লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
হিমালয় আমাকে বড় টানে। হিমালয়ের
বিভিন্ন স্থানে ঘোরার পর থেকেই হিমালয়ের ওপর আমার একটা অদ্ভূত আকর্ষণ জন্মেছে। আবারও
ডাক এসেছে হিমালয়ে যাবার। এ ডাক উপেক্ষা করা যায় না। এবারেও
শীতে অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষে বেড়িয়েপড়েছিলাম ১৯৩৮ মি.
উঁচুতে কুমায়ুন পর্বতমালার শৈলশহর নৈনীতাল দেখতে।
নৈনীতাল
বললেই আমার মনে পড়ে যায় সর্বপ্রথমেই যার কথা তিনি হলেন প্রখ্যাত শিকারী জিম
করবেট। জিম করবেটের প্রিয় পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে আমি নিজেকে অন্যতম মনে করি। যখন
কিছু লেখার বা পড়ার ইচ্ছা থাকেনা কোন নিরালা দুপুরে (দিবানিদ্রা আমার আসে না)
আমার সঙ্গী হয় জিম করবেট সমগ্র। করবেটের জন্ম নৈনীতালে ১৮৭৫ সালের ২৫ শে জুলাই ।
হিমালয়ের শৈলাবাস ছিল করবেট পরিবারের গ্রীষ্মাবাস। নৈনীতালের নীচে পাহাড়ের
পাদদেশে কালাধুঙ্গিতে ছিল করবেট পরিবারের ছোট্ট জমিদারী । বাল্যকাল থেকেই জঙ্গলে,জঙ্গলে প্রাণীর সান্নিধ্যে কাটাতে ভালবাসতেন তিনি । এই সময় থেকেই তার
শুরু হয় জঙ্গল জীবনের পাঠ নেওয়া। শিকার ছিল তাঁর রক্তে । কিন্তু নিছক শিকারের
উত্তেজনা আর আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে যারা প্রাণীহত্যা করেন,স্বনামধন্য জীম করবেট সাহেব তেমন শিকারী ছিলেন না। তিনি অপ্রয়োজনে কোন
প্রাণীহত্যা করেননি । মানুষ খেকো মারার সাথে সাথে এও জানতে পারা যায় করবেট
সাহেবের আকাশের মত উদার,মমত্বভরা
হৃদয়ের কথাও –ভারতের গ্রামীন মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদও
সহমর্মিতার কথাও। এটা খুব স্বাভাবিক যে অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়ে
করবেট চিন্তাভাবনা করবেন । বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিষয়টি বর্তমান সময়ে
পৃথিবীজুড়ে আন্দোলনের রূপ লাভ করেছে । ভারতে সম্ভবতঃ করবেটই সর্বপ্রথম এই নিয়ে
চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন ।
যাবার
জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। নৈনীযাত্রীরা সাধারণতঃ
কাঠগোদাম হয়ে বাসেই পৌঁছে যান নৈনীতালে । যতরকম শীত পোষাকে দিল্লীর শীত ঠেকান
যায় সেরকম পোষাকেই সজ্জিত হয়ে রওনা হলাম। সঙ্গী মেয়ে,জামাই ও বেয়ান । আমার চশমাটা খুব অসুবিধা করছিল তাই ওটা পাল্টানোর কথা
উঠল । Power চেক করে নতুন চশমা বানাতে দিয়েছিলাম । সুমন
(জামাই) ওর চশমাটা আমার নাকে পরিয়ে দিয়ে বলল , মনি , তোমাকে এই চশমাতে খুব ভাল দেখাচ্ছে কম
বয়সী মনে হচ্ছে । সুতরাং চল তোমাকে এই চশমাই করে দি । দু’টো দিন গেল চশমা পেতে। দোকানদার বলে ছিল এই চশমা কিন্তু একটু নামিয়ে
পড়বেন নীচের দিকে । সুমন শুধু কাজ করার সময় চশমা পড়ে তাই নাকের ডগায় চশমা
রাখতে অভ্যস্ত । আমার তো সব সময় চশমা পরে থাকতে হয় ।
নাকের ডগায় কতক্ষণ রাখব – ঠেলে তুলে দিয়েই পড়ে থাকতাম
। তাতে খুব অসুবিধা হত কিন্তু অসুবিধাটা যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে সেটা
ভাবতে পারিনি । পথে ঘাটে চলতে ফিরতে কেবল ঠোক্কর খেতাম । মেয়ে অনবরত এখানে উচুঁ,ওখানে গর্ত,এখানে একধাপ সিঁড়ি,এইবলে বলে সব সময়ে আমাকে সামলে চলত দিল্লীর পথে । চশমার কথাটা এই
জন্যই বললাম অনেক দুঃখের অভিজ্ঞতায় আমাকে বুঝতে হয়েছে এ চশমা নাকের ডগায় না
পড়লে সমূহ বিপদ । তাই চশমার এত কথা ।
আমরা
রওনা হলাম কাটগোদামের পথে নতুন দিল্লী ষ্টেশন থেকে । কাঠ গোদাম পৌঁছে নামার জন্য
ট্রেনের সিড়ি বা পা-দানীর কথা মাথাতেই
এলনা দেখলাম প্ল্যাটফরম ট্রেনের সমান সমান উঁচুতে নামার জন্য পা বাড়িয়ে দিলাম ।
ব্যস,দড়াম করে প্ল্যাটফরমের উপর চারহাত পা ছড়িয়ে পড়ে
গেলাম – একদিকে গেল হাতব্যাগ আরেকদিকে গেল চশমা।সবাই ছুটে এল কতটা লেগেছে দেখতে।কি করে পড়লাম সবাই অবাক! মেয়ের কাছে খুব বকা খেলাম। 'আর বকিস না,নে
-চল ,কোনদিকে যাব?'
বাসে
উঠলাম । নৈনীতালের কাছেই বাসষ্ট্যান্ড । বাস থেকে নামতেই বামে লেকের পাড় ধরে
নৈনীতাল শেষ হতেই মালিতাল । বাসষ্ট্যান্ড ,দোকানপাট , বাজার সব মালিতালের পাড়েই। আমরা
গিয়েছিলাম অনেক বছর আগে, তাই বর্তমানে এর পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানা নেই। আমরা উঠলাম নৈনীতালের পাড়েই 'মানসরোবর
হোটেলে’। গরমজলে স্নান করে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
ট্যাক্সি ঠিক করে সারাদিনে যতটা সম্ভব দ্রষ্টব্যস্থান দেখে নেব – মাঝপথে সুবিধামত জায়গায় দুপুরের খাওয়া সেরে নেব । ড্রাইভার সব বুঝে
নিয়েই রওনা হল । দেখলাম এই লেককে ঘিরেই গড়ে উঠেছে পাহাড়ী শহর নৈনীতাল । এখানে
কুমায়ুনের কথা অপ্রাসঙ্গিক হবে না । ইউফ্রেটিস নদীতীরের Kassite Assyrians-রা
তাদের হোমল্যান্ড কুমাহ্ ছেড়ে ভারতে এসে উত্তরাখন্ডে বসতি গড়ে তোলে নতুন উপনিবেশ
কুমায়ুন । এই বংশেরই কন্যা সিদ্ধার্থ জননী মায়াদেবী ।
বহুবার হাত বদল হতে হতে কুমায়ুন আসে বৃটিশের দখলে । আর আজ প্রকৃতি প্রেমিক
পর্যটকদের দখলে কুমায়ুন সাম্রাজ্য। তুষারাচ্ছাদিত হিমালয়ের শিখররাজী দেখতে
যাত্রী যাচ্ছেন কুমায়ুনের দিকে দিকে । নৈনীতাল , আলমোড়া
, রানীক্ষেত , চৌকোরি , কৌশানি , পাউরি , পিযোরাগড়
অনবদ্য । হিন্দুপুরাণের নানান আখ্যান ছড়িয়ে রয়েছে কুমায়ুনের গিরিকন্দরে ।
প্রথমে
আমারা গেলাম ঘোড়াখালে । ঘোড়াদের খাবারজন্য ছোট্টখাল বা পুকুর । এখানে বাঁদিকে
একটু উঁচুতে দেওদারও পপলারে ঘেরা গলুদেবতার মন্দির । ঢুকতেই বড় বড় ঘন্টা ঝুলছে
একটু ভেতরে যেতেই দেখি মাঝখানে একটা বটগাছ তার প্রতিটা শাখায় থরে বিথরে ছোট অতি
ছোট , মাঝারি অজস্র ঘন্টা বাঁধা
রয়েছে । – কোথাও এতটুকু গাছের ডাল দেখা যাচ্ছে না –
সে এক দেখার জিনিস । পাহাড়ীদের বিশ্বস্ত দেবতা এই গোলু । গোলু
শিবেরই একনাম । এখানকার লোকেদের ধর্মীয় বিশ্বাস স্বয়ং শিব অবতাররূপে বিরাজ করছেন
এখানে পাহাড় বাসীদের জীবনে নিরাপত্তা ও সুবিচার দিতে । স্থানীয় লোকেদের অগাধ
বিশ্বাস যে,যা কামনা করে ঘন্টা বেঁধে যায় তার কামনা
দেবতা অবশ্যই পূরণ করেন । কাছেই দোকান থেকে আমার মেয়ে গিয়ে পূজার উপকরণ কিনে আনল
এবং সঙ্গে একটি ঘন্টাও
এনেছিল । পূজাদিয়ে ঘন্টাটিকে অগণিত ঘণ্টার সাথে সেটিকেও বেঁধে দিল মেয়ে।
২৩৫২ মি . উঁচুতে ল্যান্ডেস্ এন্ড ’ সুন্দর এক ভিনটেজ পয়েন্ট । পাহাড় এখানে
তড়িঘড়ি এবড়ো খেবড়ো ভাবে সমতলে নেমেছে । খুরপাতাল লেকটি এখানথেকে পুকুরের মত
দেখায় ।
তালিতাল থেকে ৩ কিলোমিটার যেতে ১৯২৭ মি . উঁচুতে টিলার টঙে পবনপুত্র হনুমান
মন্দির । এখানকার নৈসর্গিক শোভা অনুপম । নৈনীতাল থেকে মুক্তেশ্বর সড়কধরে এগিয়ে
গেলে ১৭৮৯ মি. উঁচুতে কুমায়ুনের বিখ্যাত সব ফলের বাগিচা রামগড় । কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিল রামগড় । গীতাঞ্জলি ও সন্ধ্যাসংগীত রামগড়েই রচনা করেন
কবি ।
দুপুরে আমরা পথের ধারেই লেকের পাড়ে বসে নিরামিষ খাবার খেলাম । অতিশয় সুখাদ্য ও
উপভোগ্য । ২৬০০ মি . উঁচুতে নায়নাপিক । ফ্ল্যাটস থেকে পথ উঠেছে নায়নার পিক থেকে
তুষার ধবল নন্দাঘুন্টি , ত্রিশূল ,
নন্দাদেবী ও নন্দাকোটছাড়াও
নৈনীতাল লেক ও শহরের দৃশ্য মনোরম । নৈনীলেকের জলে বোটিং অতিশয় উপভোগ্য ।
পান্নাসবুজ গভীর জল – আমার ও খুবই ভালো লাগছিল । নৌকায় ওঠার আগে যখন লাইফ
জ্যাকেট পড়ছিলাম তখন থেকে গভীর জলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল সলিল সমাধি হবে নাতো! অবশ্য কথিত আছে অত্রী ঋষির সৃষ্ট লেকে
মানস সরোবরের জল মেলে । সুতরাং ভাবনা কি ?
তবে ভয়ে নৌকাবিহার করব না
এমন নয়। তবে বেশীক্ষণ ঘোরায় না। আমরা দুবারের ভাড়া দিয়ে অনেকটা ঘুরলাম । মেয়ে
রাগ করছিল,বলছিল
একটুও ভয় ডর নেই তোমার! মেয়ে,জামাই দু'জনেই তখন বেশ মোটা-মুটি তাই ওরা দুজনে দুই প্রান্তে আর আমি আর
শিখা ভাগাভাগি করে ওদের পাশে বসে নৌকার ভারসাম্য রাখছিলাম । আমি রোগা,উৎসাহী আর হাঁটুর জোরের জন্যই পাহাড়ে এমন স্বচ্ছন্দ।
কুমায়ুন ভ্রমণে কৌশানী অবশ্যই দর্শনীয় । পাইনে ছাওয়া শহর প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি । দেবতাত্মা হিমালয়ের নৈসর্গিক ,শোভার তুলনা হয় না । উজ্জ্বল নীলাকাশ –
পাইনের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়
। চৌখাম্বা , নীলকণ্ঠ , নন্দাঘুন্টি , ত্রিশূল , মীরাঘন্টি , দেবীদর্শন , নন্দাদেবী , নন্দাকোট পঞ্চঙ্গুলী শিখররাজি মনোরম দেখায় । উদিত ও অস্তগামী সূর্যের রক্তিম
আভার প্রতিফলনে দিগন্তবিস্তৃত তুষারাচ্ছাদিত শিখররাজির মোহময়ীরূপ অতুলনীয় ।
অসংখ্য ঘন্টার সম্ভার নিয়ে সোমেশ্বর মন্দির কৌশানীর প্রবেশ পথে ।
শহর থেকে ২ কি.মি. দূরে ২২৮৭ মি . উঁচু পপুলার ভিউপয়েন্ট স্নোভিউ থেকে বরফে ছাওয়া হিমালয়ের নানান শিখর সুন্দর দৃশ্যমান । বায়নো কুলার বসানো হয়েছে ১০ টাকায় ১০ মিনিট ধরে হিমশৃঙ্গগুলির সৌন্দর্য্য দেখার জন্য । ৭০০ মি . কেবল কার চলছে ।
ক্রমশ ………
আগামীকাল পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।