প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানেক্লিক করুন ।
স্বপন জিজ্ঞেস করল ,“কি রকম খরচ পড়বে । একটা আইডিয়া দিলে ভালো হয় । ”
একজন বললেন ,“খরচ
আপনার উপর নির্ভর করছে । আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই । দেড়শো , আড়াইশো , পাঁচশো , হাজার ,
দু হাজার , পাঁচ হাজার , দশ হাজার আপনি যা বলবেন ,তার মধ্যেই সব হবে । তবে
অটো ভাড়া ত্রিশ টাকা এবং দুশো টাকা আপনাকে আলাদা দিতে হবে । ”
স্বপন প্রথমটায়
একটু ঘাবড়ে গেল । পিণ্ডদানেও বিভিন্ন রেট ! পরে অবশ্য আলোচনা করে ধারণা স্পষ্ট
হয়। সে সিদ্ধান্ত নিল বাবা - মায়ের আলাদা আলাদা পাঁচশো পাঁচশো হাজার টাকায়
দুটো কুপন নেবে । একজন বললেন ,“একজনের দুটো
কুপন নেওয়া যাবে না । একটা পাঁচশো টাকাতেই বাবা - মায়ের পিণ্ডদান করা যাবে ।
শুধু বাবা - মা কেন ? অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রিয়
পশুপাখির নামেও পিণ্ডদান হবে ঐ একই টাকায় । ”
স্বপন নিশ্চিন্ত
। যাক ঝামেলা তেমন নেই । রাতে হোটেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে মাকে স্বপ্ন দেখল । দুজনে
একটি পাহাড়ে উঠছে । মা তর তর করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল । কিন্তু স্বপন উঠতেই
পারছে না । বার বার হোঁচট খাচ্ছে । মা ডাকছেন , খোকা
তাড়াতাড়ি আয় । ঐ দিকটা কি অপূর্ব দৃশ্য । চেয়ে দেখ । দেখতে গিয়ে আবার হোঁচট
খেল । আরেকটু হলে খাদেই পড়ে যেত । ভাগ্যিস মা উপর থেকে দ্রুত নেমে এসে ওকে জাপ্টে
ধরে ফেলল । পরক্ষণেই ওরা একটি সুন্দর ফুলের বাগানে । জায়গাটা ঠিক কোথায় চিনতে
পারল না । নাম না জানা হরেক রকম পাহাড়ি ফুল । মায়ের হাত ধরে সে হাঁটছে । মা
গুনগুন করে গান গাইছিলেন । লাল,সাদা,নীল,সবুজ,হলুদ – কত রকমের যে ফুল
তার ইয়ত্তা নেই । আগে একসঙ্গে এত ফুল দেখেইনি কোনোদিন । ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে
গিয়েও তার উঠতে ইচ্ছে করছিল না । প্রায় মিনিট পনের কুড়ি চুপচাপ শুয়ে রইল ।
মায়ের এমন প্রাণখোলা হাসিখুশি অনেকদিন দেখেনি সে । মনটা আনন্দে ভরে উঠল । এতদিন
বাড়িতেই মা রান্না করছেন বা খাইয়ে দিচ্ছেন— এসবই দেখতো ।
আজকের মত এমন বাম্পার স্বপ্ন আগে দেখেছে বলে মনে পড়ে না তার । তবু একটু আপশোষ
রয়ে গেল । ফুলের বাগানে মায়ের গানটা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল । মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল যে । যাক আজকের
দিনটাও খুব ভালো কাটবে সে নিশ্চিত । ভোর ছটার মধ্যে স্নান সেরে ধুতি পরে সে অফিসে
পৌঁছে গেল । রেজিস্টারে নাম লেখানোর পরেই অটো করে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের গয়ার
প্রধান মন্দিরে এসে পৌঁছে গেল। গয়া
স্টেশন থেকে মাইলখানেক দূরত্ব । স্বরাজ্যপুরী রোড , গয়া
। মন্দিরে কম করে তিন থেকে সাড়ে তিনশো লোক পিণ্ডদানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে । আজ অমাবস্যা
, ভালো দিন , সে জন্যেই নাকি এত
লোকের সমাগম । বিভিন্ন রাজ্য থেকে সব এসেছে । তবে বেশিরভাগই বাঙালী । বাংলাদেশ
থেকেও এসেছেন বেশ কয়েকজন । মন্দিরের অফিসেই কুপন কাটতে হয় । সেই কুপনটিই পাশের
আরেকটি রুমে জমা দিতে হল । এক মহারাজ একজন একজন করে নাম ডাকছেন । কোথায় বাড়ি ,
স্বাভাবিক মৃত্যু না অপমৃত্যু , শ্রাদ্ধশান্তি
হয়েছে কিনা , কত টাকার পিণ্ডদান কররেন সমস্ত তথ্য জেনে
তাঁরাই পুরোহিত ঠিক করে দিচ্ছেন এবং বারবার ঘোষণা করে দিচ্ছেন , কোনো পাণ্ডা বা পুরোহিতকে টাকা দেওয়াটা বাধ্যতামূলক নয় । বারবার
চাইলেও আপনারা মনে করলে হাতজোড় করে তাদের বিদায় করে দিতে পারেন । আপনারা যারা
এখানে টাকা দিচ্ছেন , তার থেকে অর্ধেক টাকা যাবে
পিণ্ডদানের সমস্ত উপকরণ কেনার জন্য । আর বাকি অর্ধেক পুরোহিতের প্রাপ্য । কারণ
পুরোহিত আপনার সঙ্গে সারাক্ষণ থাকবেন এবং তিনিই আপনাকে দিয়ে পিণ্ডদানের ব্যবস্থা
সম্পন্ন করাবেন । প্রায় তিনশোর উপর পুরোহিত সার দিয়ে বসে আছেন । যার যখন ডাক
পড়ে তখনই উঠে আসেন। স্বপনের স্লিপ জমা দেওয়ার দেড় ঘণ্টা পর ডাক পড়ল । পাঁচশো
টাকা জমা দিতেই পুরোহিত ঠিক হয়ে গেল । পুরুতের নাম রতন ভট্টাচার্য । বাঙালী ।
তিনিও স্বপনকে একটু তফাতে ডেকে নিয়ে একটি বেঞ্চে বসালেন । একই কথার পুনরাবৃত্তি ।
একটু আগে মহারাজ লাউড স্পিকারে যা বললেন , তিনিও
পাখিপড়ার মত সেসব বুঝিয়ে দিলেন । একমাত্র মহারাজ যা বলেননি— পূর্বপুরুষদের বাড়ি কোথায় ছিল । সেটা পাণ্ডারা নাকি বারবার জিজ্ঞেস
করবে । স্বপনের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ বাবা ঠাকুরদার জন্ম বাংলাদেশের ঢাকা জেলায় ।
বর্তমান নিবাস উত্তরপাড়ায় । পঁয়ষট্টি বছর আগে ঠাকুরদা উত্তরপাড়ায় জায়গা কিনে
বাড়ি করেছিলেন । তবে ঢাকা জেলায় ঠিক কোথায় বাড়ি ছিল , সেসব স্বপন জানে না ।
পুরোহিত
বললেন ,“তাহলে আপনাকে বাংলাদেশের কথা
বলতেই হবে না । বলবেন উত্তরপাড়াতেই আদি বাড়ি । ঐ এক জায়গাতেই স্ট্রিক্ট থাকবেন
। কারণ বিভিন্ন জায়গার পাণ্ডা আলাদা আলাদা । শুধুমাত্র জেলা বললে হবে না । সাব
ডিভিশন , থানা এমনকি অঞ্চলের নামও বলতে হবে । ”
ওরা যখন বেরোল
ঘড়িতে তখন নটা বেজে পাঁচ মিনিট । পুরোহিত জিজ্ঞেস করলেন , কি
করবেন ? অটো ভাড়া করবেন ? না ঘোড়ার
গাড়িতে যাবেন ? স্বপন বলল ,“যেটা
সুবিধে হয়, তাই করুন । ”
পুরোহিত বললেন ,“অটো
নিলেই ভালো হয় । তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে । তবে ঘোড়ার গাড়িতে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া
কম ,দেড়শো টাকা নেবে । ”
গেটের বাইরে আশ্রমের
সম্মুখে সারি সারি অটো , ঘোড়ার গাড়ি , গাধার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । ওরা একটা অটো নিয়েই বেরিয়ে পড়ল । এখানে
ফিক্সড রেট । দরাদরির ব্যাপার নেই । অটোর দুশো টাকা ভাড়া । একেবারে পিণ্ডদানের
কাজ সমাধা করে অর্থাৎ যেখানে যেখানে যেতে হয় যাবে— শেষে
আশ্রমে পৌঁছে দিয়েই তার ডিউটি শেষ । মিনিট দশেক যাওয়ার পরেই পুরোহিত বললেন ,
“ এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াও । পিণ্ডদানের উপকরণগুলো কিনে নিয়ে আসি । ”
এদিকে স্বপনের
চায়ের নেশা । অন্তত সকালে এক কাপ না হলে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে । যদিও কাজ
সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত উপবাস থাকারই কথা । তবুও পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করল , “এক কাপ চা খাওয়া যাবে ঠাকুরমশাই ? ”
পুরুত বললেন , “ হ্যাঁ হ্যাঁ কেন যাবে না ? চা বিস্কুট খেয়ে নিন ।
আমার জন্যও বলুন । আমি জিনিসগুলো এনেই খাচ্ছি । জল , চা ,
বিস্কুটে কোনো দোষ নেই । ”
স্বপন শুধু এককাপ
চা খেল । তারপর একটা সিগারেট । নেশার বস্তু । না খেলে যেন শরীরটা কেমন আনচান করে ।
সর্বদা এক অস্বস্তি ভাব । ওরা প্রথম গেল ফল্গু নদীতে , যদিও
নদীতে এখন জল নেই । শুধু ধু ধু বালি । তবে সামান্য বালি তুললেই নাকি জল পাওয়া
যায় । ফল্গু নদীর উপকূলে ছোট এক মন্দির । মন্দিরে মা কালীর মূর্তি । পাশে চারদিক
খোলা বিশাল বড় এক ছাদের নিচে এক চাতাল । পুরোহিত স্বপনকে নিয়ে চাতালের এক কোণে
কুশাসন পেতে দুজনে মুখোমুখি বসল । সম্মুখে পিণ্ডদানের সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে রাখা
হয়েছে । পুরো চাতালটাতেই গোল গোল করে বসে অনেকেই পিণ্ডদানের কাজ করছেন । এরই মধ্যে
এক পাণ্ডা এসে জিজ্ঞেস করল , “কোথায় বাড়ি ? ”
স্বপন বলল ,“উত্তরপাড়া
। ”
পাণ্ডা জিজ্ঞেস
করলেন,“পূর্বপুরুষদের বাসস্থান কোথায় ছিল ?
”
স্বপন বলল ,“বাংলাদেশ
, ঢাকা । ”
শুনে পুরোহিত তো
হতবাক ! এর আগে আসার পথে জায়গায় জায়গায় অনেক পাণ্ডাই জিজ্ঞেস করেছিল কোথায়
বাড়ি । সব জায়গাতে একই কথা বলেছে— উত্তরপাড়া এবং
পূর্বপুরুষের বাড়িও উত্তরপাড়া । যা আগে বারবার করে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল ।
হঠাৎ আবার উলটপুরাণ কেন ? মতিভ্রম হলো নাকি লোকটার ?
পাণ্ডা
জিজ্ঞেস করল , “ ঢাকা জেলার কোন্ সাব ডিভিশন
? ”
স্বপন
বলল , “ আমার জানা নেই । ” পাণ্ডা বলল ,'ফোন করুন । ফোন করে জেনে নিন ।”
আড়াই হাজার সাব ডিভিশন । স্বপন সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বার করে
দিদিকে ফোন করল ।
ক্রমশ ……………
তৃতীয় পর্ব পড়ুন আগামী কাল
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।
তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।
তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।