Advt

Advt

Rabindranather Premer Kabitay Vaishnav Padabali Sahityer Probhab (4th Part) by Dr. Raghunath Bhattacharya, Bangladesh,Tatkhanik Digital, e magazine, Online Magazine

তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য এখানেক্লিক করুন ।

Rabindranather Premer Kabitay Vaishnav Padabali Sahityer Probhab (4th Part) by Dr. Raghunath Bhattacharya, Bangladesh,Tatkhanik Digital, e magazine, Online Magazine

কবিগুরু লিখেছেনঃ

 

নীলাম্বরে কিবা কাজ , তীরে ফেলে এসো আজ ,

ঢেকে দিবে সব লাজ সুনীল জলে ।

( সোনার তরী : হৃদয়যমুনা ) 


আবার বিবসনা প্রণয়িনীকে তিনি বলেছেন :


ফেলো গো বসন ফেলো- ঘুচাও অঞ্চল ।

পরো শুধু সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ

সুরবালিকার বেশ কিরণবসন ।

পরিপূর্ণ তনুখানি বিকচ কমল ,

জীবনের যৌবনের লাবণ্যের মেলা ।

( কড়ি ও কোমল : বিবসনা )

স্তন সম্বন্ধে কবি দুটি সনেট লিখেছেন । প্রথমে তিনি লিখেছেন স্তনের বাহ্য সৌন্দর্য সম্বন্ধেঃ

 

মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল

উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে ।

( কড়ি ও কোমল : স্তন )

 

কিন্তু তারপরও তিনি লিখেছেন নারীর পবিত্রতার কথা , তার শুভ্র জননীত্বের কথা,তার স্তন কবির কাছে প্রতিভাত হয়েছে 'দেবতাবিহারভূমি কনক - অচল ' বলে , কারণ :

 

ধরণীর মাঝে থাকি স্বর্গ আছে চুমি ,

দেবশিশু মানবের ওই মাতৃভূমি ।

( কড়ি ও কোমলঃ স্তন )

কড়ি ও কোমল গ্রন্থে চুম্বন সম্বন্ধে যে সনেট আছে তাতে নর ও নারীর একান্তভাবে শারীর মিলনের কথাই কবি লিখেছেন । কাব্য হিসেবে এই সনেট নিকৃষ্ট না হলেও খুব উচ্চশ্রেণিরও নয় । কারণ এর মধ্যে কবিপ্রতিভার বিশিষ্ট ধারাটি নেই । কবিপ্রতিভা বিকশিত হয়েছে চৈতালি ( ১৮৯৭ ) -তে প্রথম চুম্বন ' 'শেষ চুম্বন ' নামক সনেটে । এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন :

প্রথম চুম্বনসনেটে দেখিতে পাই প্রণয়িনীর চুম্বনের আবেগ তাহাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে ; জলের কলস্বরে , বনের মর্ম্মরে তটিনীর তীরে ও নীরে তাহার স্পর্শ লাগিয়াছে, সমস্ত প্রকৃতি এই চুম্বনের প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হইয়াছিল এবং চুম্বন সমাপ্ত হইলেই অনন্ত নক্ষত্রলোকে শিহরণ জাগিয়া উঠিল ও দেবতার মন্দিরে আরতির শঙ্খ ঘণ্টা ধ্বনিত হইল । 'শেষ চুম্বন ' কাব্য ইহা অপেক্ষা নিকৃষ্ট ; কিন্তু তাহার মধ্যেও দেখিতে পাই শেষ চুম্বনের ম্লানিমা সমস্ত পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হইয়াছে , এমন কি দূরে স্বর্গে নীরব ভৈরবী বাজিয়া উঠিয়াছে। দেহের মিলনের পরিপূর্ণ মাধুর্য্য আহরণ করিয়াও , কবি এই কথা কখনও ভোলেন নাই যে তাহা নিজের মধ্যেই সম্পূর্ণ নহে ।

 

তাই তাঁর নায়িকা নায়ককে সব কিছু দান করে , শুধু লজ্জাটুকু রাখতে চেয়েছে :


বসন্ত নিশীথে বঁধু ,

লহো গন্ধ , লহো মধু ,

সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো ।

দিয়ো দোল আশে - আশে ,

কোয়ো কথা মৃদু ভাষে

শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।

( সোনার তরী : লজ্জা )

উপরিউক্ত দৃষ্টান্ত হতে আর একটি বৈশিষ্ট্যও লক্ষিত হবে । রবীন্দ্রনাথ প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই নিরন্ত হননি ; প্রেমের বহিরাবরণের অন্তরালে যে অনির্বচনীয় রহস্য আছে তারও ব্যঞ্জনা দিয়েছেন এবং ঐ ব্যঞ্জনার জন্যই নর নারীর প্রেম অপূর্ব বৈচিত্র্য লাভ করেছে ।

মানসী ( ১৮৯০ ) কাব্যের ' গুপ্ত প্রেম ' , ' পুরুষের উক্তি ' , ' নারীর উক্তি ' প্রভৃতি কবিতা আলোচনা করলে দেখা যায় যে , পরিপূর্ণ সম্ভোগের প্রতি লক্ষ থাকলেও কবির মন সেই প্রেমের মাধুর্যেই আকৃষ্ট হয়েছে যা আধ চেনা , আধ অচেনা , যা সম্পূর্ণ হয়েও রহস্যময় । 'ব্যক্তপ্রেম ' কবিতায় কবি এর দীনতা দেখতে পেয়েছেন । তাঁর নায়িকা বলেছেঃ


ভাঙিয়া দেখিলে ছি ছি নারীর হৃদয় !

লাজে ভয়ে থরথর ভালোবাসা - সকাতর

তার লুকাবার ঠাঁই কাড়িল নিদয় !

( মানসী : ব্যক্তপ্রেম )

গুপ্তপ্রেম কাব্যের নায়িকার মন প্রকাশের বেদনায় ব্যাকুল হয়েছে ,কিন্তু যে প্রেম ব্যক্ত হয়েছে তা অভিব্যক্তির সঙ্গে নিজের অপরূপ মাধুর্য হারিয়েছে । পুরুষ নারীর কাছে তার প্রাপ্য যা কিছু তা পেয়ে প্রশ্ন করেছে :

 

কেন তুমি মূর্তি হয়ে এলে ,

রহিলে না ধ্যান - ধারণায় !

সেই মায়া - উপবন কোথা হল অদর্শন ,

কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকালো পাথার !

( মানসী পুরুষের উক্তি )

 

যখন আরো বেশি কাছে এসে তর্ক করে প্রেম যাচাই করতে এসেছে ,তখন নারী উত্তর দিচ্ছে :

 

মিছে তর্ক - থাক্ তবে থাক্ ।

কেন কাঁদি বুঝিতে পার না ?

তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই মুছিলাম আঁখি

শুধু চোখের জল ,এ নহে ভর্ৎসনা ।

( মানসী নারীর উক্তি )

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রেমের কাব্যে অসাধারণ বিস্তৃতি এনেছেন । কবি মৃত্যুকে বরণীয় ,স্মরণীয় করে এঁকেছেন । মরমী কবি ও দার্শনিকগণ সাধারণত মৃত্যুকে জীবনের যবনিকা বলে স্বীকার করেন না, তাঁরা মৃত্যুর পরপারে অনন্ত জীবন কল্পনা করেন । রবীন্দ্রনাথ আরো একটু অগ্রসর হয়েছেন, তাঁর কাছে মরণ নিজেই প্রেমের মূর্তিতে দেখা দিয়েছে । রবীন্দ্রনাথের কাছে মরণ হচ্ছে বঁধু । বৈষ্ণব কবি বিশেষভাবে শারীর প্রেমের কবি । এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন : পদাবলির নায়িকা রাধা মৃত্যুকে বরণীয় মনে করেছে শ্রীকৃষ্ণের বিরহে জর্জরিত হয়ে । তার কাছে মৃত্যু আপনা হতেই রমণীয় নয়। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব কবিদের অনুসরণ করেছেন ভাবে , ভাষায় ও ছন্দে । কিন্তু দু'একটি পদে তাঁর প্রতিভার স্বকীয়তা ব্যক্ত হয়েছে । তাঁর রাধা মরণকে উদ্দেশ্য করে বলেছে :

 

মরণ রে ,

তুঁহু মম শ্যাম সমান ।

মেঘ বরণ তুঝ ,

মেঘ জটাজুট ,

রক্ত কমল কর , রক্ত অধরপুট ,

.... রাধা - হৃদয় তু কবহুঁ ন তোড়বি

হিয় হিয় রাখবি অনুদিন অনুখন

অতুলন তোঁহার লেহ ।

অন্যত্র কবি বলেছেনঃ

 

ওগো মৃত্যু , সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে

       এসো বরবেশে ।

আমার পরানবধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া

       বহু ভালোবেসে

ধরিবে তোমার বাহু ; তখন তাহারে তুমি

       মন্ত্ৰ পড়ি নিয়ো ,

রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বনদানে

       পাণ্ডু করি দিয়ো ।

    ( সোনার তরী : প্রতীক্ষা )

এ তো গেল মৃত্যুর কথা । কবির বিশ্বাস যে , মৃত্যুর অন্তরালে গিয়ে প্রণয়িনী কখনো লুপ্ত হয় না; বরং বিশ্বের মধ্যে সে বিলীন হয়ে যায় । বিশ্বপ্রকৃতি তাকে পেয়ে নতুন সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয় আর প্রণয়ীর জীবনে মৃত - প্রণয়িনী অবিনশ্বর থাকে । স্মরণ ( ১৩০৯ ) কাব্যগ্রন্থে কবি স্বর্গতা প্রণয়িনীর উদ্দেশ্যে গাথা রচনা করছেন । এ কাব্যটি ব্যথা ও বিষাদে ভরা ; অথচ সাধারণ বিয়োগাত্মক কাব্যে যে

উদ্দাম শোকোচ্ছ্বোস , বিশ্ববিধানের বিরুদ্ধে যে আবেগময় বিদ্রোহ থাকে , এ কাব্যে তা নেই । এখানে গভীর শোক প্রশান্ত স্তব্ধতায় ভরা । কবি নিজেকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন যে , যে প্রণয়িনী এত আনন্দ দিয়েছিল,বিশ্বপ্রকৃতিকে যে এত মধুর করে তুলেছিল ,তার মাধুর্য লুপ্ত হতে পারে না । মৃত্যুর অন্তরালে কোনো এক অপরিচিত লোকে সে নিশ্চয়ই এক অক্ষয় ভাণ্ডার নিয়ে অবস্থান করছে । প্রিয়তমের চিঠি সে যেমন যত্ন করে রেখেছিল , নিশ্চয়ই পরপারে তেমনি স্নেহহস্তে তাকে কেউ রক্ষা করছে । যে আনন্দ সে লাভ করেছিল তা সে অমর করে রেখেছে , আর কবির জীবন সে অক্ষয় মাধুর্যে ভরপুর করে দিয়ে গেছে । কবি বলেছেন :

 

স্বল্প আয়ু এ জীবনে যে - কয়টি আনন্দিত দিন

কম্পিত - পুলকভরে , সংগীতের - বেদনা - বিলীন ,

লাভ করেছিলে , লক্ষ্মী , সে কি তুমি নষ্ট করি যাবে ?

সে আজি কোথায় তুমি যত্ন করি রাখিছ কী ভাবে

তাই আমি খুঁজিতেছি । সূর্যাস্তের স্বর্ণমেঘস্তরে

চেয়ে দেখি একদৃষ্টে - সেতা কোন করুণ অক্ষরে

লিখিয়াছ সে জন্মের সায়াহ্নের হারানো কাহিনী ।

            ( স্মরণ : ১৬ সংখ্যক কবিতা )

শঙ্কিত , ব্যথিত চিত্তে কবি এই বিশ্বাসে নিবিড় শান্তি অনুভব করেছেন যে , গৃহ হতে যে অমৃতময়ী অন্তর্হিত হয়েছে , নিখিল বিশ্বে সেই হারানো পরশের তিনি ন্ধান পাবেন।

 

(ক্রমশ)……………

পঞ্চম পর্ব পড়ুন আগামী কাল

 

লেখক পরিচিতি 

রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ নবযুগ কলেজ ধামরাই ঢাকা ।

প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। (৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।