তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য এখানেক্লিক করুন ।
কবিগুরু লিখেছেনঃ
নীলাম্বরে কিবা কাজ , তীরে
ফেলে এসো আজ ,
ঢেকে দিবে সব লাজ সুনীল জলে ।
( সোনার তরী : হৃদয়যমুনা )
আবার বিবসনা
প্রণয়িনীকে তিনি বলেছেন :
ফেলো গো বসন ফেলো- ঘুচাও অঞ্চল ।
পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ
সুরবালিকার বেশ কিরণবসন ।
পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল ,
জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা ।
( কড়ি ও কোমল : বিবসনা )
স্তন সম্বন্ধে কবি দুটি সনেট লিখেছেন । প্রথমে তিনি লিখেছেন স্তনের বাহ্য সৌন্দর্য সম্বন্ধেঃ
মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল
উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে ।
( কড়ি ও কোমল : স্তন )
কিন্তু তারপরও তিনি লিখেছেন নারীর পবিত্রতার কথা , তার শুভ্র জননীত্বের কথা,তার স্তন কবির কাছে প্রতিভাত হয়েছে 'দেবতাবিহারভূমি কনক - অচল ' বলে , কারণ :
ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি ,
দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।
( কড়ি ও কোমলঃ
স্তন )
কড়ি ও কোমল গ্রন্থে চুম্বন সম্বন্ধে যে সনেট আছে তাতে নর ও নারীর একান্তভাবে শারীর মিলনের কথাই কবি লিখেছেন । কাব্য হিসেবে এই সনেট নিকৃষ্ট না হলেও খুব উচ্চশ্রেণিরও নয় । কারণ এর মধ্যে কবিপ্রতিভার বিশিষ্ট ধারাটি নেই । কবিপ্রতিভা বিকশিত হয়েছে চৈতালি ( ১৮৯৭ ) -তে ‘প্রথম চুম্বন ' ও 'শেষ চুম্বন ' নামক সনেটে । এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন :
‘প্রথম চুম্বন’ সনেটে
দেখিতে পাই প্রণয়িনীর চুম্বনের আবেগ তাহাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে ;
জলের কলস্বরে , বনের মর্ম্মরে তটিনীর তীরে ও
নীরে তাহার স্পর্শ লাগিয়াছে, সমস্ত প্রকৃতি এই চুম্বনের
প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হইয়াছিল এবং চুম্বন সমাপ্ত হইলেই অনন্ত নক্ষত্রলোকে শিহরণ
জাগিয়া উঠিল ও দেবতার মন্দিরে আরতির শঙ্খ ঘণ্টা ধ্বনিত হইল । 'শেষ চুম্বন ' কাব্য ইহা অপেক্ষা নিকৃষ্ট ; কিন্তু তাহার মধ্যেও দেখিতে পাই শেষ চুম্বনের ম্লানিমা সমস্ত পৃথিবীতে
পরিব্যাপ্ত হইয়াছে , এমন কি দূরে স্বর্গে নীরব ভৈরবী
বাজিয়া উঠিয়াছে। দেহের মিলনের পরিপূর্ণ মাধুর্য্য আহরণ করিয়াও , কবি এই কথা কখনও ভোলেন নাই যে তাহা নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ নহে । ”
তাই তাঁর নায়িকা
নায়ককে সব কিছু দান করে , শুধু লজ্জাটুকু রাখতে চেয়েছে :
বসন্ত নিশীথে বঁধু ,
লহো গন্ধ , লহো মধু ,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো ।
দিয়ো দোল আশে - আশে ,
কোয়ো কথা মৃদু ভাষে –
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।
( সোনার তরী : লজ্জা )
উপরিউক্ত দৃষ্টান্ত হতে আর একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষিত হবে । রবীন্দ্রনাথ প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই নিরন্ত হননি ; প্রেমের বহিরাবরণের অন্তরালে যে অনির্বচনীয় রহস্য আছে তারও ব্যঞ্জনা দিয়েছেন এবং ঐ ব্যঞ্জনার জন্যই নর নারীর প্রেম অপূর্ব বৈচিত্র্য লাভ করেছে ।
মানসী ( ১৮৯০ )
কাব্যের ' গুপ্ত প্রেম ' , ' পুরুষের উক্তি ' , ' নারীর উক্তি ' প্রভৃতি কবিতা আলোচনা করলে দেখা যায় যে , পরিপূর্ণ
সম্ভোগের প্রতি লক্ষ থাকলেও কবির মন সেই প্রেমের মাধুর্যেই আকৃষ্ট হয়েছে যা আধ
চেনা , আধ অচেনা , যা সম্পূর্ণ হয়েও
রহস্যময় । 'ব্যক্তপ্রেম ' কবিতায় কবি
এর দীনতা দেখতে পেয়েছেন । তাঁর নায়িকা বলেছেঃ
ভাঙিয়া দেখিলে ছি ছি নারীর হৃদয় !
লাজে ভয়ে থরথর ভালোবাসা - সকাতর
তার লুকাবার ঠাঁই কাড়িল নিদয় !
( মানসী : ব্যক্তপ্রেম )
গুপ্তপ্রেম কাব্যের নায়িকার মন প্রকাশের বেদনায় ব্যাকুল হয়েছে ,কিন্তু যে প্রেম ব্যক্ত হয়েছে তা অভিব্যক্তির সঙ্গে নিজের অপরূপ মাধুর্য হারিয়েছে । পুরুষ নারীর কাছে তার প্রাপ্য যা কিছু তা পেয়ে প্রশ্ন করেছে :
কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে ,
রহিলে না ধ্যান - ধারণায় !
সেই মায়া - উপবন কোথা হল অদর্শন ,
কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকালো পাথার !
( মানসী পুরুষের উক্তি )
যখন আরো বেশি
কাছে এসে তর্ক করে প্রেম যাচাই করতে এসেছে ,তখন
নারী উত্তর দিচ্ছে :
মিছে তর্ক - থাক্ তবে থাক্ ।
কেন কাঁদি বুঝিতে পার না ?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই
মুছিলাম আঁখি –
শুধু চোখের জল ,এ
নহে ভর্ৎসনা ।
( মানসী নারীর উক্তি )
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রেমের কাব্যে অসাধারণ বিস্তৃতি এনেছেন । কবি মৃত্যুকে বরণীয় ,স্মরণীয় করে এঁকেছেন । মরমী কবি ও দার্শনিকগণ সাধারণত মৃত্যুকে জীবনের যবনিকা বলে স্বীকার করেন না, তাঁরা মৃত্যুর পরপারে অনন্ত জীবন কল্পনা করেন । রবীন্দ্রনাথ আরো একটু অগ্রসর হয়েছেন, তাঁর কাছে মরণ নিজেই প্রেমের মূর্তিতে দেখা দিয়েছে । রবীন্দ্রনাথের কাছে মরণ হচ্ছে বঁধু । বৈষ্ণব কবি বিশেষভাবে শারীর প্রেমের কবি । এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন : “পদাবলির নায়িকা রাধা মৃত্যুকে বরণীয় মনে করেছে শ্রীকৃষ্ণের বিরহে জর্জরিত হয়ে । তার কাছে মৃত্যু আপনা হতেই রমণীয় নয়। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিদের অনুসরণ করেছেন ভাবে , ভাষায় ও ছন্দে । কিন্তু দু'একটি পদে তাঁর প্রতিভার স্বকীয়তা ব্যক্ত হয়েছে । তাঁর রাধা মরণকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন :
মরণ রে ,
তুঁহু মম শ্যাম সমান ।
মেঘ বরণ তুঝ ,
মেঘ জটাজুট ,
রক্ত কমল কর ,
রক্ত অধরপুট ,
.... রাধা - হৃদয় তু কবহুঁ ন
তোড়বি
হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন
অতুলন তোঁহার লেহ ।
অন্যত্র কবি বলেছেনঃ
ওগো মৃত্যু ,
সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে
এসো বরবেশে ।
আমার পরানবধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া
বহু ভালোবেসে
ধরিবে তোমার বাহু ;
তখন তাহারে তুমি
মন্ত্ৰ পড়ি নিয়ো ,
রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বনদানে
পাণ্ডু করি দিয়ো ।
( সোনার তরী : প্রতীক্ষা )
এ তো গেল মৃত্যুর কথা । কবির বিশ্বাস যে , মৃত্যুর অন্তরালে গিয়ে প্রণয়িনী কখনো লুপ্ত হয় না; বরং বিশ্বের মধ্যে সে বিলীন হয়ে যায় । বিশ্বপ্রকৃতি তাকে পেয়ে নতুন সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয় আর প্রণয়ীর জীবনে মৃত - প্রণয়িনী অবিনশ্বর থাকে । স্মরণ ( ১৩০৯ ) কাব্যগ্রন্থে কবি স্বর্গতা প্রণয়িনীর উদ্দেশ্যে গাথা রচনা করছেন । এ কাব্যটি ব্যথা ও বিষাদে ভরা ; অথচ সাধারণ বিয়োগাত্মক কাব্যে যে
উদ্দাম শোকোচ্ছ্বোস , বিশ্ববিধানের বিরুদ্ধে যে আবেগময় বিদ্রোহ থাকে , এ কাব্যে তা নেই । এখানে গভীর শোক প্রশান্ত স্তব্ধতায় ভরা । কবি নিজেকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন যে , যে প্রণয়িনী এত আনন্দ দিয়েছিল,বিশ্বপ্রকৃতিকে যে এত মধুর করে তুলেছিল ,তার মাধুর্য লুপ্ত হতে পারে না । মৃত্যুর অন্তরালে কোনো এক অপরিচিত লোকে সে নিশ্চয়ই এক অক্ষয় ভাণ্ডার নিয়ে অবস্থান করছে । প্রিয়তমের চিঠি সে যেমন যত্ন করে রেখেছিল , নিশ্চয়ই পরপারে তেমনি স্নেহহস্তে তাকে কেউ রক্ষা করছে । যে আনন্দ সে লাভ করেছিল তা সে অমর করে রেখেছে , আর কবির জীবন সে অক্ষয় মাধুর্যে ভরপুর করে দিয়ে গেছে । কবি বলেছেন :
স্বল্প আয়ু এ জীবনে যে - কয়টি আনন্দিত দিন
কম্পিত - পুলকভরে , সংগীতের
- বেদনা - বিলীন ,
লাভ করেছিলে , লক্ষ্মী
, সে কি তুমি নষ্ট করি যাবে ?
সে আজি কোথায় তুমি যত্ন করি রাখিছ কী ভাবে
তাই আমি খুঁজিতেছি । সূর্যাস্তের স্বর্ণমেঘস্তরে
চেয়ে দেখি একদৃষ্টে - সেতা কোন করুণ অক্ষরে
লিখিয়াছ সে জন্মের সায়াহ্নের হারানো কাহিনী ।
( স্মরণ : ১৬ সংখ্যক কবিতা )
শঙ্কিত , ব্যথিত চিত্তে কবি এই বিশ্বাসে নিবিড় শান্তি অনুভব করেছেন যে , গৃহ হতে যে অমৃতময়ী অন্তর্হিত হয়েছে , নিখিল বিশ্বে সেই হারানো পরশের তিনি সন্ধান পাবেন।
(ক্রমশ)……………
পঞ্চম পর্ব পড়ুন
আগামী কাল
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। (৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।