প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
তিন
রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সে লেখা ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী আমাদের বিস্মিত করে । বৈষ্ণব কবিদের ভাবগম্ভীরতা কিশোর কবির রচনায় প্রত্যাশিত ছিল না । তবে শব্দ - ঝংকার ও ছন্দ - লালিত্য মিলিয়ে সৌন্দর্য - সৃষ্টিতে অনেকখানি সাফল্য যে কবি লাভ করেছেন তা স্বীকার্য । ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রচনার পূর্বে কবি অক্ষয় চৌধুরীর কাছে শুনেছিলেন T. Rowlie ছদ্মনামে চ্যাটার্টান ( ১৭৫২-১৭৭০ ) কর্তৃক প্রাচীন ইংরেজ কবিদের অনুকরণের কথা । কিশোর কবির মনে তখন বৈষ্ণব কবিতার অনুকরণে এই ধরনের কবিতা রচনার প্রেরণা জাগে ।
রবীন্দ্রনাথ
তাঁর কিশোরকালীন কাব্যগ্রন্থাদির অত্যন্ত নির্মম সমালোচক । ভানুসিংহ ঠাকুরের
পদাবলী'-তে প্রাচীন বৈষ্ণবপদকর্তাদের
ধর্মীয় সাধনা বা ভাবের আবেগ না থাকলেও কিশোর কবির রোমান্টিক প্রেমচেতনা এখানে
রাধাকৃষ্ণের রূপকের অন্তরালে ব্যক্ত হয়েছে । বৈষ্ণবকাব্য পাঠের প্রভাবে কিশোর
কবির মন আরো অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছিল এবং জয়দেব , বিদ্যাপতি
, গোবিন্দদাস , জ্ঞানদাস প্রমুখ
বৈষ্ণব কবির ভাব , ভাষা ও ছন্দের আদর্শ কিশোর কবির
অন্তরের প্রেমানুভূতি প্রকাশে সহায়ক হয়েছে ।
কাব্য
রচনার সেই উন্মেষকালে কিশোর কবি পূর্বতন শক্তিশালী কবিদের মনোরাজ্যে পরিভ্রমণ
করেছেন এবং তাদের অনুসরণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন । ভানুসিংহের শ্রীরাধা বৈষ্ণব
মহাজন কল্পিত শ্রীরাধা থেকে স্বতন্ত্র । এ প্রসঙ্গে ড . জলি সেনগুপ্ত তাঁর গ্রন্থে
ক্ষুদিরাম দাসের একটি উদ্ধৃতি উদ্ধৃত করে বলেছেন :
অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস বৈষ্ণবীয় রাধার সঙ্গে ভানুসিঙ্ঘের
রাধার তুলনা করে বলেছেন যে, পদাবলীর রাধার আর্তি এখানে অবিদ্যমান
কিন্তু তার পরিবর্তে কিশোর আধুনিক কবির প্রকৃতি সৌহার্দ্যের বশে কল্পিত কোনো
কিশোরীর মুগ্ধ ভাববিকাশের নিজস্ব অস্ফুট চিত্রাঙ্কন এখানে লক্ষ্য করা যায় । নলিনী
- মুরজার পূর্বেকার চিত্র এবং পরবর্তী 'কড়ি ও কোমল '
- এর যৌবনোচ্ছ্বাসের স্বকীয় সুরই ভানুসিংহের পদাবলীর
প্রেমচেতনায় প্রকাশ পেয়েছে ।
ভানুসিংহ
ঠাকুরের পদাবলী'-তে কবি বৈষ্ণব কবিদের আদর্শ
অনুসরণ করেছেন । এখানে তাঁর প্রেমভাবনা সমকালীন অন্যান্য গাথা বা গীতিকবিতা থেকে
স্বতন্ত্র ও অপেক্ষাকৃত পরিণত। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'-তে
বিশটি খণ্ড কবিতা সংকলিত হয়েছে । এই বিশটি কবিতা আবার একসঙ্গে লেখা হয়নি ।
রবীন্দ্রনাথের ষোল থেকে চব্বিশ - পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে এই কবিতাগুলো রচিত
হয়েছিল।
ভানুসিংহের
প্রথমপদে বসন্ত - সমাগমে প্রকৃতির আনন্দ হিল্লোলের পরিপ্রেক্ষিতে বিরহিণী রাধার
বিলাপ :
বিদ্যাপতি
–
ফুটল কুসুমরে কুঞ্জকুটীর বন ,
কোকিলপঞ্চম গাওইবে ,
মলয়ানিল হিমশিখরসি ধাবল
পিয়া নিজ দেশ ন আওইরে ।
বিদ্যাপতির
উপর্যুক্ত পদটির সঙ্গে ভানুসিংহের প্রথম বসন্ত বর্ণনার পদটির তুলনা করা যায় :
বসন্ত আওল রে !
মধুকর গুন গুন ,
অমুয়া মঞ্জরী
কানন ছাওল রে ।
শুন শুন সজনী হৃদয় প্রাণ মম
হরখে আকুল ভেল ,
জর জর রিঝসে দুখ জ্বালা সব
দূর দূর চলি গেল ।
কবি
জয়দেবও গীত - গোবিন্দ কাব্যের শুরুতে বসন্ত সমাগমে বিরহ - ব্যাকুলা রাধার বর্ণনা
দিয়েছেন :
ললিতলবঙ্গলতাপরিশীলনকোমলমলয়সমীরে ।
মধুকরনিকরকরন্বিতকোকিলকুজিতকুঞ্জকুটীরে ।
বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে
নৃত্যতি যুবতিজনেন সমং সখি বিরহিজনস্য দুরন্তে ।
( প্রথম সর্গ :
২৮ )
আবার ভানুসিংহ ঠাকুরে পদাবলী'র সূচনাতেও সেইরূপ বসন্তের আনন্দময় পরিবেশে রাধার বিলাপ ও দুঃখের
বর্ণনা দেয়া হয়েছে ।
বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন
কহিছে - দুখিনী রাধা ,
কঁহি রে সো প্রিয় , কঁহি
সো প্রিয়তম ,
হৃদিবসন্ত সো মাধা ?
ভানু কহত অতি গহন রয়ন অব ,
বসন্তসমীর শ্বাসে
মোদিত বিহ্বল চিত্তকুঞ্জতল
ফুল্ল বাসনা - বাসে ।
দ্বিতীয়পদটিতে সখীরা কোথাও শ্যামকে পেলেন না এবং তৃতীয়পদে
কৃষ্ণ বিরহে কাতর রাধার বর্ণনা , চতুর্থপদে
সখী মথুরায় গিয়ে রাধার দুঃখের কথা জানালেন কৃষ্ণকে এবং পঞ্চমপদে কৃষ্ণের
আগমনবার্তা সখী রাধাকে দিলেন :
মৃদুলগমন
শ্যাম আওয়ে
মৃদুল
গান গাহিয়া ।
যষ্ঠপদে রাধাকৃষ্ণের মিলন ঘটেছে ,
এই ছয়টিপদে ঘটনার পারম্পর্য আছে । সপ্তমপদে বাঁশির আহ্বানে
চলেছেন রাধা এবং অষ্টমপদে রাধার অভিসারের সুন্দর বর্ণনা । মহাজন পদকর্তার মতো
ভানুসিংহও শ্রীগোবিন্দ শ্যামের ‘পদারবিন্দ ' বন্দনা করেছেন । নবমপদে রাধা অন্ধকার কুণ্ডে প্রতীক্ষা করার সময়
কৃষ্ণের বাঁশির শব্দ শুনলেন ।
জয়দেবের ছন্দের সুর এই পদে আশ্চর্যভাবে ফুটে উঠেছে :
পততি পতত্ৰে বিচলিতপত্রে
শঙ্কিত
ভবদুপযানম্ ।
রচয়তি শয়ন সচকিতনয়ং
পশ্যতি
তব পন্থানম্ ।
( গীতগোবিন্দম্ : পঞ্চম সর্গ ,
১১ সংখ্যক পদ )
তুলনীয়ঃ
সতিমির
রজনী, সচকিত সজনী
শূন্য নিকুঞ্জ অরণ্য ।
কলয়িত
মলয়ে, সুবিজন নিলয়ে
বালা বিরহ বিষণ্ণ !
দশমপদে রাধা
বলেছেন , বাজাও রে মোহন বাঁশি । এভাবে প্রেম
নিবেদনের পর একাদশপদে উভয়ের মিলনের বর্ণনা । এই মিলনের বর্ণনা আনন্দহিল্লোল কবি
তাঁর শব্দচয়ন নৈপুণ্য ও ছন্দবৈচিত্রের সাহায্যে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ।
দ্বাদশপদে নিশা অবসানে কবি ভানুসিংহ বিলাপ করে বলেছেন : -
রবি অতি নিষ্ঠুর
নলিন - মিলন অভিলাষে
কত নরনারীক মিলন টুটাওত
ডারত বিরহ - হুতাশে ।
ত্রয়োদশপদে রাধা
ও চতুর্দশপদে শ্রীকৃষ্ণের বর্ষাভিসার এবং পঞ্চদশপদে মানিনী রাধার অনুতাপ বর্ণিত
হয়েছে । ষোড়শপদে রাধার সখী মথুরা থেকে ফিরে এলে সপ্তদশপদে রাধা সখীর প্রতি
অনুযোগ করেছেন । অষ্টাদশপদে রাধা তার মৃত্যুর পর শ্যাম কী করবেন তাই নিয়ে সখীর
সঙ্গে আলোচনা করেছেন , ভানুসিংহের রাধা কল্পনা করেছেন যে
তাঁর মৃত্যু হলেও কৃষ্ণের দুঃখের কিছু থাকবে না । কারণ :
হম যব যাওব শত শত রাধা
চরণে রহবে তারি ।
প্রাচীন বৈষ্ণব
কবির রাধার তুলনায় ভানুসিংহের রাধার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি বাস্তবতামণ্ডিত ও
স্পষ্ট । ষোড়শপদটির কাব্যসৌন্দর্য অতুলনীয় । কৃষ্ণ মথুরা গমনে উদ্যত হলে রাধা
তাকে বাধা দেবেন না বলেই স্থির করেছিলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর ‘টুটিয়া
গইল পণ ' । কৃষ্ণচরণে সমর্পিত প্রাণ রাধার করুণ আর্তি
ব্রজবুলি ভাষার সাহায্যে প্রকাশ করেছেন কবি ভানুসিংহ :
রহ তুঁহু , রহ তুঁহু ,
বঁধু গো রহু তুঁহু ,
অনুখন সাথ সাথ রে রহ পঁহু ,
তুঁহু বিনে মাধব , বল্লভ
, বান্ধব ,
আছয় কোন্ হমার !
( ১৬ সংখ্যক পদ )
উনিশসংখ্যক পদটি
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত । এই পঙ্ক্তিটি হলো- ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান ' । এই পদে মৃত্যুকে শ্যামরূপে কল্পনা করা হয়েছে । বৈষ্ণব পদকর্তারা
মৃত্যুকে ‘শ্যাম সমান 'বলেননি ,
‘মৃত্যুকে শ্যামসম ' কল্পনা ভানুসিংহের নিজস্ব
ভাবনা । শেষপদ ‘ কো তুঁহু বোলবি মোয় ' ১২৯৩ বঙ্গাব্দে কড়ি ও কোমল - এর প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত হয় , তখন কবির বয়স পঁচিশ বছর । প্রেম নিবেদনের এই সর্বশেষ পদটি কাব্য
সৌন্দর্যে অতুলনীয় । এই 'মরণরে তুঁহু মম ' এবং 'কো তুঁহু বোলবি মোয় ' পদদুটিকে
সঞ্চয়িতা’-য় কবি নিজেই স্থান দিয়েছিলেন ।
ভানুসিংহ ঠাকুরের
পদাবলী'তে এত সুন্দর সুন্দর পদ থাকা সত্ত্বেও
কবি এই কাব্যটিকে সাহিত্যে একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত 'বলেই গণ্য করেছেন । কারণ বৈষ্ণব পদাবলিতে যেমন বৈষ্ণবীয় রাগানুরাগা ভজন
সাধনার সঙ্গে শিল্পরীতির সমন্বয় ঘটেছিল এখানে তা ঘটেনি । ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ
বারবার বলেছেন : “পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয় , তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত । সেই সীমানার
মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না ।
সোনার তরী ( ১৮৯৪
) কাব্যের বৈষ্ণব কবিতায় কবি স্পষ্টতই প্রশ্ন তুলেছেন ( ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ) :
শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান !
………এ কি শুধু দেবতার
!
এ সংগীতরসধারা নহে মিটাবার
দীন মর্তবাসী এই নরনারীদের
প্রতিরজনীর আর প্রতিদিবসের
তপ্ত প্ৰেমতৃষা ?
দেবতাকে
প্রিয় এবং প্রিয়কে দেবতা কল্পনা করার দীক্ষা কবি বৈষ্ণব পদাবলিতে লাভ করেছেন । তাই
ভানুসিংহ ছদ্মবেশী বৈষ্ণব পদাবলি রচয়িতা হলেও তার অনুকরণ প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি ।
কড়ি ও কোমল এবং মানসী'-র কয়েকটি কবিতায় পদাবলির প্রত্যক্ষ
প্রভাব আছে । পদাবলির ভাষা ও ভঙ্গি ,ছন্দ ও সুর ,ভাব ও বেদনা নিরন্তর কবিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে ।
(ক্রমশ) ………………।
তৃতীয় পর্ব পড়ুন
আগামীকাল, বুধবার (০৯.০২.২০২২)
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। (৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।