প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
ফেরার
পথে আমরা গেলাম পৌরানিক গুহা শেষনাগ ও শিবঠাকুরের নিজের বাড়ি । পাহাড় থেকে চুঁয়ে চুঁই জল পড়ে সৃষ্ট
ল্যাটারাইটচুনাপাথরের দন্ডে হিন্দুপুরাণের তেত্রিশকোটি দেবতা
মূর্ত হয়েছেন । পান্ডবরা নাকি বনবাসকালে বাস করেছেন এখানে । ভিতরে পাহাড়টাই
ফণাতোলা শেষনাগরূপী। দর্শনে অবাক হয়য় সবাই। জেনারেটরে আলোর ব্যবস্থা
হলেও টর্চ ছিল সংগে তাই বাঁচোয়া । সঙ্কীর্ণ গুহাপথে উঁচু নীচু ধাপে শ ’খানেক ফুট নেমে এবড়ো খেবড়ো অভ্যন্তর। দম আটকে যামার উপক্রম ।
ভিতরে অক্সিজেনের অভাব তাই বয়স্কদের না যাওয়াই উচিৎ ।
পরদিন ঝলমলে রৌদ্রস্নাত পথঘাট । বেরিয়ে পড়লাম হেঁটে শহর দেখব বলে ।
নায়নাপিক , আলমা , শের কা ডাঙা , লরিয়াকাস্তা , ডরোথিসিট , হান্ডিবুন্দি , ক্যামেলস ব্যাক – আকাশচুম্বী সপ্তশৃঙ্গ ঘিরে রেখেছে শহরকে । শান্ত স্নিগ্ধ
পপলার আর দেওদার ছাওয়া শহর । ম্যাল ধরে চিনারের সারি । শহর একাধিকবার প্রকৃতির
হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । বিশেষ করে ১৮৮০ সালে সপ্তাহব্যাপী বিধ্বংসী বৃষ্টির ধ্বসে
১৫০ জন সমাধিস্থ হন অ্যাসেম্বলী হল এ । আর সেখানেই গড়ে ওঠে আজকের বিনোদন ক্ষেত্র
ফ্ল্যাটস্।
ফ্ল্যাটসে ঢোকার আগে আজও একবার লেকের জলে নৌকাবিহার হল । তবে সাততালে ঘুরতে যত
আনন্দ হয় এখানে তত হয় না । নৌকা থেকে নেমে সবাই ফ্ল্যাটসের দিকে এগিয়ে গেলাম
হরেক রকম পাহাড়ী পোষাক,জুতো,মোজা,টুপী জ্যাকেট হাতে
বোনা ঘরে পড়ার উলের জুতো – আরও কত কিছু নিয়ে থরে থরে রংবেরং - এর
পশরা সাজিয়ে বসেছে আসে পাশের স্থানীয় বাসিন্দারা । ঘুরে ঘুরে দেখতেই আর্দ্ধেক
দিন গেল । কিছু খাওয়া সেরে কেনাকাটায় মন দিলাম । সবাই সবাইকে দেবার জন্য ব্যস্ত
। সুমন শিখাকে বললাম -'কি নেবে নাও,আমি দেব । অনেক খুঁজে দুজনেই জুতো পছন্দ
করলো - দিলাম । ওরাও আমাকে দিল মাফলার,মোজা। ফ্ল্যাটসে ঢোকার মুখে আজও ঘটল আমার মর্মান্তিক পতন । আর এটাই শেষ । বেশ
শীত,পোষাকে আপাদমস্তক সুসজ্জিত হয়ে মাথায় ভেল বেঁধে,গায়ে কোট,গ্লাভস পরে থাকতে পারিনা বলে কোটে পকেটে
হাত ঢুকিয়ে জুতো পায়ে
গটগট করে চলেছি । ফ্লাটসে ঢোকার মুখেই ছোট্ট একটা পাথরের চাতালের কোনায় হোঁচট
খেয়ে দড়াম করে পড়ে গেলাম । লোক জন জড় হয়ে গেল । কে যেন একজন বললো -‘বিমারী হ্যায় কিয়া ’?
অন্যরাও অনেকে অনেক কথাই বললো।এসব কথা শুনতে শুনতে অন্যদের সাহায্যে ঝেড়ে ঝুড়ে উঠলাম । বাঁ হাটু ,
থুতনী ,
ডান হাতের কব্জিতে রক্ত
জমে নীল হয়ে উঠল । মাথাটাও ঝিমঝিম করছে । বসলাম এক জায়গায় । মেয়ে মলিন মুখে বলল,মা ,আর কত পড়বে । আমি তো তোমাকে সামলেই চলি । বুঝতেই পারিনি এখানে
তোমার হোঁচট খাবার জায়গা আছে নাকি । আর এই পাথরটা তো বেশ
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে । কেন যে তোমার হাত ছেড়ে দিলাম ! বললাম ,'দুঃখ করিস না,কেন বারে বারে অদ্ভুতভাবে প্রচন্ড আছাড়
খাচ্ছি এবারে সে কারণট এবার বুঝতে পেরেছি । সেটা আমার এই
ফ্যাসানের হাফ চশমা , এটা নাকের ডগায় ঝুলিয়ে না রেখে নাকের
উপর ঠেলে তুলে রাখি আর তাই তলা দিয়ে সবই সমান দেখি উঁচু,নিচু বুঝতে পারি না । ফেলেদে এটাকে -লেকের জলে । দ্যাখ খুঁজে ব্যাগে আমার পুরানো চশমাটা পাবি হয়ত ।ভাগ্য ভাল পাওয়া গেল চশমাটা ,
চোখের জল মুছে হাসি মুখে
ঢুকলাম ফ্লাটসে ।
হাঁটুতে জোর লেগেছে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল,কিন্তু সেটা কাউকে কিছু বলিনি ,
লজ্জাও তো পাচ্ছিলাম । জ্যাকেট দিল মেয়ে । প্রচুর
কেনাকাটা করে হঠাৎ নজর গেল রাস্তার ওপরের দোকান থেকে মেয়ে
চিৎকার করে ডাকছে । গেলাম ,অপূর্ব সব স্কোয়াশ । আর কোথাও যা পাওয়া
যাবে না । আমরা দুবোতল করে রডোডেনড্রনের স্কোয়াশ আর লিচুও আপেলের জুস কিনলাম ।
রডোডেনড্রনের স্কোয়াশের একটা বোতল খুলে সবাই খেলাম । কী যে ভাল খেতে । তখন
ভাবছিলাম আজেবাজে জিনিস কিনে টাকা নষ্ট না করে এক পেটি রডোডেনড্রনের স্কোয়াশ কিনলেই ভাল হত ।
উপহার হিসেবে খুবই উপাদেয় হত ।
দোকান থেকে বেরিয়েই দেখি লেকের জল আর দেখা যাচ্ছে না । কুয়াশার পুরু আস্তরণ
যেন লেকের জলের উপর চেপে বসছে । আমাদের মাথা কানও মুহূর্তের মধ্যে ঠান্ডায় কনকন
করতে লাগল । তারাতারি হোটেলে ফিরবার চেষ্টা করলাম । রিক্সা নিতে এখানে কুপন লাগে ।
যেখানে সে রিক্সার কুপন দিচ্ছে সেখান থেকে আমাদের হোটেল ২/৩ মিনিটের পথ । সুতরাং
জোর কদমে হাঁটা শুরু করলাম । পৌঁছে গেলাম হোটেলের বারান্দায় ।
ঘরে ঢোকার মুখে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম । সন্ধ্যায়
আলো জ্বলে উঠেছে চারিধারে। দ্বিতল বারান্দা থেকে লেকের দৃশ্য এবং লেকের পাড়ে
ডানদিকে আলোক মালায় সুসজ্জিত দোকান পাটের প্রতিচ্ছায়া লেকের জলে প্রতিফলিত হয়ে
অনবদ্য শোভাধারণ করেছে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু’দন্ড যে দেখব তার উপায় নাই –
এত প্রচন্ড ঠান্ডা যে হাত
পা সব জমে অসাড় হয়ে আসছে । ঘরে ঢুকে গেলাম । ভাবলাম যে রাতে খাবার পর আবার এসে
বারান্দায় দাঁড়াব । কিন্তু তা সম্ভব হয় নি । চেষ্টা সত্ত্বেও। এত ঠান্ডা ।
আগের দিন নিজেদের কম্বল আর সব গরমজামা কাপড় পরে শুয়েও শিখা আর আমি শীতে কষ্ট
পেয়েছি । আজ তাই সকালেই লেপ নিয়ে রেখেছিলাম । ঘরে গিয়েই সেই মোটা লেপের তলায়
ঢুকে তবে আরাম । আর কেউ নড়বে না , তবে চায়ের কথা বলতে যাবে কে ?
সুমন ছাড়া গতি নেই ,
ওই বেরিয়ে গিয়ে চায়ের
বদলে গরম স্যুপ নিয়ে এল খেলাম আরাম করে । সুমনকেও বললাম এবার জুতো খুলে লেপের
ভিতর পা - ঢুকিয়ে আরাম করে বসো । রাতের খাবার খেতে তো দেরী আছে । তবু কিছুতেই ও লেপের মধ্যে গেল না, বসে রইল । বলল
একবার লেপের তলায় ঢুকলে আমাকে মারলেও আর আমি বেরতে পারব না । তার চেয়ে যাই রাতের
মাংসের অর্ডার দিয়ে এসেছি কিচেনে,বসে ওদের সঙ্গে গল্প করি
গিয়ে ।
খবার সময়ে মেয়ে অনেক ডাকাডাকি করাতে দুই বুড়ি উঠে গেলাম । আমি খেলাম গরম
গরম ডাল ভাত আর আলুর ফিংগার ফ্রাই । ওরা খেল মাংস ভাত । এখানকার ডালভাত খেতে খুবই
ভালো । এবার লেকের দিকে তাকাবো কি,দৌড়ে
ঘরে গিয়ে ঢুকলাম । শুতে যাবো ,তখন সুমন বাঁধা দিল। বলল আজ রাতেই যদি
আমরা বাসে চাপি,তাহলে সকালেই দিল্লী পৌছে যাব। সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে পরেরদিন সোমবার অফিসে
যেতে পারব । রাতে যদি এখানে আরাম করে ঘুমাই তাহলে কাল রবিবার সারাদিন বাস জার্নি
করে পরদিন সকালেই অফিস যেতে খুবই কষ্ট হবে । অবশ্য তোমরা যদি রাজী হও রাতের বাসে
যেতে তবেই । পাহাড়ে রাতের বাসে যাওয়া ভয়েরই ব্যাপার তবু ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ চেয়ে
রাজী হয়ে গেলাম । সত্যিই তো সোমবার সকালে ৮ টার মধ্যেই তো ওদের অফিসে ছুটতে হবে
।
করুণ দৃষ্টিতে লেপের দিকে তাকাতে তাকাতে জিনিসপত্র গুছাতে লাগলাম । ১১-৩০ মি .
বাস । রাত প্রায় ১২ টায় একটা ভলবো বাসে চেপে শুয়ে পড়লাম । ঘুমিয়ে পরেছি । বাস
পাহাড়ী পথে ঘুরে ঘুরে নামছিল যখন তখন নাকি মেয়ের খুব ভয় করছিল । ফলে ওদের ঘুম
নাকি হয়নি । এদিকে আমি আর শিখা বাসে হেলান দিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আঘোরে ঘুমিয়েছি । দিল্লী পৌঁছে
আমাকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলতে হয়েছে ।
এই সময়ে একটা অত্যন্ত নির্মল এক হাসির ব্যাপার হল –
আমার জামাই মহারাষ্ট্রের
আহমেদনগরে স্কুলবেলা কাটিয়েছে । পরবর্তীতে দিল্লী । বাংলা হরফ চেনে না,তাই বাংলাও পড়তে পারে না । মা-বাবার বাংলা কথা শুনে শুনে বাংলা শেখা ।
অনেক কথাই ( যা ঘরোয়া নয় ) প্রথম প্রথম আমাদের কথা না বুঝতে পারলে 'মতলব ','মতলব '
বলে জিজ্ঞেস করতো অর্থটা কি । মানে বোঝাবো কি আমরা খুব
হাসাহাসি করতাম , তাতেও লজ্জা পেয়ে আর মতলব কথাটা বলত না । শুনে শুনে শেখার
জন্য সঠিক উচ্চারণও হত না । যেমন খুব গরম লাগছে আজকে –
ও বলত ‘
খুব গম লাগছে ’
মাঝের ‘
র’টা উধাও এত কথা বললাম ওর সম্পর্কে যে আমার
বাঁধান চাতালে এমন মারাত্মকভাবে পরে যাওয়াতে ওর খুব কষ্ট হয়েছিল । তাই পরদিন যখন
ঘুম চোখে বাস থেকে নামাছি তখন কাছে এসে খুব সমবেদনার সাথে নরমসুরে জিজ্ঞেস করল –
‘ব্যাটা কমেছে ?
’ একটুও হাসি পায়নি ওর কথা
শুনে বরং ভাললাগায় মনটা ভরে গেল । বললাম হ্যাঁ বাবা ব্যথা অনেক কমে গেছে । ”
ভাবলাম ,
এই সহৃদয় মনটা যেন ওর
চিরকাল বজায় থাকে ।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার
পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র
কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে
ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।