরো টুকরো করে জলে ফেলে দেয়। এই বিষয়টি জেলেদের
নিষ্ঠুরতা হলেও তারা মাছেদের জন্য কিন্তু ভালো। কারণ ছিঁড়ে ফেলা এই টুকরোগুলোই
অল্প কিছুদিনের মধ্যে গজিয়ে আবার নতুন তারা মাছে পরিণত হয়। এভাবেও ওদের বংশ বৃদ্ধি
পায়।
সমুদ্রের পাড়ে ঢেউয়ের তোড়ে যখন লাখ লাখ তারা মাছ ভেসে আসে, তখন ভেজা বা শুকনো সমুদ্র সৈকতে ঝিনুকের সাথে এসব তারা মাছ বালির মধ্যে ঝিলমিল করতে থাকে আর তখন সমুদ্র সৈকতকেই মনে হয় তারার মেলা।