ভারতীয় সমাজে
দোলপূর্ণিমা তথা দোলোৎসব এবং হোলিখেলা হাজার হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় দেদীপ্যমান
। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ ) দোলপূর্ণিমা তথা বসন্তপূর্ণিমাতে
শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের সূচনা করেন । বর্তমানে তা দেশ - বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে
। মধ্যযুগের বাংলার বিপ্লব তথা রেনেসাঁসের রূপকার শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি
হচ্ছে দোলপূর্ণিমা । কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যথার্থই লিখেছিলেন ,
“ বাঙালির হিয়া অমিয় মথিয়া / নিমাই ধরেছে কায়া । "
বাস্তবিকই বাঙালির হৃদয়মন্থন করে অমৃতরসে তাকে অভিসিঞ্চিত করতেই নিমাই তথা গৌরাঙ্গ তথা শ্রীচৈতন্য দেহীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন । ৮৯২ বঙ্গাব্দের
২৩ ফাল্গুন ( ১৪৮৬ খ্রিঃ ) দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় পিতা জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা
শচীদেবীর ঘর আলোকিত করে নদীয়ার নবদ্বীপে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন । বাল্যকালে
নিমাই , যৌবনে গৌরাঙ্গ বা গোরা এবং সন্ন্যাসগ্রহণের পর
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য নামধারী তাঁর জন্মতিথিকে ‘ গৌরপূর্ণিমা ' নামেও অভিহিত করা হয় ।
মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে (
তিরোভাব ১৫৩৩ খ্রিঃ ) শ্রীচৈতন্যদেব
জাতিকে মানবপ্রেমে দীক্ষিত করলেন । প্রচার করলেন -- জন্ম বড়ো কথা নয় , কর্মই বড়ো । জাতিভেদ ভুলে গিয়ে , উচ্চ - নীচ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে নিজেই তা দেখিয়ে দিলেন জাতিকে । মানবিক
মূল্যবোধে দীক্ষিত করলেন সাধারণ মানুষকে - যারা দীর্ঘদিন ধরে অচ্ছুৎ , ব্রাত্য , অপাংক্তেয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে
আসছিল । সৃষ্টি হলো চৈতন্য রেনেসাঁস তথা নবজাগরণ ।
‘আপনি আচরি ধর্ম শিখাও জীবেরে 'বাক্যের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি ছিলেন শ্রীচৈতন্য । তাঁর সেই জীবনাদর্শের
প্রভায় আলোকিত হলো বাঙালির রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ,সাহিত্য ও
সংস্কৃতির ইতিহাস এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধ তথা মানবতাবাদের ইতিহাস । তাঁর
সুবিখ্যাত উক্তি “ জীবে দয়া , নামে
রুচি , বৈষ্ণব সেবন / ইহা হৈতে ধর্ম আর নাহি সনাতন । ”
বাংলায় তুর্কি আক্রমণের
পরবর্তী সময়কালে উচ্চ - নীচ নির্বিশেষে বাঙালি সাধারণের মধ্যে পারস্পরিক মিলন -
সংহতির আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠেছিল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর । বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের
প্রথমভাগে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় ( অনুবাদসাহিত্য ,
মঙ্গলসাহিত্য , বৈষ্ণবসাহিত্য ইত্যাদিতে
) বাঙালি মননে অঙ্কুরিত নতুন মুক্তি বাসনাই বিভিন্ন ভাবে প্রসারিত হচ্ছিল । কিন্তু প্রচেষ্টা যতই মহৎ এবং বৃহৎ হোক – সর্বাত্মক কোন আদর্শের মধ্যে প্রসারিত হতে না পারলে তার পূর্ণাঙ্গতা
সম্ভব নয় । বাংলার জাতীয় জীবনের এই বৃহৎ প্রচেষ্টাকে নিজের জীবন সাধনার মধ্যে ধারণ করে পরিণামে তাকে একীভূত করার জন্যেই যেন
আবির্ভাব ঘটেছিল মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের ।
তুর্কি আক্রমণের আঘাতে
জাতীয় প্রাণচেতনায় মিলনশক্তির
অভিব্যক্তি ঘটেছিল । মহাপ্রভুর আবির্ভাবের ফলে সেটাই এক সুষ্ঠু সুবিন্যস্ত পরিণতি
লাভ করলো । এই কারণেই
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগকে চৈতন্য জীবনাঙ্ক চিহ্নিত করে
চৈতন্যপূর্ব যুগ ,চৈতন্য যুগ এবং চৈতন্যোত্তর যুগ হিসেবে
অভিহিত করা হয় । তদুপরি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যের জীবনী অবলম্বনেই
প্রথম জীবনী সাহিত্যের সূচনা হয় । প্রধান দু'টি
চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ হলো বৃন্দাবন দাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত '
এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ‘শ্রীচৈতন্য
চরিতামৃত'। জীবনীগ্রন্থগুলোতে সমকালীন সমাজ ,সংস্কৃতি ,ধর্ম ইত্যাদি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট
হয়েছে।'
পরিশেষে বলা যায় যে , শ্রীচৈতন্যদেব প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বে দেহান্তরিত হলেও তার পর থেকে শুরু করে বর্তমান সময় কালেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক । দেশের এবং সমাজের কল্যাণের জন্যে আমাদের শ্রীচৈতন্যকে স্মরণ , তাঁর বাণী ও শিক্ষার রূপায়ণ একান্ত প্রয়োজন । দোলোৎসব তথা বসন্তোৎসবের আবীরের ফোয়ারায় শুধু মেতে না থেকে অচৈতন্য স্বার্থান্ধতাকে ভেদ করে শ্রীচৈতন্যরূপী প্রাণের দেবতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে । শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব তিথিতে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।