সারসংক্ষেপ
রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতায় বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব
অপরিসীম । তিনি বৈষ্ণব কবিতাকে বিচার করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র কবিসত্তা দিয়ে ।
বৈষ্ণব দর্শনকে তিনি দেখেছেন রোমান্টিক গীতিকবিতার স্বপ্নলোকে । তাঁর প্রেমের
কবিতার বৈশিষ্ট্য বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নর - নারীর হৃদয়ের সংযোগের সন্ধান ;
সামান্যের মধ্যে অসামান্যের পরিকল্পনা , মানবীর মধ্যে মানসীর আবিষ্কার । পদাবলির আধ্যাত্মিক চেতনাকে ছাপিয়ে
কবি সেখানে মানবীয় প্রেমের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন । আলোচ্য প্রবন্ধে এ বিষয়টিই তুলে
ধরার চেষ্টা করা হয়েছে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (
১৮৬১-১৯৪১ ) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর প্রতিভা । সাহিত্যের প্রায়
প্রতিটি শাখা তাঁর অসামান্য অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে । তন্মধ্যে কাব্যসাহিত্য অন্যতম।
তাঁর কাব্য মুখ্যত গীতিধর্মী । কবির কাব্যে রয়েছে এক অখণ্ড জীবনবোধের তাৎপর্য,
অনির্বচনীয় আনন্দ ও সৌন্দর্যচেতনা এবং মানব ও বিশ্বের প্রতি
সুগভীর অনুরাগ । বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের প্রেম ও সৌন্দর্যবোধ তাঁকে এক্ষেত্রে
অনুপ্রাণিত করেছে ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে
বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব অপরিসীম । বৈষ্ণব পদাবলী
সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর আবাল্য পরিচয় । ধর্মে ব্রাহ্ম হওয়া
সত্ত্বেও ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় যাত্রা কীর্তন ও পাঁচালীর আসরের মধ্য থেকেই বালক
রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলির স্বাদ পেয়েছিলেন । তিনি কৈশোরকাল থেকে শেষজীবন
পর্যন্ত বৈষ্ণব পদাবলির রসজ্ঞ পাঠক ছিলেন । অজিত কুমার বেরার মতে :
তাঁদের পারিবারিক গ্রন্থাগারে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রায় সব
গ্রন্থই ছিল , তিনি এই গ্রন্থাগারেই
অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র
সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী সংকলন (১৮৭৪-৭৭ ) পড়েছিলেন , বয়সে
রবীন্দ্রনাথ তখন ১৩-১৪ বছরের বালক । চণ্ডীদাসের সরল ভাষায় লেখা ধ্বনি ঝঙ্কারে
ভরপুর পদগুলি কিশোর কবিকে মুগ্ধ করেছিল , যা তাঁকে প্রাচীন
কবিদের আদর্শে ও ভাষায় পদ রচনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল ।
বৈষ্ণব সাহিত্য পাঠ ও আলোচনা
প্রসঙ্গে কবি নিজেই বলেছেন :
শ্রীযুক্ত সারদাচরণ মিত্র ও অক্ষয় সরকার মহাশয়ের প্রাচীনকাব্যসংগ্রহ সে -
সময়ে আমার কাছে একটি লোভের সামগ্রী হইয়াছিল । গুরুজনেরা ইহার গ্রাহক ছিলেন
কিন্তু নিয়মিত পাঠক ছিলেন না । সুতরাং এগুলি জড়ো করিয়া আনিতে আমাকে বেশি কষ্ট
পাইতে হইত না। বিদ্যাপতির দুর্বোধ্য বিকৃত মৈথিলী পদগুলি অস্পষ্ট বলিয়াই বেশি
করিয়া আমার মনোযোগ টানিত । আমি টীকার উপর নির্ভর না করিয়া নিজে বুঝিবার চেষ্টা
করিতাম । বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ যেখানে যতবার ব্যবহৃত হইয়াছে সমস্ত আমি একটি ছোটো
বাঁধানো খাতায় নোট করিয়া রাখিতাম। ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলিও আমার বুদ্ধি - অনুসারে যথাসাধ্য টুকিয়া রাখিয়াছিলাম।
শৈশবেই এমন করে বৈষ্ণব পদাবলি
যিনি পড়েছিলেন উত্তর জীবনের কাব্যে , ভাবে ও ভাষায় ,
ছন্দে ও কল্পনায় বৈষ্ণব পদকর্তাদের স্পর্শ লাগবে তাতে আর বিচিত্র
কি ? বৈষ্ণব পদগুলোর নিবিড় ভাবোপলব্ধি কিশোর কবির চিত্তকে
মুগ্ধ করেছিল ; আর সেই সাথে বৈষ্ণব কবিতার ভাষার সহজ
ললিতগীতি এবং গীতিমাধুর্যও তাঁর কবিপ্রাণে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছিল পরবর্তী
জীবনে কখনো তা বিস্তৃত হয়নি । মহাকবি কালিদাস ( আনু . খ্রি . পূর্ব ১ ম /
খ্রিষ্টীয় ৪ র্থ শতক ) ছাড়া ভারতবর্ষের প্রাচীন কবিদের মধ্যে এই বৈষ্ণব
পদকর্তাদের মতো আর কেউ রবীন্দ্রনাথের উপর এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি ।
ষোলো ও সতেরো শতক বৈষ্ণব পদাবলি
সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ । উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে পদাবলি রচনার তেমন প্রচলন ছিল
না । আধুনিক যুগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ( ১৮২৪-১৮৭৩ ) ব্রজাঙ্গনা ( ১৮৬১) কাব্যে
বৈষ্ণবভাবের কবিতা রচনা করেন । ব্রজভাষা ব্যবহার না করলেও মধুসূদন তাঁর লিরিক্যাল
আকুতি প্রকাশের মাধ্যম রূপে রাধা - কৃষ্ণের রূপক ব্যবহার করেন এবং ব্রজাঙ্গনা’-য় কৃত্রিম বৈষ্ণব পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেন ।
কবি জয়দেব ( ১২ শ শতক )
স্বরচিত মধুর কোমলকান্ত সংগীতের নাম দিয়েছেন ‘পদাবলি
'। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় এই পদাবলি শব্দটি গ্রহণ করেছেন
। চৈতন্যদেবের ( ১৪৮৬-১৫৩৩ ) পূর্ববর্তী কবি বিদ্যাপতি ( আনুমানিক ১৩৭৪-১৪৬০
খ্রিষ্টাব্দ ) ও চণ্ডীদাসের ( ১৪ শ শতক ) এবং পরবর্তী কবি রায়শেখর ,কবিরঞ্জন প্রভৃতির রচিত সংগীতসমূহ পদাবলি নামে অভিহিত হয়ে আসছে । বাংলা
ভাষায় রচিত পদাবলির ভাষা সাধারণত ' ব্রজবুলি ' নামে পরিচিত । এই ব্রজবুলি শ্রীবৃন্দাবন , মথুরা
অঞ্চলের ভাষা নয় । ব্রজবুলি বৈষ্ণব কবিতার ভাষা , কবিগুণের
সৃষ্ট কৃত্রিম ভাষা । মিথিলার দেশীয় ভাষার মিশ্রণে আসাম , বাংলাদেশ
, উড়িষ্যায় একই সময়ে এর উদ্ভব হয়েছিল । মিথিলার
বিদ্যাপতি মৈথিল ভাষায় পদ রচনা করেছিলেন । বাংলাদেশে তা ব্রজবুলিতে রূপান্তরিত
হয়েছে ।
বৈষ্ণব পদাবলি বৈষ্ণবতত্ত্বের
রসভাষ্য । বৈষ্ণবের তত্ত্ব যেন রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার মধ্য দিয়ে রস - নির্ঝরিণীর
প্রবাহে স্নাত ও পূত । পরমাত্মা ও জীবাত্মার নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক
আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতার ধ্বনি উপস্থাপিত হয়েছে বৈষ্ণবতত্ত্বে । পরমাত্মা নিরন্তর
আহ্বান করছেন জীবাত্মাকে । সেই আহ্বানে সারা দিতে গিয়ে জীবাত্মা চলেছে ত্যাগ -
সর্বস্বতাকে আশ্রয় করে । শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক ; আর
শ্রীরাধা জীবাত্মার প্রতীক । ত্যাগের পথে- দুঃখের পথে পরমাত্মা ও জীবাত্মার
দুর্নিবার মিলন সম্ভব হয় । মানবিক প্রেমের অন্তরালে এক আধ্যাত্মিক চেতনাকে
প্রতিষ্ঠিত করেছেন বৈষ্ণব কবিগণ । বৈষ্ণব পদাবলিতে বৈষ্ণবতত্ত্বের অন্তরালে সদা
প্রমূর্ত হয়ে আছে একটি নিরপেক্ষ মানবিক আবেদন । এই মানবিক আবেদন ব্যক্তির সংকীর্ণ
সীমা অতিক্রম করে একটি সার্বজনীন আবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
বৈষ্ণব কবিতার যে আকুলতা , অপ্রাপ্যকে
পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা , জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির
মধ্যে যেমন রোমান্টিকতার লক্ষণ প্রকট ,তেমনি আধুনিক
গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য - লক্ষণও বর্তমান । বৈষ্ণব পদাবলির কবিগণ মানবীয় পরিবেশের ও
পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে রসরাজ শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনা করেছেন এবং তাঁদের
ব্যক্তিগত অভিপ্রায় , কামনা কোথাও প্রকাশিত হয়নি ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈষ্ণব
কবিতাকে বিচার করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র কবিসত্তা দিয়ে। তিনি বৈষ্ণব দর্শনকে দেখেছেন
রোমান্টিক গীতিকবিতার স্বপ্নলোকে । কবির প্রেমের কবিতা আলোচনা করতে হলে বৈষ্ণব
কবিতার সঙ্গে তার সংযোগ ও পার্থক্য অনুধাবন করা প্রয়োজন । রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব
কবিদের কাছে ঋণী । তিনি পদাবলি সাহিত্যের দ্বারা
যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর বৈষ্ণব কবিতা ,
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী । অন্যান্য কবিতায়ও পদাবলি সাহিত্যের
প্রভাব লক্ষিত হয়। অথচ রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সঙ্গে পদবলি সাহিত্যের বৈষম্যও
রয়েছে যথেষ্ট ।
বৈষ্ণব পদাবলিতে
ব্যাপকতার অভাব দেখা যায় । তার একটি লক্ষণ এই শ্রীরাধার সঙ্গে বিশ্বপ্রকৃতির
সংযোগ নেই । শ্রীরাধা একজন নায়িকা মাত্র । এই বিস্তৃতিও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের
কবিতায় বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব । ব্যাপকতা রবীন্দ্রনাথের কাব্যের
বৈশিষ্ট্য । তিনি বৈষ্ণবকাব্য ও অন্যান্য কবির প্রেমের কবিতার তীব্রতা অটুট রেখে
তার মধ্যে বিরাট ব্যাপকতা আনতে চেষ্টা করেছেন । তাঁর প্রথম বয়সের ‘যৌবনস্বপ্ন ' কবিতায় কবি বলেছেন :
আমার যৌবনস্বপ্নে যেন ছেয়ে আছে বিশ্বের আকাশ ।
ফুলগুলি গায়ে এসে পড়ে রূপসীর
পরশের মতো।
………
কে আমারে করেছে পাগল-- শূন্যে কেন চাই আঁখি
তুলে !
যেন কোন্ উর্বশীর আঁখি চেয়ে
আছে আকাশের মাঝে !
(কড়ি ও কোমল)
দুই
রবীন্দ্রনাথ প্রায় ষোল
বছর বয়সে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র (
১৮৮৪ ) কবিতাগুলো লিখতে শুরু করেন। কবি কাহিনী ( ১৮৭৮ ) রচনারও পূর্বে এটি রচিত
হয় । এর পর কবির বিভিন্ন সময়ে কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়
মালতীপুঁথি নামক কাব্যের মধ্যে । এ পুঁথির কবিতাগুলো কোনো পত্র পত্রিকায় বা
গ্রন্থে মুদ্রিত হয়নি । পুঁথির কাল আনুমানিক ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সম্ভবত ১৮৮৬
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত । মুম্বাই ,আমেদাবাদ এমনকি
প্রথমবার বিলাতবাসকালেও এটি কবির সঙ্গী ছিল । পরে কীভাবে পুঁথিটি অন্তর্হিত
হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায়নি । বর্তমানে পুঁথিটি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসদনে
সংরক্ষিত আছে ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়
পদাবলির প্রভাব আস্বাদন করতে হলে মালতীপুঁথি'-র কবিতাগুলোকে বুঝতে হবে । মালতীপুঁথি'-র
টুকরো কবিতাগুলোতে কবি হৃদয়ের অশান্তি ও আক্ষেপপূর্ণ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটেছে ।
কবিতাগুলো ড . জলি সেনগুপ্তের গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে । ড . সেনগুপ্তের গ্রন্থ থেকে
মালতীপুঁথি'-র এরকম কয়েকটি অশান্তি ও আক্ষেপপূর্ণ কবিতার
উল্লেখ করা হলো :
১. হায় বিধি এ কপালে এই কি আছিল শেষে ?
ভালবাসা পাইনুনা মানুষেরে ভালবেসে ?
(রবীন্দ্র জিজ্ঞাসা , ১ ম খণ্ড , ১৯৬৫ : ১৯ / ১০ ক , পৃ . ৩২ )
২ . এস আজি সখা
বিজন পুলিনে
বলিব মনের কথাঃ
মরমের তলে যা কিছু রয়েছে
লুকানো মরম - ব্যথা ।
( ৩১ / ১৭ ক , পৃ . ৪৭)
৩. স্বতন্ত্রভাবে
লেখা দুটি পঙক্তি –
সখা
এতদিনে জুড়াল হৃদয় –
পেয়েছি সে সুখ যাহা খুঁজেছি
পৃথিবীময়—
(পৃ – ৪৪)
৪. ছেলেবেলাকার
আহা , ঘুমঘোরে
দেখেছিনু
মুরতি দেবতাসম অপরূপ
স্বজনি ,
ভেবেছিনু মনে মনে, প্রণয়ের চন্দ্রলোকে
খেলিব দুজনে মিলি দিবস ও রজনি …
(৪২/২২ খ, পৃ. ৬৮)
কবি কাহিনী'-র
খসড়ার শেষে মালতীপুঁথিতে তিনটি ছোট ছোট কবিতা আছে । কবিতাগুলোর অংশ বিশেষ এখানে
উদ্ধৃত করা হলো :
৫. পাষাণ হৃদয়
কেন সঁপিনু হৃদয় ?
মর্মভেদা যন্ত্রণায় , ফিরেও যে নাহি চায়
বুক ফেটে গেলেও যে কথা নাহি কয়
...
যার তরে কেঁদে মরি , সেই যদি উপহাসে
তবে মানুষের সাথে মিশিব না আর ।
হারে বিধি কি দারুণ অদৃষ্ট আমার
যারে যত ভালবাসি , যার তরে কাঁদে প্রাণ
হৃদয়ে আঘাত দেয় সেই বারেবারে
( ৬০ / ৩০ থ , পৃ . ৯৬-৯৭ )
৬. ও কথা বোল না
সখি- প্রাণে লাগে ব্যথা –
আমি ভালবাসি নাকো এ কিরূপ কথা ।
কি জানি কি মোর দশা কহিব কেমনে
প্রকাশ করিতে নারি রয়েছে যা
মনে –
পৃথিবী আমারে সখি চিনিল না তাই
পৃথিবী না চিনে মোরে তাহে ক্ষতি
নাই –
তুমিও কি বুঝিলে না এ মর্ম
কাহিনী
তুমিও কি চিনিলে না আমারে
স্বজনি ?
(৭০/৩৬ , পৃ .১১৯ )
৭. কি হবে বল গো সখি ভালবাসি অভাগারে
যদি ভালবেসে থাক ভুলে যাও
একেবারে
( ৭০ / ৩৬ খ , পৃ .১২০ )
৮. এ হতভাগারে ভাল কে বাসিতে চায় ?
সুখ আশা থাকে যদি বেসো না আমায়
।
এজীবন অভাগার- নয়ন সলিলধার
বল সখি কে সহিতে পারিবে তা হায়
।
এ ভগ্ন প্রাণের অতি বিষাদের গান
বল সখি কে শুনিতে পারে সারা
প্রাণ
গেছি ভুলে ভালবাসা - ছাড়িয়াছি সুখ - আশা
ভালবেসে কাজ নাই স্বজনি আমায় ।
( ৭১ / ৩৭ ক , পৃ .১২০ )
৯. জানি সখা অভাগীরে ভাল তুমি বাসনা
ছেড়েছি ছেড়েছি নাথ তব প্রেম
কামনা
এক ভিক্ষা মাগি হায় - নিরাশ কোরো না তায়
শেষ ভিক্ষা শেষ আশা- অন্তিম
বাসনা –
এ জন্মের তরে সখা- আর তা হবে না দেখা
তুমি সুখে থেকো নাথ কি কহিব আর ...
কবিতাটির শেষ
দুটি পঙ্ক্তিতে বিদায়ের সুর :
যাই সখা যাই তবে - ছাড়ি
তোমাদের সবে
সময় আসিছে কাছে বিদায় বিদায়
...
( ৭১/৩৭ ক , পৃ . ১২১ )
তরুণ কবির অন্তরের অশান্তি , আক্ষেপ ও বেদনা তাঁর মালতীপুঁথি'-র বহু কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে । কবির বাল্যকালীন রচনা 'প্রলাপ ' ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি 'জ্ঞানঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় । তিনটি কিস্তিতে প্রকাশিত ‘প্রলাপ ' একটি দীর্ঘ কবিতা । জীবনস্মৃতিতে কবি ‘প্রলাপ ' কবিতাকে বাল্যকালের ‘পদ্যপ্রলাপ ' বলে উপহাস করেছেন । ড . জলি সেন গুপ্ত এ প্রসঙ্গে সজনীকান্ত দাসের একটি উদ্ধৃতি তাঁর গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন : “ কবি স্বয়ং জীবনস্মৃতিতে এই গুলিকে ‘পদ্যপ্রলাপ ' বলিয়া বিস্মৃতিগর্ভে নিক্ষেপ করিয়াছেন । ‘সন্ধ্যা সঙ্গীতে’-র ও 'প্রভাত সঙ্গীতে'র পূর্বগামিনী ছায়া ( এ কবিতায় ) লক্ষণীয়। এই ' প্রলাপ ' কবিতাগুচ্ছে কবি - হৃদয়ের রোমান্টিক উচ্ছ্বাস ও গীতিপ্রাণতা প্রকাশিত হয়েছে । কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও রোমান্টিক আবেগ এই দীর্ঘ কবিতায় আত্মপ্রকাশ করেছে । এতে অক্ষয় চৌধুরীর রোমান্টিক আখ্যায়িকা কাব্যের প্রভাব লক্ষ করা যায় , তবে রবীন্দ্রনাথের কবি প্রকৃতি অনুসারেই এ জাতীয় কাহিনীকাব্যগুলো রচিত হয়েছিল । (ক্রমশ) ..............................
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামীকাল, মঙ্গলবার ( ০৮.০২.২০২২)
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। ( ৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।